শাহিন আলম আশিক
ইতিহাস সাক্ষী দেয়, যখন কোনো রাষ্ট্রে শাসকের পরিবর্তন ঘটানোর সাংবিধানিক বা আইনি পথ অবরুদ্ধ হয়ে যায়, তখনই জনজোয়ার আছড়ে পড়ে রাজপথে। গণঅভ্যুত্থান বা বিপ্লব তখন কেবল বিকল্প থাকে না, বরং তা অনিবার্য হয়ে ওঠে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ১৯৫২, ৭১ কিংবা ৯০-এর মতো ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানও ছিল এক রুদ্ধশ্বাস বন্দিদশা থেকে মুক্তির আর্তনাদ। কিন্তু প্রশ্ন হলো, আমরা কি কেবল 'মুখ' বদলাতে চেয়েছিলাম, নাকি পুরো 'মুখোশ'টাই ছিঁড়ে ফেলতে চেয়েছিলাম?
পচে যাওয়া কাঠামো ও ক্ষমতার মোহ-
২৪-এর আন্দোলনের মূল সুর ছিল—রাষ্ট্র সংস্কার। কোটা সংস্কার থেকে শুরু হওয়া এই লড়াই দ্রুতই একদফা দাবিতে রূপ নেয়, যার অন্তরালে ছিল দীর্ঘ কয়েক দশকের আধিপত্যবাদ ও তাঁবেদারির রাজনীতি থেকে মুক্তি। আমরা চেয়েছিলাম এমন এক বাংলাদেশ, যেখানে ক্ষমতার উৎস হবে জনগণ, কোনো প্রতিবেশী রাষ্ট্র নয়।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে, বিপ্লব পরবর্তী সময়ে আমরা এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখছি। যে 'পচে যাওয়া কাঠামো'র বিরুদ্ধে তরুণরা রক্ত দিল, সেই কাঠামোর ভেতরেই ঢুকে পড়ার এক তীব্র প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। দুর্নীতি, লুটপাট এবং একছত্র ক্ষমতার যে উৎসগুলো গত ১৫ বছর ধরে রাষ্ট্রকে কুরে কুরে খেয়েছে, সেই একই কাঠামোর সিংহাসনে বসার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অস্থিরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তারা রাষ্ট্র সংস্কারের চেয়ে ক্ষমতা দখলের দ্রুত বন্দোবস্ত করতেই বেশি আগ্রহী।
বিপ্লবের অগ্রসেনানি ও আদর্শিক বিচ্যুতি-
একটি বিপ্লব সবচেয়ে বড় হুমকির মুখে পড়ে তখন, যখন তার প্রথম সারির যোদ্ধারা আদর্শের চেয়ে ব্যক্তিগত অর্জনকে বড় করে দেখে। অপ্রিয় হলেও সত্য, ২৪-এর আন্দোলনের নেতৃত্বের একাংশ আজ ক্ষমতার কাছাকাছি গিয়ে সেই পুরনো ব্যবস্থারই অংশ হয়ে পড়ছে। ক্ষমতার মোহ আর অর্থের প্রলোভন তরুণ প্রজন্মের সেই বিশুদ্ধ আকাঙ্ক্ষাকে কলুষিত করছে। যদি বিপ্লবের কারিগররাই 'সিস্টেম' ভাঙার বদলে সিস্টেমে নিজেদের আখের গোছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে, তবে তা হবে হাজারো শহীদের রক্তের সাথে চরম বিশ্বাসঘাতকতা।
আধিপত্যবাদ মুক্ত বাংলাদেশ:
একটি অসম্পূর্ণ স্বপ্ন
বিগত দশকগুলোতে বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক ধরনের 'দাসত্বের সংস্কৃতি' তৈরি হয়েছিল। বিদেশি শক্তির ওপর নির্ভর করে ক্ষমতায় টিকে থাকার যে প্রবণতা, তা আমাদের সার্বভৌমত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছিল। ২৪-এর বিপ্লব ছিল সেই শিকল ভাঙার গান। কিন্তু আজও যদি আমরা দেখি যে রাষ্ট্র সংস্কারের মৌলিক কাজগুলো ফেলে রেখে ক্ষমতার ভাগবাটোয়ারা নিয়ে লড়াই চলছে, তবে বুঝতে হবে—আধিপত্যবাদের ছায়া এখনো সরে যায়নি; কেবল রূপ বদলেছে।
রাষ্ট্র সংস্কার মানে কেবল কাগজের সংবিধান বদলানো নয়, বরং ক্ষমতার সংস্কৃতি পরিবর্তন করা। বিচারহীনতার সংস্কৃতি দূর করা, জুলাই হত্যার বিচার নিশ্চিত করা এবং নাগরিক অধিকার ফিরিয়ে আনা ছিল এই সরকারের প্রধান অঙ্গীকার। কিন্তু সেই অঙ্গীকার যদি রাজনৈতিক দলগুলোর ক্ষমতার লালসার নিচে চাপা পড়ে যায়, তবে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আমাদের ক্ষমা করবে না।
তরুণ প্রজন্মের কাছে অনুরোধ—আবেগ আর প্রলোভনের ঊর্ধ্বে উঠে রাষ্ট্র সংস্কারের দাবিতে অটল থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে, পচে যাওয়া কাঠামোর মেরামত হয় না, তাকে ভেঙে নতুন করে গড়তে হয়। ২৪-এর যোদ্ধারা যদি আজ আপস করে ফেলে, তবে দেশ আবার সেই অন্ধকারের গহ্বরই পতিত হবে।
সম্পাদক ও প্রকাশক: কামরুজ্জামান জনি
Copyright © 2025 Muktirlorai | মুক্তির লড়াই. All rights reserved.