সোনালি শরতের মৌসুমে,চীনের দক্ষিণ-পশ্চিমের ইউননান প্রদেশের পাওশান শহরের লংচিয়াং উপজেলা পরিণত হয়, বছরের সবচেয়ে কবিতাময় ঋতুর দেশে। ফসল কাটা শেষে, ধানক্ষেতের ধারে সোনালি রঙের খড়ের গাদা সারি সারি দাঁড়িয়ে থাকে, দূরের পাহাড়ের নীলচে রেখা দিগন্তে মিশে যায়।
ধানক্ষেতকে জানালা আর পাহাড়-নদীকে ছবির মতো ফ্রেম করে রাখা একটি গ্রামের ক্যাফেতে বসে যখন এক খাঁটি পাওশান ছোট দানার কফিতে চুমুক দেওয়া হয়, তখন একধরনের তৃপ্তি মনের ভেতর ছড়িয়ে পড়ে এটাই লংচিয়াং উপজেলার ‘এক ক্ষেতে বহু ফসল’ শীর্ষক সবুজ উন্নয়ন মডেলের আধুনিক ও ঐতিহ্যের মিলনের এক জীবন্ত প্রতিচ্ছবি।
গ্রামীণ পুনরুজ্জীবনের যাত্রায়, কীভাবে পরিবেশ রক্ষা ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের সমন্বয় ঘটানো যায়, সেটাই এখন অনেক গ্রামের মূল চিন্তা। লংচিয়াং উপজেলা ‘ধান + মাছ + অর্থকরী ফসল + পর্যটন’-ভিত্তিক একটি সমন্বিত ইকো-চাষ ও উন্নয়ন মডেল গড়ে তুলে সেই প্রশ্নেরই উত্তর দিয়েছে।
প্রতিবছর মে-জুনে, যখন ধানের ফুল ফোটে, গ্রামবাসীরা ধানক্ষেতে মাছের পোনা ছেড়ে দেয়। ধানের ফুল ও পোকামাকড় খেয়ে, ধানক্ষেতের জলে বেড়ে ওঠা ‘ধানফুল মাছ’ হয় একেবারে প্রাকৃতিক খাদ্য—মাংস নরম, স্বাদ দুর্দান্ত আর কাদামাটির গন্ধহীন। অক্টোবরের ফসল কাটার আগে এই মাছ সংগ্রহ করা হয়, জীবন্ত অবস্থায় বা শুকিয়ে বিক্রি করা হয়; দামও সাধারণ মাছের কয়েকগুণ বেশি। ধান কাটার পর জমি ফাঁকা থাকে না—গ্রামবাসীরা সেখানে সরিষা, ডালসহ নানান অর্থকরী ফসল ফলান। এভাবেই ‘জমি থাকে না অব্যবহৃত, উত্পাদন চলে সারাবছর’।
এই মডেলের মূল দর্শন হলো প্রকৃতি-নির্ভর পদ্ধতি-স্থানীয় সম্পদ ও পরিবেশের ওপর ভিত্তি করে, ‘ধান-মাছ সহাবস্থান, শস্য-অর্থকরী ফসল পর্যায়ক্রম’-এর এক বহুমাত্রিক কৃষি কাঠামো তৈরি করা। ধানক্ষেত মাছকে দেয় আশ্রয় ও খাদ্য, মাছ ধানকে দেয় সার, পোকা দমন ও মাটির কোমলতা; আর পর্যায়ক্রমে অর্থকরী ফসল মাটির উর্বরতা পুনরুদ্ধার করে, রোগ-পোকা কমায়। ফলে, গঠিত হয় এক বন্ধ চক্রের পরিবেশবান্ধব কৃষিব্যবস্থা, যা একদিকে কীটনাশক ও রাসায়নিক সার ব্যবহারের প্রয়োজন কমায়, অন্যদিকে জমির সামগ্রিক উত্পাদনশীলতা বাড়ায়—এক ক্ষেতে ‘হাজার কেজি ধান, একশ কেজি মাছ, এবং অতিরিক্ত অর্থকরী ফসল’—এইভাবে মানুষ ও প্রকৃতি, উত্পাদন ও পরিবেশের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে এক সুন্দর ভারসাম্য।
