এম. গোলাম মোস্তফা ভুইয়া
জননিরাপত্তা বিঘ্নিত হলে মানবাধিকারে আঘাত লাগে তা অনস্বীকার্য। লক্ষ্য করা যাচ্ছে, এ সরকারের সামনে এখন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অর্থাৎ জননিরাপত্তা নিশ্চিত করা অন্যতম চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমান সময়ে ‘মব জাস্টিস’ এখন নতুন আতঙ্কের নাম। উত্তেজিত হয়ে আইন বর্হিভূত বিচার বা মব জাস্টিস বা মব সহিংসতার সূত্রপাত হয়েছিল মূলত আফ্রিকার রাষ্ট্র উগান্ডায়। কয়েকটি বিচ্ছিন্ন ঘটনার মধ্য দিয়েই এই মব জাস্টিসের সূত্রপাত হয়েছিল। একপর্যায়ে তা গোটা উগান্ডায় ছড়িয়ে পড়ে এবং ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হয়। উগান্ডা পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৩ সালে দেশটিতে উত্তেজিত মবের হাতে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে ৪২৬টি। সেখান থেকে বেড়ে ২০১৯ সালে এভাবে প্রাণহানির সংখ্যা দাঁড়ায় ৭৪৬-এ। স্থানীয় বিভিন্ন সূত্রে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, উগান্ডায় মব সহিংসতার সূচনা হয়েছিল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠান ও বিচার ব্যবস্থার প্রতি দেশটির সাধারণ জনগণের অনাস্থা থেকে। পরে তা সারা দেশে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে ভয়াবহ আকার ধারণ করে।
২০২৪ এর গণআন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের ফ্যাসীবাদী শাসকের অবসান হবার পর পুলিশের ‘নিষ্ক্রিয়তার মধ্যে’ বিভিন্ন এলাকায় মানুষ একজোট হয়ে ‘নিজেরাই বিচার’ করে ফেলার যে প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, তা নিয়ে সমাজে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা তৈরি হয়েছে, যা ‘মব জাস্টিস’ নামে পরিচিতি পেয়েছে। এরই মধ্যে আবার এক শ্রেনীর ধর্মীয় উগ্রবাদি শক্তি ও ধর্মের নামে দেশের বিভিন্ন স্থানে সূফীদের দরবার, খানকাহ ও মাজারে হামলা করে ভাংচূর করেছে। বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায় প্রায় ৮০ টি মাজার ও দরবারে হামলা হয়েছে, ধ্বংস্তুপে পরিনত করা হয়েছে সেগুলো। এসম এমন দৃশ্যও দেখা গেছে ঐ মাজার ও মসজিদে হামলা ও অগ্নি সংযোগ করে হামলাকারীরা নিজেরা নামাজও পড়ছে। তা নিয়ে সমাজে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা তৈরি হয়েছে, যা ‘মব জাস্টিস’ নামে পরিচিতি পেয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকেও বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ জানানো হয়েছে, আইন কোনোভাবেই হাতে তুলে না দেওয়ার আহ্বানও জানানো হয়েছে। কিন্তু যারা এসব কাজ করছে, তাদের বিরুদ্ধে দ্রুত আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার দৃষ্টান্তও খুব একটা দেখা যাচ্ছে না।
এ বিষয়ে অপরাধ বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এসব ঘটনায় সমাজে বিশৃঙ্খলা তৈরী করছে, আইনের শাসনের প্রতি জনগনের অনীহা এবং ভবিষ্যতে ‘প্রতিশোধ গ্রহণের স্পৃহা ও সংকট’ তৈরী করতে পারে। যা রাষ্ট্র ও সমাজের জন্য কোনভাবেই শুভ কিছু বহন করে আনবে না, আনতে পারে না। তারা আরো মনে করেন, এ ধরনের ঘটনাগুলো বিচারিক প্রক্রিয়াকে ধ্বংস করবে। মানুষ যদি বিচারব্যবস্থাকেই বিশ্বাস না করে, নিজেরাই ‘মব জাস্টিস’ করতে থাকে, তাহলে বিচার ব্যবস্থার আর দরকার কী? এ কারণে যেকোনো মূল্যে এসব অতি উৎসাহী তৎপরতা বন্ধ করতে হবে।
