চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং ১৩ অক্টোবর, সোমবার সকালে, বেইজিং জাতীয় সম্মেলন কেন্দ্রে বিশ্ব নারী শীর্ষ-সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন এবং ‘বেইজিং বিশ্ব নারী সম্মেলনের চেতনা লালন করে নারীর সামগ্রিক উন্নয়নের নতুন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করুন’ শীর্ষক মূল বক্তব্য প্রদান করেন।
সি চিন পিং উল্লেখ করেন যে, নারী হল মানব সভ্যতার গুরুত্বপূর্ণ স্রষ্টা, প্রেরণাদাতা ও বাহক। নারী উন্নয়ন এগিয়ে নেওয়া আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সম্মিলিত দায়িত্ব। ৩০ বছর আগে, বেইজিং বিশ্ব নারী সম্মেলন ‘সমতা, উন্নয়ন ও শান্তির জন্য পদক্ষেপ’ গ্রহণের মহৎ লক্ষ্য নির্ধারণ করে, মাইলফলক-স্বরূপ বেইজিং ঘোষণা ও কার্যকরী কৌশলপত্র গৃহীত হয়, যা যুগের এজেন্ডায় লিঙ্গসমতা প্রতিষ্ঠা করে এবং সারা বিশ্বের মানুষকে এর জন্য নিরলস প্রচেষ্টায় অনুপ্রাণিত করে। গত ৩০ বছরে, বেইজিং বিশ্ব নারী সম্মেলনের চেতনার আলোকে, বিশ্বব্যাপী নারী উন্নয়ন প্রসার লাভ করেছে, যা মানব সভ্যতার অগ্রগতিতে উজ্জ্বল রং যোগ করেছে। নারী-পুরুষের সমতা অর্জন ইতিমধ্যে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সাধারণ ঐকমত্যে পরিণত হয়েছে, নারী ক্ষমতায়নে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে, নারী শিক্ষার স্তর ক্রমাগত উন্নত হচ্ছে এবং তারা অর্থনীতি, রাজনীতি, সংস্কৃতি ও সামাজিক জীবনে আরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। প্রতিভাবান নারীরা এখন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সক্রিয়ভাবে অংশ নিচ্ছেন, জীবনের বর্ণাঢ্য অধ্যায় রচনা করছেন এবং তাদের জ্ঞান ও শক্তি দিয়ে অবদান রাখছেন।
তিনি জোর দিয়ে বলেন যে, বর্তমানে নারীর সামগ্রিক উন্নয়ন এখনো জটিল চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি, নারী-পুরুষের সমতা অর্জন এখনও একটি দীর্ঘ পথের ব্যাপার। ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে, সকল পক্ষকে বেইজিং বিশ্ব নারী সম্মেলনের প্রাথমিক উদ্দেশ্য পুনর্বিবেচনা করতে হবে, যাতে নারীর সামগ্রিক উন্নয়নের নতুন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করার জন্য ব্যাপকতর ঐকমত্য গড়ে তোলা, ব্যাপকতর পথ উন্মুক্ত করা এবং আরও বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ নেওয়া যায়। এ লক্ষ্যে তিনি চারটি প্রস্তাব পেশ করেন:
প্রথমত, নারীর বৃদ্ধি ও উন্নয়নের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে যৌথ প্রচেষ্টা চালানো। সম্মিলিত, সমন্বিত, সহযোগিতামূলক ও টেকসই নিরাপত্তা ধারণা লালন করে বিশ্ব শান্তি রক্ষা করতে হবে। সংঘাত, দারিদ্র্য ও দুর্যোগপ্রবণ অঞ্চলের নারী ও কন্যাশিশুদের সুরক্ষা জোরদার করতে হবে। সহিংসতা প্রতিরোধ ব্যবস্থা সম্পূর্ণকরণ ও উন্নত করতে হবে, নারীর বিরুদ্ধে সব ধরনের সহিংসতা দৃঢ়ভাবে নির্মূল করতে হবে।
