ঢাকা ০৯:৫২ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ০২ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম
Logo অন্তর্বর্তী সরকার ও প্রধান উপদেষ্টার প্রতি মানুষের ব্যাপক আস্থা Logo ইতিহাসের এই দিনে… ২ ডিসেম্বর : মুক্তিযুদ্ধের অগ্নিঝরা দিন Logo সম্পত্তি নিয়ে দ্বন্দ; বাবার মরদেহ ২৩ ঘণ্টা আটকে রাখলো ছেলে Logo নীলফামারীতে নারী ও শিশু নির্যাতন মামলায় দুইজনের যাবজ্জীবন Logo ঝিনাইদহে ব্যবসায়ী মুরাদ হত্যা মামলার আসামী গ্রেফতার Logo লালমনিরহাট কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের শিক্ষকের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীকে কু-প্রস্তাব দেয়ার অভিযোগ Logo ময়মনসিংহ-শেরপুর সীমান্তে বিপুল পরিমাণ ভারতীয় চোরাচালানী মালামাল আটক Logo চাঁদপুরে বিচারক হিসাবে যোগ দিলেন মোহাম্মদ কামাল হোসাইন Logo রাঙ্গামাটিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাতিলের দাবীতে নাগরিক পরিষদের Logo কুমিল্লার দুই সাংবাদিকের ৫ বছরের দুর্বিষহ হয়রানির অবসান

ইতিহাসের এই দিনে… ২ ডিসেম্বর : মুক্তিযুদ্ধের অগ্নিঝরা দিন

মোহাম্মদ আলী সুমন

২ ডিসেম্বর, বিজয়ের মাসের দ্বিতীয় দিন। ১৯৭১ সালের এই দিনে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এক ভয়ংকর, নির্মম, তীব্র এবং আন্তর্জাতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে দাঁড়িয়ে পড়েছিল। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বুঝতে শুরু করেছিল যে তাদের পরাজয় এখন কেবল সময়ের অপেক্ষা, আর ঠিক সেই কারণেই তারা আরও বেপরোয়া, বর্বর ও হিংস্র হয়ে ওঠে। এদিন দেশজুড়ে চলতে থাকে নির্বিচার গণহত্যা, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ এবং গ্রাম–শহরে আতঙ্ক সৃষ্টির চেষ্টা। বিশেষ করে ঢাকায় কারফিউ জারি করে সাধারণ মানুষের চলাচল প্রায় অসম্ভব করে দেওয়া হয়, সাংবাদিক, শিক্ষক, ছাত্রনেতা, পেশাজীবী এবং সম্ভাব্য মুক্তিযুদ্ধ-সমর্থকদের টার্গেট করে তালিকা অনুযায়ী গ্রেফতার ও হত্যা করা হয়।

২ ডিসেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া সেক্টরে মুক্তিবাহিনী তিন দিক থেকে আক্রমণ করলে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী আজমপুর রেলওয়ে স্টেশন ছেড়ে পালিয়ে যায়। আজমপুর রেলওয়ে স্টেশন মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে এলেও পাকিস্তানি সৈন্যরা মুক্তিবাহিনীর ওপর পালটা আক্রমণ করে এবং আখাউড়া রেল স্টেশনে চলে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর প্রচণ্ড সম্মুখযুদ্ধ। পাকিস্তানিরা এই যুদ্ধে ট্যাংক ব্যবহার করে।

সম্মুখযুদ্ধে প্রকম্পিত হয়ে উঠে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া এলাকা। সঙ্গে সঙ্গে আখাউড়াসংলগ্ন আগরতলা শহরও কেঁপে ওঠে। কসবা থেকে মুকুন্দপুর আর আখাউড়া থেকে উজানিসার পর্যন্ত তিন দিনের যুদ্ধে মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানিদের ধরাশায়ী করে ফেলে। কুমিল্লা-সিলেট সিঅ্যান্ডবি রোডের সংযোগ মুক্তিযোদ্ধারা বিচ্ছিন্ন করে দেয় এবং চট্টগ্রাম-কুমিল্লা-ঢাকা রেল যোগাযোগও সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তিন দিনের যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি সৈন্যদের অবরুদ্ধ করে রাখে এবং অনেক পাকিস্তানি সৈন্য হতাহত হয়।

