মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের পক্ষ হতে দানকৃত সর্বোৎকৃষ্ট মাস রমাদান। একজন মুমিন মহান রবের অপার কৃপায় রহমত,বরকত, কল্যাণ ও মাগফিরাতে সিক্ত হয়ে জাহান্নামের ভয়াবহ আজাব হতে নিজেকে বাঁচানোর সুবর্ণ সুযোগ লাভ করে এ মহিমান্বিত মাসে। এর মর্যাদা এত বেশী হওয়ার অন্যতম কারণ এ মাসেই আল্লাহ তা’আলার নিকট হতে সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবি এবং রাসূল মুহাম্মদ -সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম- এর ওপর কুরআনুল কারিমে নাযিল হয়। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন : ‘‘রমাদান মাস, এতে মানুষের দিশারী এবং সৎপথের ¯পষ্ট নিদর্শন ও সত্যাসত্যের পার্থক্যকারীরূপে কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে। সুতরাং তোমাদের মধ্যে যারা এ মাস পাবে তারা যেন এ মাসের সিয়াম পালন করে’ (সূরা বাক্বারাহ: ১৮৫)।
ক. সিয়ামের পরিচয়:
‘সাওম’ আরবি শব্দ, ইহা একবচন, বহুবচনে ‘সিয়াম’ যা ফার্সীতে রোযা নামে পরিচিত। আভিধানিক অর্থ- বিরত থাকা, অবিরাম চেষ্টা করা, কঠোর সাধনা করা, আত্মসংযম করা, পানাহার থেকে বিরত থাকা, ইত্যাদি। ইসলামী শরী’আতের পরিভাষায়: রোযা পালনের নিয়্যাতে আল্লাহ তা’আলার নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে সুবহে সাদেক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার, স্বামী-স্ত্রী সহবাস ও সিয়াম ভঙ্গকারী বিষয়সমূহ থেকে বিরত থাকা-কে সাওম বলে ।
খ. সিয়ামের হুকুম:
প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক, সুস্থ মস্তিস্ক সম্পন্ন, মুকীম মুসলিম নর-নারীর ওপর রমাদান মাসের সিয়াম পালন করা করা ফরজ। আল্লাহ তা’আলার ভাষায়: “তোমাদের ওপর রোযা ফরজ করা হয়েছে, যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর”(সূরা বাক্বারাহ: ১৮৩)।
গ. সিয়ামের উদ্দেশ্য:
সিয়ামের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য হলো আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের আদিষ্ট বিষয়গুলোর পালন এবং নিষিদ্ধ বিষয়গুলো বর্জনের মাধ্যমে তাকওয়ার গুণাবলী অর্জন করে মহান রবের সন্তুষ্টি লাভ করা। যেমন- আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন: “হে মুমিনগণ! তোমাদের ওপর সিয়াম ফরজ করা হয়েছে, যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর যাতে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পার” (সূরা বাক্বারাহ: ১৮৩)।
ঘ. সিয়ামের ফরজ:
১. নিয়্যাত করা
২. নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পানাহার, স্বামী-স্ত্রীর জৈবিক চাহিদা পূরণ ও সাওম ভঙ্গকারী সকল বিষয় হতে বিরত থাকা। কুরআনুল কারিমের ভাষায়: “এখন তোমরা নিজ স্ত্রীদের সাথে মিলিত হও হতে পার এবং আল্লাহ তোমাদের জন্য যা কিছু লিখে রেখেছেন তা (সন্তান) তালাশ কর। আর পানাহার কর যতক্ষণ না রাতের কালো রেখা থেকে ভোরের শুভ্র রেখা পরিস্কারভাবে ফুটে উঠে। অতঃপর রাতের আগমন পর্যন্ত সিয়াম পূর্ণ কর” (সূরা বাক্বারাহ: ১৮৭)।
ঙ. সাওম ফরজ হওয়ার হেকমত:
ইসলামী শরি’আতে সাওম বা রোযার বিধান প্রবর্তনের ক্ষেত্রে অনেক হেকমত ও উপকারিতা রয়েছে। তন্মধ্যে অন্যতম হলোÑ
১. সিয়াম সাধনার মাধ্যমে তাকওয়া বা আল্লাহভীতি অর্জিত হয়।