গত প্রায় ছয় মাসে বাংলাদেশে চুরি, রাহাজানি বা ছিনতাইয়ের সঙ্গে জড়িত সন্দেহে অথবা পতিত ফ্যাসীবাদী সরকারের সহযোগী হিসেবে চিহ্নিত করে আইনের হাতে সোপর্দ না করে নির্মম ভাবে গণপিটুনি দিয়ে হত্যার ঘটনা ঘটেছে অনেকগুলো। একই সাথে এই সুযোগে ধর্মীয় উগ্রবাদী একটি গোষ্টি বিভিন্ন মাজার, দরগাহে হামলা করে হত্যা, লুন্ঠন, বাঙ্গচুর ঘটিয়েছে। আবার লোকজ সংস্কৃতির অংশ বাউল গান, লালন উৎসবে তৌহিদী জনতার নামে হামলা করে বন্ধ করে দিয়েছে। সরকারের বিভিন্ন সিদ্ধান্তকে মব দিয়ে চাপ প্রয়োগে বদলে ফেলার ঘটনাও ঘটানোর চেষ্টা করা হয়েছে। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মব দিয়ে জোরপূর্বক শিক্ষক বা প্রতিষ্ঠান প্রধানদের শ্লীলতাহানি, লাঠিপেটা, জুতাপেটা দিয়ে জোরপূর্বক পদত্যাগ বা চাকরিচ্যুত করার ঘটনাও ঘটেছে অনেকগুলো। হামলা ও ভাংচুর হয়েছে ভাস্কর্য, স্থাপনা, শিল্প-কারখানায়। অনেক শিল্পকারখানায় আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলার ঘটনাও ঘটেছে। ক্রীড়াঙ্গনেও রয়েছে মব সহিংসতার নজির। বন্ধ করে দেয়া হয়েছে নারী ফুটবল ম্যাচ। দেশের শীর্ষস্থানীয় কয়েকটি সংবাদমাধ্যমের সামনে অবস্থান, হামলা ও ভাংচুরের ঘটনা ঘটেছে। এভাবে একের পর এক মব জাস্টিসের ঘটনায় সাধারণ জনগণের মধ্যে এখন আতঙ্ক বাড়ছে। উদ্বেগ বাড়ছে অন্তর্বর্তী সরকারের নীতিনির্ধারকদের মধ্যেও। পুরো দেশময় চরম নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে মানুষ বাস করছে। গত মঙ্গলবার রাতে যে ভয়াবহ মব জাস্টিস ঘটেছে তাই অত্যান্ত বয়াবহ। আইনর্শংখলা রক্ষাকারি বাহিনীর সদস্যদের ছাড়া শুধু ছাত্র-জনতার নামে এভাবে যদি কারো বাড়িতে হামলা ও সার্চ করা হয় তাহলে জনমনে আতঙ্ক কি পরিমানে বৃদ্ধি পায় এটা কি সরকারের উপদেষ্টারা একবার চিন্তা করেছেন ? মব জাস্টিসের শিকার হচ্ছেন রাজনীতিবিদ, পুলিশ, শিক্ষক, আইনজীবী, চিকিৎসক থেকে শুরু করে চোর-ডাকাত-ছিনতাইকারীসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সর্বত্র এক ধরনের ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
এসব ঘটনা রীতিমতো নিজেকে মানুষ হিসাবে আতংকিত করেছে সকলকে। এর ফলে সাধারণ মানুষও পথে বের হতে ভয়পায়। খোদ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য পুলিশও একাকী কিংবা রাতের টহল দিতে ভয়পায় বলে জানা যায়। ৫ আগস্টের পর দেশটা প্রায় অনিয়ন্ত্রিত ভাবেই চলছে কেউ কাউকে মানছেনা। গত ছয় মাসে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সন্দেহভাজন অপরাধী, ছিনতাইকারী ও চাঁদাবাজ গ্রেপ্তার হলেও পরিস্থিতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলো। এ কারণে নাগরিকদের বড় একটি অংশ নিজেদের নিরাপদ ভাবতে পারছেন না।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ও অপরাধ বিজ্ঞানের অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন অভিমত প্রকাশ করেছেন যে, "দীর্ঘদিন ধরে মানুষের মধ্যে হতাশা ও বিচারহীনতার কারণে এই ‘মব জাস্টিস' চলছে৷ কিন্তু এখানে আমি দায়িত্বহীনতাও দেখতে পাই৷ এখন যে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়েছে, তারাও এই বিষয়ে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নিচ্ছে না৷ এই যে ছাত্ররা গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দিয়েছে৷ কোথাও কোথাও তাদের সংশ্লিষ্টতায়৷ আবার কোথাও