সিলেটের গুরুত্বপূর্ণ শমসেরনগর বিমানবন্দর মুক্তিবাহিনী সম্পূর্ণ দখল করে নেয়। মুক্তিবাহিনী ঘোড়াশালে পাকিস্তানি সৈন্যদের শক্ত অবস্থানের ওপর চারদিক থেকে একযোগে আক্রমণ করে অনেক পাকিস্তানি সৈন্যকে হতাহত করতে সক্ষম হয় এবং এখান থেকে বেশকিছু গোলাবারুদ উদ্ধার করে মুক্তিবাহিনী।

এ দিন চট্টগ্রামে মুক্তিবাহিনী উত্তরে ফটিকছড়ি ও রাউজান থানা এবং দক্ষিণে আনোয়ারার অধিকাংশ স্থান তাদের নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়। নোয়াখালী থেকে চট্টগ্রামের পথে পথে মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা হানাদারদের সঙ্গে খণ্ড খণ্ডভাবে সম্মুখযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে।

সীমান্ত এলাকাগুলোতে সংঘাত তীব্র আকার ধারণ করলে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে যোগ দেয় ভারতীয় বাহিনী। বীর মুক্তিযোদ্ধারা ভারতীয় সেনাবাহিনীর সহায়তায় গভীর রাতে বাংলাদেশের সবচেয়ে উত্তরে অবস্থান পঞ্চগড়ে ক্ষীপ্রগতিতে আকস্মাৎ আক্রমণ করে পঞ্চগড় মুক্ত করে নেয় এবং ঠাকুরগাঁওয়ের দিকে বিজয়ের বেশে এগিয়ে যেতে থাকে।

মুক্তিযোদ্ধাদের হামলায় ও বোমা বিস্ফোরণে ঢাকার রামপুরা বিদ্যুৎ সরবরাহ কেন্দ্র, চট্টগ্রামের পাঁচটি বিদ্যুৎ সাব-স্টেশন ও দুটি পেট্রোল পাম্প বিধ্বস্ত হয়। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম মুক্তিবাহিনীর এই সাফল্যের খবর গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করে। বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকা, আকাশবাণী ও স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের সংবাদে প্রচারিত হতে থাকে মুক্তিযোদ্ধাদের নিত্য নতুন বিজয়ের সংবাদ।

খুলনা অঞ্চলে লেফটেন্যান্ট জিয়াউদ্দিনের নেতৃত্বাধীন মুক্তিবাহিনী সুন্দরবনের বিস্তীর্ণ এলাকা আগেই শত্রুমুক্ত করেছিল এবং পাকিস্তানি সেনাদের পিছু হটিয়ে মুক্তিবাহিনী সাতক্ষীরার উপকণ্ঠে পৌঁছে যায়। রূপসা নদীর ওপারে খুলনার কাছে ঘাঁটি স্থাপন করে মুক্তিযোদ্ধাদের আরেকটি দল।

এদিকে মুক্তিযোদ্ধারা টাঙ্গাইলের নাগরপুর থানা মুক্ত করে এবং টাঙ্গাইল আক্রমণের প্রস্তুতি নিতে থাকে। একাত্তরের এই দিনে ময়মনসিংহ, জামালপুরসহ দেশের বেশ কয়েকটি এলাকায় গণহত্যা চালায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী। মুক্তিযোদ্ধারা রাজধানী ঢাকাকে দখলমুক্ত করার লক্ষ্যে আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখ যুদ্ধ করে করে ঢাকার দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে যেতে থাকে।

ঢাকাসহ বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে পাক সেনারা এবং তাদের দোসর রাজাকার–আলবদররা শত শত নিরীহ মানুষকে গুলি করে হত্যা করে, ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয় এবং বিভিন্ন কৌশলগত স্থানে মাইন পেতে রাখে যাতে মুক্তিযোদ্ধাদের অগ্রযাত্রা বাধাগ্রস্ত হয়। কিন্তু বাঙালির মনোবল ভাঙতে পারেনি এই বর্বরতা।

