এম. গোলাম মোস্তফা ভুইয়া
১৯৭২ সালের পর থেকে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রে যখন ক্রমবর্ধমানভাবে অস্বাভাবিক মৃত্যু ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটছিল। ঠিক তখই প্রখ্যাত বাম রাজনীতিক ও সাংবাদিক নির্মল সেন প্রশ্ন তুলেছিলেন যে এমন একটি দেশে স্বাভাবিক মৃত্যুর জন্যও প্রার্থনা করতে হবে কিনা ? সেই সময়টা তিনি কলাম লিখেছিলেন "স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই" । এই স্লোগানটি শুধুমাত্র নির্মল সেনের ব্যক্তিগত উদ্বেগ ছিল না, বরং এটি সাধারণ মানুষের উদ্বেগ ও হতাশারও প্রতিচ্ছবি ছিল। স্বাধীনতার ৫৪ বছর পর সদ্য গণআন্দোলনের মধ্য দিয়ে ফ্যাসীবাদী সরকারের পতন হবার পর সারা দেশে ভিন্ন মতালম্বিদের আস্তানা, আখড়ায়, দরবারে হামলা, আগুন লাগানো, কবর থেকে লাশ উঠিয়ে পুড়িয়ে ফেলার যে ঘটনা ঘটছে তাতে আবারো নির্মল সেনের মত কেউ কি বলবে "লাশ ও কবরের নিরপত্তা চাই"!
অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে একটি মহল আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটানোর লক্ষে অব্যাহত ষড়যন্ত্র করছে। বিশেষ করে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের উপাসনালয়, ঘরবাড়ি, সহায়-সম্পত্তির ওপর হামলা করে, কবর থেকে লাশ উঠিয়ে অগ্নি সংযোগের মাধ্যমে দেশে একটি নৈরাজ্যের পরিস্থিতি সৃষ্টি করে ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের চেষ্টা করছে। ফ্যাসীবাদের পতনের পর স্বৈরশাসকদের ইতিহাস মুছতে গিয়ে ছাত্র আন্দোলনের সফলতোকে পুজি করে এক শ্রেণীর ষড়যন্ত্রকারীরা ভাস্কর্য ভাঙ্গতে গিয়ে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে শহীদ, ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ৭ বীর শ্রেষ্টকে মুছে দিতে চাচ্ছে। হেফাজতের নামে কেউ কেউ অতিউৎসাহি হয়ে রাজধানীর ঐতিহাসিক শাপলা চত্ত্বরকে শহীদি চত্ত্বর বানানোর চেষ্টা, দেশের বিভিন্ন স্থানে মাজার ভাঙছে, জলের গানসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর করেছে।
সর্বশেষ ভিন্ন মত গোষনকারী ‘নুরাল পাগলা’ ও তাঁর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে রাজবাড়ীতে যে ঘটনা ঘটল, তা সত্যই নিন্দনীয়, এটা কোন শুভ লক্ষন নয়। এটা সত্য যে, নুরাল পাগলার কর্মকাণ্ড হয়তো অনেকের কাছেই সমর্থনযোগ্য নয়; সমর্থন যোগ্যহবার কথাও নয়। অন্তত সামাজিক মাধ্যমে তাঁর যেসব কথা প্রচার করা হয়েছে, সেগুলো ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গিতে গ্রহণযোগ্য নয়। তবে সেগুলো কি আসলেই সত্য নাকি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কৌশল নিয়ে তৈরী কিনা, সেটাও পরিষ্কার নয়। তবে, ঘটনা যাই হোক, যারা নিজেদের ‘তৌহিদী জনতা’ আখ্যা দিয়ে কবর থেকে নুরাল পাগলার লাশ তুলে পুড়িয়েছে; তাদের এ কাজ সমর্থন যোগ্য নয়। কোনো ধর্মই মৃতদেহের অবমাননা সমর্থন করে না, করতে পারেও না। আর কথিত তৌহিদী জনতা কবর থেকে তুলে একজন মানুষের মরদেহ সর্বসমক্ষে পুড়িয়েছে কেন ? তাদের আসল উদ্দেশ্য আসলে কি ? এ ন্যক্কারজনক ঘটনা বাংলাদেশের ইতিহাসে এবারই প্রথম ঘটল বলেই মনে হচ্ছে। স্বাধীনতার আগে-পরের মানুষ আছে, তারা কেউ কোনো দিন এমন ঘটনা কি দেখেছেন ? কবর থেকে লাশ তুলে, মুসলমানের লাশ তুলে আগুন দিয়ে পুড়িয়েছে? এমন ইতিহাস কি বাংলাদেশে হয়েছে? আমরা কী বাংলাদেশ দেখছি, আমরা কী দেখছি?’