কোথাও অতি উৎসাহী জনতার কারণে এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে ৷” অপরাধ বিশেজ্ঞরা মনে করেন, "গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে একটি সরকারের পতন হয়েছে৷ এখন কিছু লোক মনে করছেন, তারা যা খুশি তা-ই করতে পারবেন৷ আবার কোনো একটি গ্রুপ হয়তো পরিস্থিতি খারাপ করে পরিস্থিতি ঘোলাটে করতে চাইবে৷ কেউ কেউ আবার সুযোগ নিচ্ছেন৷ ফলে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে৷ পুলিশের ওপর ব্যাপক হামলার পর পুলিশও এখন আর তেমন সক্রিয় না৷ সরকারের উচিত হবে সেনাবাহিনীকে আরো অ্যাকটিভ করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা ৷”
ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম দিকেই একুশে বইমেলার একটি স্টলে হট্টগোল ও বাকবিতন্ডার ঘটনা ঘটেছে। এর আগে সামাজিক যোগাযোগ বাকবিতন্ডায় স্টলটির বিরুদ্ধে প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে এটিকে গুঁড়িয়ে দেয়ার আহ্বান জানিয়ে একাধিক পোস্ট দেয়া হয়। স্টলটিকে ঘিরে বাকবিতন্ডা ও হট্টগোলের ঘটনা ঘটেছে। বিষয়টি নিয়ে নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এ ধরনের বিশৃঙ্খল আচরণ বাংলাদেশে নাগরিকের অধিকার এবং দেশের আইন উভয়ের প্রতিই অবজ্ঞা প্রদর্শন করে উল্লেখ করে বিবৃতিতে তিনি জানান, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার পুলিশ এবং বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষকে ঘটনাটি তদন্ত করে দোষীদের বিচারের আওতায় আনার নির্দেশ দিয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা মাহফুজ আলম ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, ‘অভ্যুত্থানের পক্ষে হলে মব করা বন্ধ করেন। আর যদি মব করেন তাহলে আপনাদেরও ডেভিল হিসেবে ট্রিট করা হবে। আজকের ঘটনার পর আর কোনো অনুরোধ করা হবে না। আপনাদের কাজ না আইন নিজের হাতে তুলে নেয়া। কথিত আন্দোলন আর মবের মহড়া আমরা এখন থেকে শক্ত হাতে মোকাবেলা করব। রাষ্ট্রকে অকার্যকর ও ব্যর্থ প্রমাণের চেষ্টা করা হলে একবিন্দু ছাড় দেয়া হবে না।’
তিনি আরো লেখেন, ‘তৌহিদী জনতা! আপনারা দেড় দশক পর শান্তিতে ধর্ম ও সংস্কৃতি পালনের সুযোগ পেয়েছেন। আপনাদের আহাম্মকি কিংবা উগ্রতা সে শান্তি বিনষ্টের কারণ হতে যাচ্ছে। জুলুম করা থেকে বিরত থাকেন, নইলে আপনাদের ওপর জুলুম অবধারিত হবে।...জুলুম করবেন না, জুলুমের শিকারও হবেন না। এটাই আপনাদের কাছে শেষ অনুরোধ!’
বাংলাদেশে ঔপনিবেশিক কাল থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত ঘোষণা দিয়ে কেউ কখনও মাজার ভাঙেনি। এবার ঘোষণা দিয়ে আক্রমণ হয়েছে। অনেক জায়গায় একাধিকবার আক্রমণ হয়েছে এবং শাহপরাণে হামলায় একজনকে মেরে ফেলা হয়েছে। এসব ঘটনার দায়ভার ক্ষমতাসীন সরকার এড়াতে পারে না। বিশ্লেষকরা মনে করেন, এসব হামলার পেছনে যেমন ধর্মতাত্ত্বিক, দার্শনিক দ্বন্দ্ব-বিতর্ক রয়েছে; তেমনি বিভিন্ন শক্তি নিজেদের স্বার্থে এতে যুক্ত থাকতে পারে। সরকারের উপদেষ্টাদের দুর্বলতা, সব সিদ্ধান্ত ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়ার ফলেও এই ধরনের অবস্থা সৃষ্টি হচ্ছে। এর ফলশ্রুতিতে সামাজিক বিশৃঙ্খলা তৈরি হচ্ছে। এটা হামলাকারীরা বুঝতে পারছে না, নাকি বুঝে শুনে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করে ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের জন্য করছে