এই সময় বাংলাদেশের বিভিন্ন সেক্টরে মুক্তিযোদ্ধারা চালিয়ে যান সবচেয়ে সাহসী ও কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ সব অভিযান। ২ ডিসেম্বর সেক্টর–২, সেক্টর–৩, সেক্টর–৭ এবং সেক্টর–১১–এ মুক্তিবাহিনী পাক ঘাঁটি দখল করে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করে। একই দিনে পূর্বাঞ্চলের আকাশসীমায় ভারতীয় বিমানবাহিনী পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে পাকিস্তানি বাহিনীর সাপ্লাই লাইন ভেঙে দেয়। এদিনই ভারত সরকার বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়, যা আন্তর্জাতিক মহলে মুক্তিযুদ্ধের সঠিকতা, নৈতিক বৈধতা ও স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষাকে আরও দৃঢ় করে। ভারতের স্বীকৃতি যুদ্ধক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল বাড়িয়ে দেয়, কারণ এতে নিশ্চিত হয়-দেশটি আর বিচ্ছিন্ন নয়, বাংলাদেশের জন্ম এখন বৈশ্বিকভাবে স্বীকৃত একটি বাস্তবতা।

এই ২ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখন পাকিস্তানের কারাগারে অন্ধকারে বন্দী। কিন্তু বন্দিত্ব তাঁর নেতৃত্বকে থামাতে পারেনি, তাঁর আহ্বানকে স্তব্ধ করতে পারেনি। তাঁর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ তখনো ছিল প্রতিটি মুক্তিযোদ্ধার বুকের ভেতর জ্বলন্ত মশাল। “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম”—এই ঘোষণাই যুদ্ধের প্রতিটি রণাঙ্গনে বাঙালিকে দিকনির্দেশনা দিচ্ছিল। বঙ্গবন্ধু ছিলেন স্বাধীনতার নকশাকার, মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক, এই জাতির চূড়ান্ত প্রেরণা। তাঁর মুক্তির আন্দোলন, রাজনৈতিক সংগ্রাম, বৈশ্বিক কূটনৈতিক অবস্থান স্পষ্ট করেই জানিয়ে দিয়েছিল—বাংলাদেশের জন্ম রুদ্ধ করা যাবে না। পাকিস্তান কারাগারে থেকেও তিনি হয়ে উঠেছিলেন বাঙালির স্বাধীনতার প্রতীক।

২ ডিসেম্বর শহিদদের আত্মত্যাগের রক্তে রঞ্জিত ছিল বাংলাদেশের মাটি। বীর মুক্তিযোদ্ধারা লড়েছেন গেরিলা কৌশল, মুখোমুখি যুদ্ধ, রাত্রিকালীন আক্রমণ এবং বিস্ফোরণ অভিযানে। শত শত অজ্ঞাতনামা মানুষ শহিদ হন; কেউ ছিলেন কৃষক, কেউ ছিলেন শিক্ষক, কেউ ছাত্র, কেউবা স্রেফ গ্রামবাসী। কিন্তু ত্যাগের সেই দীর্ঘ সারিতে নামের পার্থক্য ছিল না—সকলেই ছিলেন দেশের জন্য জীবনদানকারী বীর। একদিকে পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বরতা, অন্যদিকে বাঙালির অদম্য সাহস—দুইয়ের দ্বন্দ্বে স্বাধীনতার সূর্য আরও কাছে চলে আসে। ডিসেম্বরের দিনগুলো যত এগোতে থাকে, বিজয়ের স্বপ্ন তত দ্রুত বাস্তবে রূপ নেয়।

২ ডিসেম্বর তাই শুধু একটি তারিখ নয়; এটি স্মরণ করিয়ে দেয় স্বাধীনতার মূল্য, ত্যাগের গভীরতা এবং বীরদের অগ্নিঝরা ইতিহাস। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব, অসংখ্য শহিদের রক্ত, মুক্তিযোদ্ধাদের দৃঢ়চেতা মনোবল এবং সাধারণ মানুষের আত্মত্যাগই জন্ম দিয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশকে। বিজয়ের মাসের এই দিনে ইতিহাস আমাদের জানায়—স্বাধীনতা কখনোই বিনা মূল্যে আসে না; আসে রক্তের বিনিময়ে, আসে সাহসের পরীক্ষায়, আসে জাতির সামষ্টিক আত্মত্যাগে। বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিকের কাছে ২ ডিসেম্বর তাই চিরস্মরণীয়, চিরগৌরবের দিন।