২. ইহা মহান রবের নৈকট্য ও সন্তুষ্টি লাভের অন্যতম মাধ্যম।
৩. এর মাধ্যমে আল্লাহ তা’আলার অফুরন্ত রহমত লাভ করা যায়।
৪. জাহান্নাম থেকে মুক্তির উপায়।
৫. সিয়ামের দ্বারা ব্যক্তির চরিত্র বিধ্বংসী কুপ্রবৃত্তির দমন হয়।
৬. সাওম দ্বারা ব্যক্তির চক্ষু, কর্ণ, জিহ্বা ও লজ্জাস্থান প্রভৃতি নিয়ন্ত্রিত থাকে।
৭. আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জিত হয়।
৮. শরীরের জন্য ক্ষতিকর জিনিসগুলো ধ্বংসের মাধ্যমে শারীরিক সুস্থতা আনয়ন করে।
৯. সাওম দ্বারা অন্তরের যাবতীয় কুটিলতা দূর হয়।
১০. রোযাদার-কে যাবতীয় খারাপ কাজ ও আচরণ হতে বিরত থাকতে অভ্যস্ত করে তোলে।
১১. শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে হেফাজত করে।
১২. সিয়াম সাধনার ফলে ধনীর অন্তরে দরিদ্রের জন্য সহানুভূতি জাগিয়ে তোলে এবং দরিদ্রকে সহযোগিতা করার মানসিকতা তৈরি হয়।
১৩. সাওম পালনের মাধ্যমে নিজ গুনাহসমূহের ক্ষমা পাওয়া যায়। যেমন- হযরত আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত রাসূল -সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম- বলেন: ‘যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ও সওয়াবের আশায় সিয়াম পালন করে, তার পূর্বাপর গুনাহগুলোকে ক্ষমা করে দেওয়া হয়। (সহিহুল বুখারি ও সহিহ মুসলিম)।
১৪. ইহা বিশ্বমুসলিম সমাজে সাম্য, মৈত্রী, ভ্রাতৃত্ব ও ভালোবাসার সৃষ্টি করে।
১৫. সিয়াম সাধনার মাধ্যমে আত্মশুদ্ধিসহ ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার গুণাবলী অর্জিত হয়।
১৬. জান্নাত লাভের এক উত্তম মাধ্যম। হাদিসে এসেছে: ‘জান্নাতের আটটি দরজা রয়েছে, তন্মধ্যে একটি দরজার নাম হচ্ছে রাইয়্যান। যা দিয়ে একমাত্র রোযাদাররাই প্রবেশ করবে।’
১৭. আল্লাহ তা’আলার লাভের অন্যতম মাধ্যম। যেমন হাদিসে কুদসিতে এসেছে ‘আল্লাহ তা’আলা বলেন: ‘রোযা শুধু আমার জন্য, আমিই এর প্রতিদান দেবো।’
১৮. পাপাচার ও অন্যায় কাজ হতে বিরত রাখে। রাসূল -সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম- বলেন: যে ব্যক্তি মিথ্যা বলা ও সে অনুযায়ী আমল বর্জন করেনি, তার পানাহার ত্যাগ করায় আল্লাহ তা’আলার কোনো প্রয়োজন নেই’(সহিহুল বুখারি: ১৯০৩)।
১৯. মহান রবের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনে অনুপ্রাণিত করে।
চ. সাওম ভঙ্গের কারণ:
যে সব কারণে সাওম ভেঙে যায় তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-
১. ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো কিছু পানাহার করা।
২. স্বামী-স্ত্রী ইচ্ছাকৃতভাবে সহবাস করা।
৩. স্বামী-স্ত্রীর চুম্বন দ্বারা বীর্যপাত হওয়া।
৪. হস্তমৈথুনের মাধ্যমে বীর্যপাত ঘটানো।
৫. ইচ্ছাকৃতভাবে মুখভর্তি বমি করা।
৬. শিঙ্গা লাগানো কিংবা এ জাতীয় অন্য কোনভাবে রক্ত বের করা।
৭. মহিলাদের হায়েয ও নিফাস শুরু হওয়া মাত্রই সাওম ভেঙ্গে যাবে।
৮. যে সব বিষয় পানাহারের স্থলাভিষিক্ত হয় তা গ্রহণ করা, ইত্যাদি।
চলবে... ।
লেখক:
হোসাইন মোহাম্মদ ইলিয়াস
কামিল, বিএ (অনার্স), কিং সৌদ ইউনিভার্সিটি, রিয়াদ, সৌদি আরব,
বিএ (অনার্স), এমএ, এমফিল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
উপাধ্যক্ষ, নিবরাস মাদরাসা।
সম্পাদক ও প্রকাশক: কামরুজ্জামান জনি
Copyright © 2024 Muktirlorai | মুক্তির লড়াই. All rights reserved.