দ্বিতীয়ত, উচ্চমানের নারী উন্নয়নের জন্য চালিকা শক্তি লালন করতে সমন্বিত প্রচেষ্টা চালানো। বিশ্বে নারী উন্নয়নের ভারসাম্যহীন সমস্যা সমাধানে মনোযোগ দিতে হবে, যাতে সকল নারী বিশ্বায়নের অর্থনৈতিক ফলাফল ভোগ করতে পারেন। প্রযুক্তি উদ্ভাবন দিয়ে নারীদের উচ্চমানের উন্নয়নকে শক্তিশালী করতে হবে, বিশ্ব আধুনিকীকরণের স্রোতে বিপুল সংখ্যক নারীদের সুন্দর জীবন ও স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে সহায়তা করতে হবে।
তৃতীয়ত, নারীর অধিকার সুরক্ষার শাসন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে যৌথ প্রচেষ্টা চালানো। সংশ্লিষ্ট ব্যবস্থা ও আইন সম্পূর্ণ করতে হবে, যাতে আরও বেশি উচ্চমানের স্বাস্থ্য ও শিক্ষা সম্পদ সকল নারীর কাছে পৌঁছায়, এবং নারীদেরকে আরো ব্যাপকভাবে ও সমানভাবে বিভিন্ন অধিকার ভোগ করতে সহায়তা করতে হবে। সহিষ্ণু ও সমন্বিত সামাজিক পরিবেশ তৈরি করতে হবে, নারীর রাজনীতি ও সরকারি বিষয়ে অংশগ্রহণের পথ সম্প্রসারণ করতে হবে, রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক শাসনে নারীর ব্যাপক অংশগ্রহণ সমর্থন করতে হবে, যাতে লিঙ্গসমতা সত্যিকার অর্থে সমাজের সভ্যতার ঐকমত্য ও আচরণের মানদণ্ডে পরিণত হয়।
চতুর্থত, বিশ্বব্যাপী নারী সহযোগিতার নতুন অধ্যায় রচনায় যৌথ প্রচেষ্টা চালানো। যুগের দায়িত্ব নেওয়ার ক্ষেত্রে নারীদের সমর্থন করতে হবে, বিশ্ব শাসনে গভীরভাবে অংশগ্রহণ ও সুশাসনের ফলাফল ভাগ করে নেওয়ার সুযোগ দিতে হবে। জাতিসংঘকে তার কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালনে সমর্থন দিতে হবে, উন্নয়নশীল দেশগুলোর নারীদের প্রয়োজনের প্রতি আরও বেশি মনোযোগ দিতে হবে, বিভিন্ন দেশের নারীদের জন্য বিশস্ত সহযোগিতা মঞ্চ তৈরি করতে হবে, যাতে সৌন্দর্য্যপূর্ণ ও সমন্বিত জীবন পরিবেশ সৃষ্টি হয়।
প্রেসিডেন্ট সি উল্লেখ করেন যে, চীন নারী উন্নয়নকে চীনা শৈলীর আধুনিকীকরণের প্রক্রিয়ার সাথে একীভূত করেছে, নারী উন্নয়নে ঐতিহাসিক সাফল্য অর্জিত হয়েছে এবং ঐতিহাসিক পরিবর্তন ঘটেছে, চীনের নারীরা অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে সত্যিকারের ‘অর্ধেক আকাশে’র ভূমিকা পালন করছে। চীন সক্রিয়ভাবে তার নিজস্ব উন্নয়নের মাধ্যমে বিশ্ব নারী উন্নয়নের জন্য সুযোগ ও নিশ্চয়তা প্রদান করছে, আন্তর্জাতিক নারী বিনিময় ও সহযোগিতা এগিয়ে নিচ্ছে। আগামী ৫ বছরে, চীন পুনরায় জাতিসংঘ নারী সংস্থাকে ১০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার দান করবে; বিশ্ব উন্নয়ন ও দক্ষিণ-দক্ষিণ সহযোগিতা তহবিল থেকে ১০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের তহবিল বরাদ্দ করবে, নারী ও কন্যাশিশু উন্নয়ন সহযোগিতা প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সাথে সহযোগিতা করবে; গণজীবন উন্নয়ন ক্ষেত্রে ১ হাজারটি ‘ছোট কিন্তু সুন্দর’ প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে; ৫০ হাজার নারীকে চীন সফর ও প্রশিক্ষণের জন্য আমন্ত্রণ জানাবে; ‘বিশ্ব নারী দক্ষতা গঠন কেন্দ্র’ প্রতিষ্ঠা করবে, আরও বেশি চমত্কার নারী প্রতিভা লালন করবে।
