মোঃ আবদুল আউয়াল সরকার:
একটি সভ্য,সহনশীল ও মানবিক সমাজ গঠনে বই পড়ার কোনো বিকল্প নেই।
যতদিন লেখাপড়ার প্রতি আকর্ষণ থাকে ততদিন মানুষ জ্ঞানী থাকে। আর যখনই তার ধারণা জন্মে যে, সে জ্ঞানী হয়ে গেছে, তখনই মূর্খতা তাকে ঘিরে ধরে।' সক্রেটিসের কথার প্রতিধ্বনি করেই বলতে চাই- জ্ঞানী হওয়ার একমাত্র পথ জ্ঞানান্বেষণ, আর এই জ্ঞানান্বেষণ তখনই পরিপূর্ণ হয়, যখন ব্যক্তির সঙ্গে বইয়ের যোগাযোগ বিরামহীন ও নিবিড় হয়।বিশ্বের যে দেশ যত উন্নত, সে দেশের মানুষের বই পড়ার অভ্যাস তত বেশি। উন্নত দেশগুলোর মানুষেরা চলার পথের সময়টুকু বই পড়ে কাটিয়ে দেন। বই পড়ার অভ্যাস নাকি সারা বিশ্বেই কমে যাচ্ছে। সাধারণ আড্ডায় বা সুধীজনের সমাবেশে এ রকম কথা প্রায়ই শোনা যায়। কথাটি মোটেও সত্য নয়। হয়তো পড়ার ধরন পাল্টেছে, উপকরণ পাল্টেছে, কিন্তু পড়ার অভ্যাস মানুষের কমেনি। বলছি সেই পাঠাভ্যাসের কথা যেটি মানুষ করে মনের আনন্দে, নিজের জ্ঞানের সীমা সম্প্র্রসারণ করতে এবং জীবন ও জগৎ সম্পর্কে জানতে। বিশ্বজগতের সৃষ্টিরহস্য, বিশ্বের ইতিহাস, জ্ঞান-বিজ্ঞানের অগ্রগতি, বিশ্বের সেরা চিন্তাবিদদের চিন্তা-ভাবনা, জীবন-দর্শন, রাজনীতি-অর্থনীতি-দর্শন জানতে হলে বই পড়তেই হবে।
বই মানুষের মনের পুষ্টি জোগায়, মনকে উদার ও মানবিক করে তোলে, জীবনের শাশ্বত সৌন্দর্য উপলব্ধি করতে এবং মানুষকে ভালোবাসতে শেখায়, তার জীবনকে করে পরিমার্জিত।
একটি ভালো বই হচ্ছে মানুষের শ্রেষ্ঠ সম্পদ। যার সাথে কোনো পার্থিব ধনসম্পদের তুলনা হতে পারে না। ধনসম্পদ একদিন শেষ হয়ে যেতে পারে, কিন্তু একটি কালজয়ী বইয়ের আবেদন কখনো ফুরাবার নয়।
যে জীবন বই বিমুখ, সে জীবন প্রকৃত অর্থে জীবনই নয়, বইহীন জীবন যেন প্রাণহীন দেহের মতোই মূল্যহীন। বই দূর ও কাছের মধ্যে, অতীত এবং ভবিষ্যতের সঙ্গে সাঁকো বেঁধে দেয়; সেই সাঁকোর সাহায্যে আমরা অবাধে জ্ঞানের জগতে প্রবেশ করতে পারি।নানা রকম পদ্ধতি অনুসরণ করে বই প্রকাশে সক্ষম হয় জ্ঞানপিপাসু মানুষ। একটি বই আমরা এখন যে অবস্থায় দেখি, সে অবস্থায় পেতে হাজার হাজার বছর আমাদের অপেক্ষা করতে হয়েছে। অসংখ্য মানুষের শ্রম ও মেধা যুক্ত হয়ে আছে গ্রন্থ আবিষ্কারের পেছনে। আমাদের আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান সংগত কারণেই তাই অতীত যুগের মানুষের কাছে ঋণী। এই ঋণ শোধ করে নয়, স্মরণ করেই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে।
একটি সভ্য, সহনশীল ও মানবিক সমাজ গঠনে বই পড়ার কোনো বিকল্প নেই। এ জন্য প্রতিটি পাড়ায়-মহলস্নায় ও গ্রামে পাঠাগার ও পাঠচক্র গড়ে তোলার আন্দোলন শুরু করা দরকার সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে। ই-বুকও অবশ্যই এর অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। এখন মোবাইল ফোনেও ই-বুক পড়া ও আদান-প্রদান করা যায় খুব সহজেই। বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজন সম্মিলিত উদ্যোগ। লেখকরা মননশীল ও বৈচিত্র্যময় লেখার মাধ্যমে তরুণদের আকৃষ্ট করবেন। প্রকাশনা সংস্থাগুলোকে আরও সহনশীল মূল্যে বই বিক্রির উদ্যোগ নিতে হবে। অভিভাবকরা বই পড়ার বিষয়ে উৎসাহিত করবেন সন্তানদের। এভাবে বই পড়াকে সামগ্রিক একটি সামাজিক আন্দোলনের রূপ দিতে হবে। পাঠক বইয়ের কাছে না গেলেও বইকে নিয়ে যেতে হবে পাঠকের নাগালের মধ্যে। স্টেশন, বাসস্ট্যান্ড থেকে শুরু করে বড় বড় বিপণিবিতানের মতো জনমানুষের প্রধান প্রধান বিচরণের জায়গাগুলোতে গড়ে তুলতে হবে বইয়ের দোকান কিংবা পাঠাগার। এ ক্ষেত্রে সরকারের ভূমিকা মোটেও কম নয়। বড় শপিং কমপেস্নক্সগুলোতে কয়েকটি বইয়ের দোকানের শর্ত জুড়ে দেওয়া যেতে পারে। এমনকি ছোট ছোট চায়ের দোকানকে কেন্দ্র করেও পাঠাগার ও পাঠচক্র গড়ে তোলা যেতে পারে। প্রত্যেক বছর স্কুল-কলেজগুলোতে সরকারি উদ্যোগে বইপড়া কর্মসূচি চালু করতে হবে। যেমন- নতুন শ্রেণিতে ছাত্রছাত্রীদের সরকারিভাবে পাঠ্যবই বিতরণের সময় অতিরিক্ত হিসেবে বিখ্যাত ব্যক্তিদের জীবনী, সাধারণ জ্ঞান ও বিজ্ঞান বিষয়ক যে কোনো একটি বই উপহার হিসেবে দেওয়া যেতে পারে। সভ্য ও শিক্ষিত সমাজে বই পড়ার গুরুত্ব অপরিসীম
পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে, সুস্থ ও সভ্য সমাজ গঠনে গ্রন্থ পাঠের গুরুত্ব অপরিসীম। পৃথিবীতে সভ্যতার ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায় যে, আলোকিত জীবন গঠনে বইয়ের ভূমিকা খুবই ব্যাপক এবং তাৎপর্যপূর্ণ। পাঠাভ্যাস জাতিকে মেধা ও মননশীল হিসেবে গড়ে তুলতে এক গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামকের ভূমিকা পালন করে থাকে। সহনশীল ও মানবিক সমাজ গঠনে বই পড়ার কোনো বিকল্প নেই।
লেখক:চিকিৎসা প্রযুক্তিবিদ,শিক্ষক ও গণমাধ্যমকর্মী।
সম্পাদক ও প্রকাশক: কামরুজ্জামান জনি
Copyright © 2024 Muktirlorai | মুক্তির লড়াই. All rights reserved.