তাও ভাবনাতে আনতে হবে। তারা রাষ্ট্র ও সমাজকে আরও অস্থিতিশীল করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। ফকির লালন, খালেক দেওয়ান, আব্দুল হালিম, রাধারমণ, আরকুম শাহসহ বিভিন্ন ফকির, দরবেশ, পীর, মুরশিদের গান শুনলে দেখা যাবে যে, সেখানে ধর্মতত্ত্বের গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক জিজ্ঞাসাগুলো তুলে ধরা হয়েছে। যে কারণে স্বভাবতই মানুষ এতে আকৃষ্ট হয়। এই তত্ত্বগুলো দাঁড় করানোর মধ্য দিয়ে যে নতুন চিন্তা হাজির হয়, তার সঙ্গে কথিত পরকালবাদীদের একটা দ্বন্দ্ব তৈরি হয়, বিশেষত যারা ধর্ম বলতে পরকালকেই বোঝে। তারা আক্রমণের শুরুতে গাঁজার কথা বলে, অথবা জমি নিয়ে বা আধিপত্য নিয়ে মারধর কিংবা দানের বাক্স কার কাছে আছে, এসব দ্বন্দ্ব এসে হাজির হয়। এটা বড় কোনো বিষয় ছিল না। তবে এখন এটিকে রাজনৈতিক রূপ দেওয়া হচ্ছে। কারণ, রাষ্ট্র এখন খুবই দুর্বল। সেই সঙ্গে মাজার প্রশ্নে রাষ্ট্রের কোনো পরিষ্কার ব্যাখ্যা নেই, রাষ্ট্র কীভাবে মাজার রক্ষা করবে, তা নিয়ে ফৌজদারি ব্যবস্থা ছাড়া পরিষ্কার কোনো বক্তব্য পাওয়া যাচ্ছে না।
আমাদের দেশের একটা শ্রেণি চায় না যে, মানুষের ভেতর যে প্রেমের চর্চা এতদিন ধরে হচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও হবে; সেই ধারাটা চলমান থাকুক। তারা নিজেদের জন্য একে হুমকিস্বরূপ মনে করে। মাজার শরিফ, আখড়া, আশ্রম, দরগা শরিফ–সেখানে সব সময় শুদ্ধচিন্তা, প্রেমের চর্চা হয়। সেখানকার সাঁই মানবতার মন্ত্রে দীক্ষিত, শিষ্যের ভেতরে সেটাই প্রতিষ্ঠিত করেন। যে নামেই ডাকুক, সব মানুষই এক স্রষ্টার সৃষ্টি। আমাদের দেশে শান্তির ধর্ম এসেছে ১০৫৩ সালে নেত্রকোনার মদনে শাহ মুহাম্মদ সুলতান কমরউদ্দিন রুমির (র.) মাধ্যমে। তিনি ওই অঞ্চলে মারফতি ঘরানার ইসলাম চর্চা করেন। এ ধারাটাই বাংলাদেশে শক্তিশালী। যারা এখন ক্ষমতায় আছে, দায়দায়িত্ব তাদের নিতে হবে। তারা জানে কোন কোন জায়গায় আঘাত আসতে পারে। তারা যদি আগে থেকে ঘোষণা দিত যে, মাজার কিংবা ধর্মীয় কোনো জায়গায় আঘাত করা যাবে না, তাহলে কিন্তু এমনটা হতো না। প্রধান উপদেষ্টা ঘোষণা দেওয়ার পরই কিন্তু মাজার ভাঙা কমে এসেছে। তিনি যদি প্রথম থেকেই বলতেন যে, এটা আমাদের ঐতিহ্য, এটা আমাদের জাতিগত পরিচয়ের জায়গা; তাহলে এ ধরনের ঘটনা ঘটতো না।
কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়, সবাই আইনের অধীন। অন্যকথায় আইনের চোখে সবাই সমান। আইনের দৃষ্টিতে সব নাগরিকের সমান অধিকারপ্রাপ্তির সুযোগকে আইনের শাসন বলে। আইনের দৃষ্টিতে সবাই সমান- এর অর্থ, জাতি-ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ-পেশা নির্বিশেষে আইনের সমান আশ্রয় লাভ করা। এর ফলে ধনী-দরিদ্র, সবল-দুর্বল সবাই সমান অধিকার লাভ করে। আইনের শাসনের প্রাধান্য থাকলে সরকার ক্ষমতার অপব্যবহার থেকে বিরত থাকবে এবং জনগণ আইনের বিধান মেনে চলবে। আইনের শাসনের গুরুত্ব অপরিসীম। আইন না থাকলে সমাজে অনাচার অরাজকতা সৃষ্টি হয়। আইনের শাসন অনুপস্থিত থাকলে নাগরিক স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, সামাজিক মূল্যবোধ, সাম্য কিছুই থাকে না। সাম্য, স্বাধীনতা ও মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আইনের শাসন অত্যাবশ্যক।