লেখক : মোহাম্মদ আলী সুমন, সাংবাদিক ও সংগঠক।

ট্যাগস
আপলোডকারীর তথ্য

জনপ্রিয় সংবাদ

অন্তর্বর্তী সরকার ও প্রধান উপদেষ্টার প্রতি মানুষের ব্যাপক আস্থা

SBN

SBN

ইতিহাসের এই দিনে… ২ ডিসেম্বর : মুক্তিযুদ্ধের অগ্নিঝরা দিন

আপডেট সময় ০৮:১৭:০৩ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২ ডিসেম্বর ২০২৫

মোহাম্মদ আলী সুমন

২ ডিসেম্বর, বিজয়ের মাসের দ্বিতীয় দিন। ১৯৭১ সালের এই দিনে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এক ভয়ংকর, নির্মম, তীব্র এবং আন্তর্জাতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে দাঁড়িয়ে পড়েছিল। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বুঝতে শুরু করেছিল যে তাদের পরাজয় এখন কেবল সময়ের অপেক্ষা, আর ঠিক সেই কারণেই তারা আরও বেপরোয়া, বর্বর ও হিংস্র হয়ে ওঠে। এদিন দেশজুড়ে চলতে থাকে নির্বিচার গণহত্যা, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ এবং গ্রাম–শহরে আতঙ্ক সৃষ্টির চেষ্টা। বিশেষ করে ঢাকায় কারফিউ জারি করে সাধারণ মানুষের চলাচল প্রায় অসম্ভব করে দেওয়া হয়, সাংবাদিক, শিক্ষক, ছাত্রনেতা, পেশাজীবী এবং সম্ভাব্য মুক্তিযুদ্ধ-সমর্থকদের টার্গেট করে তালিকা অনুযায়ী গ্রেফতার ও হত্যা করা হয়।

২ ডিসেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া সেক্টরে মুক্তিবাহিনী তিন দিক থেকে আক্রমণ করলে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী আজমপুর রেলওয়ে স্টেশন ছেড়ে পালিয়ে যায়। আজমপুর রেলওয়ে স্টেশন মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে এলেও পাকিস্তানি সৈন্যরা মুক্তিবাহিনীর ওপর পালটা আক্রমণ করে এবং আখাউড়া রেল স্টেশনে চলে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর প্রচণ্ড সম্মুখযুদ্ধ। পাকিস্তানিরা এই যুদ্ধে ট্যাংক ব্যবহার করে।

সম্মুখযুদ্ধে প্রকম্পিত হয়ে উঠে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া এলাকা। সঙ্গে সঙ্গে আখাউড়াসংলগ্ন আগরতলা শহরও কেঁপে ওঠে। কসবা থেকে মুকুন্দপুর আর আখাউড়া থেকে উজানিসার পর্যন্ত তিন দিনের যুদ্ধে মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানিদের ধরাশায়ী করে ফেলে। কুমিল্লা-সিলেট সিঅ্যান্ডবি রোডের সংযোগ মুক্তিযোদ্ধারা বিচ্ছিন্ন করে দেয় এবং চট্টগ্রাম-কুমিল্লা-ঢাকা রেল যোগাযোগও সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তিন দিনের যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি সৈন্যদের অবরুদ্ধ করে রাখে এবং অনেক পাকিস্তানি সৈন্য হতাহত হয়।

সিলেটের গুরুত্বপূর্ণ শমসেরনগর বিমানবন্দর মুক্তিবাহিনী সম্পূর্ণ দখল করে নেয়। মুক্তিবাহিনী ঘোড়াশালে পাকিস্তানি সৈন্যদের শক্ত অবস্থানের ওপর চারদিক থেকে একযোগে আক্রমণ করে অনেক পাকিস্তানি সৈন্যকে হতাহত করতে সক্ষম হয় এবং এখান থেকে বেশকিছু গোলাবারুদ উদ্ধার করে মুক্তিবাহিনী।