আধুনিক প্রযুক্তি ও বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনা এই ঐতিহ্যবাহী কৃষিতে এনে দিয়েছে নতুন প্রাণ। লংচিয়াং গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করে চারা উত্পাদন, মাছের পোনা ছাড়া থেকে শুরু করে রোগপোকা নিয়ন্ত্রণ পর্যন্ত, পুরো প্রক্রিয়ার মান নির্ধারণ করা হয়েছে। এতে কৃষিপদ্ধতি ‘অভিজ্ঞতানির্ভর’ থেকে ‘মানসম্মত ও বৈজ্ঞানিক’ পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। ফলে ধানের উত্পাদন বেড়েছে, ধানফুল মাছ ও অর্থকরী ফসলের মানও উন্নত হয়েছে। আগের ‘দুর্বল জমি’ পরিণত হয়েছে ‘উর্বর জমিতে’; ‘এক ক্ষেতে বহু ফসল’ এখন আর স্বপ্ন নয়, বাস্তবায়িত ও পুনরুত্পাদনযোগ্য এক মডেল।
লংচিয়াং জেলা শুধু কৃষিপণ্য উত্পাদনেই থেমে থাকেনি; তারা পণ্য প্রক্রিয়াকরণ ও মূল্য সংযোজনেও মনোযোগ দিয়েছে। ‘হং শি রুয়ান’ (লাল ও নরম) চাল ও শুকনো ধানফুল মাছের মতো স্থানীয় ব্র্যান্ড তৈরি করে তারা ‘গ্রামীণ পণ্য’-কে ‘বিশেষ পণ্য’-এ রূপান্তর করেছে, বাজারে প্রতিযোগিতা ও মূল্য বৃদ্ধি করেছে। আরও গুরুত্বপূর্ণ হলো, তারা কৃষি ও পর্যটনের সংযোগ ঘটিয়েছে-‘ধানফুল মাছ উত্সব’, ‘মাছ ধরা উত্সব’ ইত্যাদি আয়োজনের মাধ্যমে, কৃষি সংস্কৃতি ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে পর্যটনের সম্পদে পরিণত করেছে। ধানক্ষেতের মাঝে ছড়িয়ে থাকা ক্যাফেগুলো এখন লংচিয়াং-র নতুন আকর্ষণ—বসন্তে দেখা যায় সবুজ চারা, গ্রীষ্মে দুলে ধানের ঢেউ, শরতে সোনালি ফসল, শীতে শান্ত সৌন্দর্য। এই ‘ধানক্ষেত কফি অভিজ্ঞতা’ শুধু পর্যটকদের অবস্থানকাল বাড়ায় না, স্থানীয় পণ্যের প্রদর্শনীরও জানালা খুলে দেয়—ফলে ‘কৃষি দিয়ে পর্যটনকে শক্তিশালী করা, পর্যটন দিয়ে কৃষিকে সমৃদ্ধ করা’-এ এক প্রকৃত ইতিবাচক চক্র।
লংচিয়াং উপজেলার অভিজ্ঞতা প্রমাণ করে, গ্রামীণ পুনরুজ্জীবন মানে শহরের পথ অনুকরণ নয়, বরং স্থানীয় বাস্তবতা ও পরিবেশগত যুক্তিকে কেন্দ্র করে সৃজনশীল পরিবর্তন আনা। তাদের সাফল্যের রহস্য বাইরের বিনিয়োগ বা প্রকল্প নয়, বরং অভ্যন্তরীণ শক্তিকে জাগিয়ে তোলা—প্রকৃতির সঙ্গে সহাবস্থান, ঐতিহ্য ও আধুনিকতার মেলবন্ধন। বৈজ্ঞানিক পরিকল্পনা, পণ্যের মানোন্নয়ন, কৃষি-পর্যটনের সংহতি—এসবের মাধ্যমে লংচিয়াং উপজেলা একসঙ্গে অর্জন করেছে পরিবেশ সংরক্ষণ, কৃষকের আয়বৃদ্ধি ও সংস্কৃতি সংরক্ষণ।
তাদের ‘এক ক্ষেতে বহু ফসল’ মডেল আজ চীনের অন্যান্য গ্রামীণ অঞ্চলের জন্য এক অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছে-প্রকৃতিকে সম্মান করা, প্রজ্ঞাকে কাজে লাগানো, মাটির সঙ্গে সংযুক্ত থাকা—এই তিন পথেই কেবল ‘আশার মাঠে’ লেখা যায় আরও সমৃদ্ধ ও টেকসই ভবিষ্যতের গল্প।
সূত্র:শিশির-আলিম-মুক্তা,চায়না মিডিয়া গ্রুপ।
সম্পাদক ও প্রকাশক: কামরুজ্জামান জনি
Copyright © 2025 Muktirlorai | মুক্তির লড়াই. All rights reserved.