‘মব জাস্টিসে’র নামে নরপশুর ন্যায় নির্মমতা কখনোই সমর্থনযোগ্য নয়। আইন নিজের হাতে তুলে নেয়ার ক্ষেত্রে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে। কর্তৃত্ববাদী সরকারের পতনের পর নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষে রাষ্ট্রব্যবস্থাকে এখনও সম্পূর্ণ পুনর্গঠন করা সম্ভব হয়নি। ফলে একটি পক্ষ তাদের নিজেদের সুবিধার জন্য নানাবিধ অপরাধ কর্মে জনতাকে ব্যবহার করতে চাইছে। এই সরকারের শুরু থেকেই যেসব বিচারবহির্ভূত কাজ হয়েছে সেগুলোর অপরাধীরা এখনও বিচারের আওতায় আসেনি। এ কারণেই অপরাধীদের সাহস আরো বেড়ে গেছে। ঘটনায় সংশ্লিষ্টদের দ্রুত আইনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে এবং তখন কেউ আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার দুঃসাহস দেখাবে না বলে অনেকের বিশ্বাস।
গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে ফ্যাসিবাদী কায়দায় এ ধরনের হত্যাকাণ্ড কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও ‘মব-ভায়োলেন্সে’র মতো সব ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা ও উপাদানের শিগগিরই বিলোপ করতে হবে এবং নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের সূচনা করতে হবে। মনে রাখতে হবে কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয় এবং সব অপরাধের বিচারের দায়িত্ব আদালতের। যারা আইন নিজের হাতে তুলে নিচ্ছে তারা অপরাধ করছে এবং দেশকে অস্থিতিশীল করে তুলে কোনো অশুভ শক্তিকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। দেশজুড়ে মব জাস্টিজ, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, মাজার ও মন্দিরে হামলা ও ভাঙচুর জনমনে আতঙ্ক তৈরি করছে এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির জানান দিচ্ছে। ৫ আগস্টের পরও এমন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড প্রমাণ করে, ফ্যাসিবাদী সরকারের পতন হলেও ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র ও সরকার কাঠামো এবং ব্যবস্থা এখনো বহাল তবিয়তে আছে। একইসঙ্গে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উদাসীনতা এবং বিভিন্ন হামলার পরেও যথাযথ আইনি পদক্ষেপ না নেয়ার কারণে এ ধরনের মব-ভায়োলেন্সের পুনরাবৃত্তি ঘটছে।
পতিত সরকারের আমলেও একধরনের ‘মব জাস্টিস’ ছিল, বর্তমান সরকারের আমলে আরেক ধরনের ‘মব জাস্টিস’ চলছে। এটা কোনোভাবে চলতে পারে না। ‘মব জাস্টিস’ খোদ আদালত প্রাঙ্গণেও হয়েছে। বিভিন্ন স্থানে মাজার, দরবার, খানকায় হামলা হচ্ছে। আর এসব হামলার বিরুদ্ধে সরকার নির্দেশ দিয়েই চুপচাপ বসে আছে, কার্যকর কোনো পদক্ষেপ দৃশ্যমান হচ্ছে না। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বয়স দেড় মাস হতে চলল। দু-একটি ক্ষেত্র ছাড়া আমরা কোথাও সরকারের তেমন সক্রিয়তা দৃশ্যমান হচ্ছে না। বিশেষ করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি খুবই নাজুক। ‘মব-জাস্টিস’ গ্রহণযোগ্য নয় এবং কোনো সমাধানও আনবে না। আইনের মাধ্যমে জনগণের আকাঙ্খার প্রতিফলন ঘটাতে হবে। আইনের মাধ্যমেই সব হত্যাকাণ্ডের বিচার করতে হবে। এ অবস্থা বন্ধ করতে ব্যর্থ হলে ‘জুলাই-আগস্ট’ বিপ্লবের অপমৃত্যু ঘটতে বাধ্য।
(লেখক ঃ রাজনীতিক ও কলামিস্ট, মহাসচিব, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-বাংলাদেশ ন্যাপ ও চেয়ারপার্সন, ভয়েস অব কনসাস সিটিজেন-ভিসিসি)
E-mail : gmbhuiyan@gmail.com
সম্পাদক ও প্রকাশক: কামরুজ্জামান জনি
Copyright © 2025 Muktirlorai | মুক্তির লড়াই. All rights reserved.