এ দিন চট্টগ্রামে মুক্তিবাহিনী উত্তরে ফটিকছড়ি ও রাউজান থানা এবং দক্ষিণে আনোয়ারার অধিকাংশ স্থান তাদের নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়। নোয়াখালী থেকে চট্টগ্রামের পথে পথে মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা হানাদারদের সঙ্গে খণ্ড খণ্ডভাবে সম্মুখযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে।

সীমান্ত এলাকাগুলোতে সংঘাত তীব্র আকার ধারণ করলে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে যোগ দেয় ভারতীয় বাহিনী। বীর মুক্তিযোদ্ধারা ভারতীয় সেনাবাহিনীর সহায়তায় গভীর রাতে বাংলাদেশের সবচেয়ে উত্তরে অবস্থান পঞ্চগড়ে ক্ষীপ্রগতিতে আকস্মাৎ আক্রমণ করে পঞ্চগড় মুক্ত করে নেয় এবং ঠাকুরগাঁওয়ের দিকে বিজয়ের বেশে এগিয়ে যেতে থাকে।

মুক্তিযোদ্ধাদের হামলায় ও বোমা বিস্ফোরণে ঢাকার রামপুরা বিদ্যুৎ সরবরাহ কেন্দ্র, চট্টগ্রামের পাঁচটি বিদ্যুৎ সাব-স্টেশন ও দুটি পেট্রোল পাম্প বিধ্বস্ত হয়। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম মুক্তিবাহিনীর এই সাফল্যের খবর গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করে। বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকা, আকাশবাণী ও স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের সংবাদে প্রচারিত হতে থাকে মুক্তিযোদ্ধাদের নিত্য নতুন বিজয়ের সংবাদ।

খুলনা অঞ্চলে লেফটেন্যান্ট জিয়াউদ্দিনের নেতৃত্বাধীন মুক্তিবাহিনী সুন্দরবনের বিস্তীর্ণ এলাকা আগেই শত্রুমুক্ত করেছিল এবং পাকিস্তানি সেনাদের পিছু হটিয়ে মুক্তিবাহিনী সাতক্ষীরার উপকণ্ঠে পৌঁছে যায়। রূপসা নদীর ওপারে খুলনার কাছে ঘাঁটি স্থাপন করে মুক্তিযোদ্ধাদের আরেকটি দল।

এদিকে মুক্তিযোদ্ধারা টাঙ্গাইলের নাগরপুর থানা মুক্ত করে এবং টাঙ্গাইল আক্রমণের প্রস্তুতি নিতে থাকে। একাত্তরের এই দিনে ময়মনসিংহ, জামালপুরসহ দেশের বেশ কয়েকটি এলাকায় গণহত্যা চালায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী। মুক্তিযোদ্ধারা রাজধানী ঢাকাকে দখলমুক্ত করার লক্ষ্যে আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখ যুদ্ধ করে করে ঢাকার দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে যেতে থাকে।

ঢাকাসহ বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে পাক সেনারা এবং তাদের দোসর রাজাকার–আলবদররা শত শত নিরীহ মানুষকে গুলি করে হত্যা করে, ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয় এবং বিভিন্ন কৌশলগত স্থানে মাইন পেতে রাখে যাতে মুক্তিযোদ্ধাদের অগ্রযাত্রা বাধাগ্রস্ত হয়। কিন্তু বাঙালির মনোবল ভাঙতে পারেনি এই বর্বরতা।

