বিপ্লবী উল্লাস কর দত্তের বাড়িটি এখন প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধিনে চলে গেছে। এই বাড়িটিকে রক্ষা করার জন্য কয়েকটি গণমাধ্যমে সংবাদ প্রচার হয়েছিল। উল্লাস কর দত্তের বাড়িটি সংরক্ষনের দাবি জানিয়েছেন স্থানীয় ও সুশীল সমাজের লোকজন। এছাড়া স্থানীয় ও বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন বাড়িটিকে রক্ষার জন্য মানববন্ধন পদযাত্রা ও পথসভা করেন। যার ফলশ্রুতিতে বিষয়টি প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের নজরে আসে।
আজ বুধবার (২৯ মার্চ) ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরাইল উপজেলা’র কালিকচ্ছ ইউনিয়নের বিপ্লবী উল্লাস কর দত্তের জন্ম ভিটেতে আসেন বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের কুমিল্লা বিভাগীয় কর্মকর্তারা। এখানে এসে তারা বাড়িটিতে সাইনবোর্ড টানিয়ে দিয়ে যায়। এখন থেকে বাড়িটি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আওতাধীন। সাইনবোর্ডে লেখা রয়েছে কোন ব্যক্তি এই পুরাকীর্তির কোন রকম অনিষ্ট বা ধ্বংস করলে বা তার উপর কোন রকম দাগ কাটলে ১৯৬৮ সালের আইনে জরিমানা অথবা উভয় প্রকার দন্ডে দণ্ডনীয় হবেন।
উল্লাসকর দত্তের ঐতিহাসিক এই বাড়ীটি প্রত্নতত্ব অধিদপ্তর পুরাকীর্তি ঐতিহাসিক নির্দশন হিসাবে গেজেট প্রকাশ করেছে। বাড়ীটি এখন রাষ্ট্রীয় সম্পদ। এ গেজেট ও সাইনবোর্ডের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক ভাবে কালীকচ্ছ তথা সরাইল, ব্রাহ্মণবাড়ীয়া ভারত বর্ষের স্বাধীনতার ইতিহাসের অংশ হয়ে থাকবে।
ঐতিহাসিক অর্জনে এ বাড়ীটি যাতে ঐতিহাসিক পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি লাভ করতে পারে সে জন্য সকলের সহযোগিতা প্রয়োজন। এলাকা বাসী এই বাড়ীটি প্রত্নতত্ব অধিদপ্তর পুরাকীর্তি ঐতিহাসিক নির্দশন হিসাবে গেজেট প্রকাশ করায় সংস্কৃতি মন্ত্রনালয়, প্রত্নতত্ব অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, জেলা ও উপজেলা প্রশাসন তথা বাংলাদেশ সরকারকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন।
উল্লেখ্য:
সরাইল উপজেলা’র কালিকচ্ছ ইউনিয়নের দত্ত পড়া এলাকায় জন্ম গ্রহণ করেন উল্লাস কর দত্ত। ১৮৮৫ সালের ১৬ এপ্রিল এই বাড়িতেই জন্ম হয়েছিল বিপ্লবী এই নেতার। তার পিতার নাম ছিল দ্বিজ দাস। তিনি ওপার বাংলার কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র ছিলেন। পরে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় হতে কৃষি বিদ্যায় ডিগ্রি অর্জন করেন। তবে কলেজে পড়ার সময় ইংরেজ অধ্যাপক রাসেল বাঙালিদের সম্পর্কে কটুক্তি করার দরুন উল্লাস কর তাকে আঘাত করেন। এরজন্য উল্লাস কর দত্তকে কলেজ থেকে বহিস্কৃত হতে হয়েছিল।
ঐ সময় থেকে তার জীবনে পরিবর্তন আসতে শুরু করে। বিপিন চন্দ্র পালের অনুপ্রেরণাতেই উল্লাসকর দত্ত প্রথম বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে যোগ দেন। সেই সময় থেকেই ধুতি পাঞ্জাবি পড়া শুরু করেন তিনি। পরে যুগান্তর দলে যোগ দেন উল্লাস কর দত্ত। তিনি বিস্ফোরক নির্মাণে অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। তার দেয়া ফরমূলায় তৈরী বোমা পরীক্ষা করার জন্যে একদল বিপ্লবী বেছে নেন দেওঘরের নিকট নির্জন দীঘারিয়া নামের পাহাড়।
১৯০৮ সালের ১ মে সেই পরীক্ষার দিন বোমা ছোড়ার সময় আহত হয়ে মারা যান বিপ্লবী প্রফুল্ল চক্রবর্তী। তখন উল্লাসকর ও মারাত্মক জখম হন।
সে সময় গোপনে কলকাতায় তার চিকিৎসা করেন ডাক্তার ও বিজ্ঞানী ইন্দুমাধব মল্লিক। তখন উল্লাসকরের তৈরি বোমায় ক্ষুদিরাম বসু ও প্রফুল্ল চাকী ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ডকে আক্রমণে ব্যবহার করেছিলেন। তবে এই হামলা এক সময় বানচাল হয়ে যায়। সেসময় পুলিশ উল্লাসকর দত্ত সহ যুগান্তর দলের অনেক সদস্যকে গ্রেফতার করে।
উল্লাসকর দত্ত ১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দের ২ মে মুরারিপুকুর বাগানে ধরা পড়েন । ১৯০৯ খ্রিষ্টাব্দে আলিপুর বোমা মামলা নামের এই বিখ্যাত মামলায় উল্লাসকর ও বারীন ঘোষকে ফাঁসীর আদেশ দেয়া হয়।
তবে পরবর্তীকালে এই সাজা পরিবর্তন করে তাকে আন্দামানের সেলুলার জেলে যাবত জবন দ্বীপান্তরের সাজা দেয়া হয়। আন্দামানের কুখ্যাত সেলুলার জেলে উল্লাসকর দত্তকে শারীরিক নির্যাতনের সম্মুখীন হতে হয়। এর ফলে তিনি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন।
১৯২০ সালে উল্লাস কর দত্তকে মুক্তি দেয়া হলে তিনি কলকাতা শহরে ফিরে আসেন। উল্লাসকর দত্ত কে পরে ১৯৩১ সালে আবারও গ্রেফতার করা হয়, ও ১৮ মাসের কারাদন্ড দেয়া হয়। ১৯৪৭ এর ভারত বিভাগের পর তিনি কালিকচ্ছ গ্রামের দত্ত পাড়ার বাড়িতে ফিরে আসেন।
১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে ৬৩ বছর বয়সে বিশিষ্ট নেতা বিপিনচন্দ্র পালের বিধবা মেয়েকে বিয়ে করেন । ওই বাড়িতে ১০ বছর কাটানোর পর তিনি ১৯৫৭ সালে কলকাতায় প্রত্যাবর্তন করেন। উল্লাসকর দত্ত পাড়া তার শেষ জীবন শিলচরে কাটান। সেখানেই ১৯৬৫ সালের ১৭ই মে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।