তিনি শেষে জোর দিয়ে বলেন যে, নতুন ঐতিহাসিক সূচনায় দাঁড়িয়ে, চীন সকল পক্ষের সাথে একত্রিত হয়ে, বেইজিং বিশ্ব নারী সম্মেলনের চেতনা ধারণ ও লালন করে, মানব জাতির অভিন্ন লক্ষ্যের কমিউনিটি গঠনের লক্ষ্যে, নারীর সামগ্রিক উন্নয়নের নতুন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করতে এবং মানবতার আরও সুন্দর ভবিষ্যত একসাথে সৃষ্টি করতে প্রস্তুত।
আইসল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট টমাসডোটির, ডোমিনিকার প্রেসিডেন্ট বার্টন, ঘানার প্রেসিডেন্ট মাহামা, মোজাম্বিকের প্রধানমন্ত্রী ল্যাভি, শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী অমরাসুরিয়া, জাতিসংঘের উপমহাসচিব আমিনা, জাতিসংঘের উপমহাসচিব ও নারী সংস্থার নির্বাহী পরিচালক বাহুস দের উদ্বোদনী অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন। তারা প্রেসিডেন্ট সি’র গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্যের উচ্চ-প্রশংসা করেন, এই শীর্ষ সম্মেলন আয়োজনের জন্য চীনকে ধন্যবাদ জানান এবং চীনের পক্ষ থেকে উত্থাপিত উদ্যোগ ও ব্যবস্থাকে স্বাগত জানান। তারা জোর দিয়ে বলেন যে, ৩০ বছর আগে বেইজিং বিশ্ব নারী সম্মেলনে গৃহীত বেইজিং ঘোষণা ও কার্যকরী কৌশলপত্রের গুরুত্বপূর্ণ তাৎপর্য রয়েছে, যা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ব্যাপক স্বীকৃতি পেয়েছে এবং নারী উন্নয়ন এগিয়ে নেওয়ার জন্য একটি রোডম্যাপ। দারিদ্র্য দূরীকরণ, লিঙ্গ সমতা অর্জন, নারী অধিকার উন্নয়ন ইত্যাদি ক্ষেত্রে চীন অসাধারণ সাফল্য অর্জন করেছে এবং সমৃদ্ধ অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে, নিজেদের নারী উন্নয়ন সফলভাবে বাস্তবায়নের পাশাপাশি, স্পষ্ট দায়িত্ববোধ ও শক্তিশালী নেতৃত্ব দিয়ে বিশ্ব নারী উন্নয়নে জোরালো গতি যোগাচ্ছে। মানব সভ্যতা ও সামাজিক অগ্রগতিতে নারীদের অপরিহার্য ভূমিকা রয়েছে, লিঙ্গ সমতা ও নারী উন্নয়ন মানব সমাজ টেকসই উন্নয়নের চাবিকাঠি অংশ। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত এই শীর্ষ সম্মেলনকে নতুন সূচনা হিসেবে ধরে নিয়ে, বেইজিং বিশ্ব নারী সম্মেলনের চেতনা লালন করা, ঐক্য শক্তিশালী করা, সহযোগিতা গভীর করা, পরস্পরের কাছ থেকে শেখা এবং অভিজ্ঞতা বিনিময় করা, জাতিসংঘের ২০৩০ টেকসই উন্নয়ন এজেন্ডা বাস্তবায়নে সহায়তা করা এবং বিশ্ব নারী উন্নয়নে নতুন বিকাশ সাধন করা।
এদিন দুপুরে, প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং এবং তার স্ত্রী ফেং লি ইউয়ান অংশগ্রহণকারী আন্তর্জাতিক বিশিষ্ট অতিথিদের জন্য একটি স্বাগত ভোজের আয়োজন করেন।
সূত্র: স্বর্ণা-হাশিম-লিলি,চায়না মিডিয়া গ্রুপ।
সম্পাদক ও প্রকাশক: কামরুজ্জামান জনি
Copyright © 2025 Muktirlorai | মুক্তির লড়াই. All rights reserved.