এই সময় বাংলাদেশের বিভিন্ন সেক্টরে মুক্তিযোদ্ধারা চালিয়ে যান সবচেয়ে সাহসী ও কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ সব অভিযান। ২ ডিসেম্বর সেক্টর–২, সেক্টর–৩, সেক্টর–৭ এবং সেক্টর–১১–এ মুক্তিবাহিনী পাক ঘাঁটি দখল করে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করে। একই দিনে পূর্বাঞ্চলের আকাশসীমায় ভারতীয় বিমানবাহিনী পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে পাকিস্তানি বাহিনীর সাপ্লাই লাইন ভেঙে দেয়। এদিনই ভারত সরকার বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়, যা আন্তর্জাতিক মহলে মুক্তিযুদ্ধের সঠিকতা, নৈতিক বৈধতা ও স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষাকে আরও দৃঢ় করে। ভারতের স্বীকৃতি যুদ্ধক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল বাড়িয়ে দেয়, কারণ এতে নিশ্চিত হয়-দেশটি আর বিচ্ছিন্ন নয়, বাংলাদেশের জন্ম এখন বৈশ্বিকভাবে স্বীকৃত একটি বাস্তবতা।

এই ২ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখন পাকিস্তানের কারাগারে অন্ধকারে বন্দী। কিন্তু বন্দিত্ব তাঁর নেতৃত্বকে থামাতে পারেনি, তাঁর আহ্বানকে স্তব্ধ করতে পারেনি। তাঁর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ তখনো ছিল প্রতিটি মুক্তিযোদ্ধার বুকের ভেতর জ্বলন্ত মশাল। “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম”—এই ঘোষণাই যুদ্ধের প্রতিটি রণাঙ্গনে বাঙালিকে দিকনির্দেশনা দিচ্ছিল। বঙ্গবন্ধু ছিলেন স্বাধীনতার নকশাকার, মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক, এই জাতির চূড়ান্ত প্রেরণা। তাঁর মুক্তির আন্দোলন, রাজনৈতিক সংগ্রাম, বৈশ্বিক কূটনৈতিক অবস্থান স্পষ্ট করেই জানিয়ে দিয়েছিল—বাংলাদেশের জন্ম রুদ্ধ করা যাবে না। পাকিস্তান কারাগারে থেকেও তিনি হয়ে উঠেছিলেন বাঙালির স্বাধীনতার প্রতীক।

২ ডিসেম্বর শহিদদের আত্মত্যাগের রক্তে রঞ্জিত ছিল বাংলাদেশের মাটি। বীর মুক্তিযোদ্ধারা লড়েছেন গেরিলা কৌশল, মুখোমুখি যুদ্ধ, রাত্রিকালীন আক্রমণ এবং বিস্ফোরণ অভিযানে। শত শত অজ্ঞাতনামা মানুষ শহিদ হন; কেউ ছিলেন কৃষক, কেউ ছিলেন শিক্ষক, কেউ ছাত্র, কেউবা স্রেফ গ্রামবাসী। কিন্তু ত্যাগের সেই দীর্ঘ সারিতে নামের পার্থক্য ছিল না—সকলেই ছিলেন দেশের জন্য জীবনদানকারী বীর। একদিকে পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বরতা, অন্যদিকে বাঙালির অদম্য সাহস—দুইয়ের দ্বন্দ্বে স্বাধীনতার সূর্য আরও কাছে চলে আসে। ডিসেম্বরের দিনগুলো যত এগোতে থাকে, বিজয়ের স্বপ্ন তত দ্রুত বাস্তবে রূপ নেয়।

২ ডিসেম্বর তাই শুধু একটি তারিখ নয়; এটি স্মরণ করিয়ে দেয় স্বাধীনতার মূল্য, ত্যাগের গভীরতা এবং বীরদের অগ্নিঝরা ইতিহাস। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব, অসংখ্য শহিদের রক্ত, মুক্তিযোদ্ধাদের দৃঢ়চেতা মনোবল এবং সাধারণ মানুষের আত্মত্যাগই জন্ম দিয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশকে। বিজয়ের মাসের এই দিনে ইতিহাস আমাদের জানায়—স্বাধীনতা কখনোই বিনা মূল্যে আসে না; আসে রক্তের বিনিময়ে, আসে সাহসের পরীক্ষায়, আসে জাতির সামষ্টিক আত্মত্যাগে। বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিকের কাছে ২ ডিসেম্বর তাই চিরস্মরণীয়, চিরগৌরবের দিন।

লেখক : মোহাম্মদ আলী সুমন, সাংবাদিক ও সংগঠক।