নুরাল পাগলার কবর ও মৃতদেহ নিয়ে অবিশ্বাস্য বিকৃত মানষিকতাপুর্ণ ঘটনার পর সরকার অবশ্য নিন্দা জানিয়ে বলেছে, এ ধরনের ঘটনা বরদাশত করা হবে না। বিবৃতিটি বাহ্যত প্রশংসনীয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সরকারের কাজ কি শুধু বিবৃতি দেওয়া? নাকি এসকল নৃশংস ঘটনা যাতে না ঘটে তার ব্যবস্থা গ্রহন করা। নুরাল পাগলার কবরে যে আঘাত হানা হবে– তেমন আভাস পূর্বেই দিয়েছিল ‘তৌহিদী জনতা’।
তাহলে আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী আগে কেন এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহন করে নাই। পুলিশ অদূরেই অবস্থান করছিল। প্রয়োজনবোধে তারা সেনাবাহিনীও ডাকতে পারত। কিন্তু মব সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অন্যান্য স্থানে যেমন, তেমনি এখানেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ছিল একেবারেই নির্লিপ্ত। প্রত্যক্ষদর্শী কয়েকজন জানান, মিছিল নিয়ে প্রথমে নুরুল হকের আস্তানার ভেতরে প্রবেশের চেষ্টা করে। তখন দরবারের লোকজন ইটপাটকেল ছুঁড়ে প্রতিরোধের চেষ্টা করলে অপর পাশ থেকেও ইটপাটকেল ছোড়া হয়। একপর্যায়ে কয়েকশ লোক দেয়াল টপকে ভেতরে ঢুকে দরবারে হামলা চালান।
এ সময় ভক্তদের কয়েকজনকে বেধড়ক পেটানো হয় এবং নুরুল হকের বাড়িতে ভাঙচুর চালানো হয়। পরে নুরুল হকের লাশ কবর থেকে তুলে ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের গোয়ালন্দ বাসস্ট্যান্ডের অদূরে পদ্মার মোড় এলাকায় নিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। হামলায় উভয় পক্ষের অন্তত অর্ধশত লোক আহত হন। এই ঘটনার পেছনে যারা জড়িত তাদের আসল উদ্দেশ্যটা আসলে কি ? শুধুই নুরা পাগলার উপর ক্ষোভ নাকি অন্য কিছু? নাকি তারা দেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করে অন্য কোন শক্তির উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের হাতিয়ার হিসাবে ভ্যবহৃত হচ্ছে বা হয়েছে ?
সরকারের উপদেষ্টাদের নীরবতার কারনেই দরবার ও মাজোরে হামলাকারীরা উৎসাহিত হচ্ছে বলেও দেশবাসী মনে করছে। ফ্যাসীবাদী শাসকের পরতনের পরপরই ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর বিরুদ্ধে শক্ত পদক্ষেপ গ্রহন না করার কারনেই এসকল ঘটনা ঘটছে আরো ঘটার আশংকা উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না। সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন স্থানে মাজারে হামলা ভয়াবহ আলামত। অথচ বর্তমান অন্তর্র্বতীকালীন সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টারা এর বিরুদ্ধে কঠোর ও কার্যকরী কোনো ব্যবস্থা গ্রহন না করে বরং নীরবতা পালন করছে। ফলে দেশবিরোধী শক্তির দোষররা মাজার ও দরগায় হামলায় উৎসাহিত হচ্ছে। যা সমাজ ও রাষ্ট্রকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে। অন্তর্র্বতীকালীন সরকারের উপদেষ্টাদের কেউ কেউ এর বিরোধিতা করলেও এই সাম্প্রদায়িক উগ্রবাদী শক্তিকে দমন করতে বা নিয়ন্ত্রন করতে সরকারের কার্যকর ও দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা জনগন পরিলক্ষিত করছে না।
অপরাধীরাদের আইনের আওতায় আনা হচ্ছে না। বরং সরকার কোন কোন উপদেষ্টা পতিত স্বৈারাচারের দোষর, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিরুদ্ধে ফতোয়া প্রদানকারী, শাসক যে-ই হোক তার আনুগত্য করা ফরজ, শাসকগোষ্ঠীর সমালোচনা করা, আন্দোলন করা, হরতাল অবরোধ করাকে হারাম বলে ফতোয়া দেয়া সুবিধা ভোগী গোষ্টির সাথে মাখামাখি করছে। বিভিন্ন মাজারে হামলা হচ্ছে, এটি একটি ভয়াবহতার আলামত। এমন দুঃসাহস কিভাবে পায়, কি মনে করছে তারা। যে যেই মতবাদের অনুসারী হোক না কেন, কাউকে বাধা দেয়া সংবিধান ও বিজয়ের চেতনা পরিপন্থি। বিভিন্ন মত পথ ধারণ করাই হলো একটি সভ্য দেশের চরিত্র।
প্রকৃত অর্থে ধর্মে ভক্তির সাথে শক্তির এক ধরনের দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক চলছে বহু আগে থেকেই। ভক্তি যে একেবারে অন্তর্নিহিত একটি অনুভূতি– সেই সত্যকে অস্বীকার করে শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে ধর্ম প্রচার ও প্রসার ঘটানোর প্রবণতা সেই প্রাচীনকাল থেকেই চলে আসছে। যখন থেকে মানুষ অতিজাগতিক সত্তার অস্তিত্বে বিশ্বাস শুরু করল, তখন থেকেই সেই সত্তার প্রতি ভক্তির পাশাপাশি কিছু মানুষ শক্তি প্রয়োগ করে সেই বিশ্বাস স্থাপনের চেষ্টা চালিয়ে গেছে। বিশেষত হিন্দু, খ্রিষ্টান ও ইসলাম ধর্মের ইতিহাসের একটি বড় অংশে নানান রকম যুদ্ধ-বিগ্রহের কথা রয়েছে। বিভিন্ন ধর্মে বিশ্বাসীদের মধ্যে কথিত ধর্মযুদ্ধের নামে এক পক্ষ আরেক পক্ষকে ঘায়েল করার চেষ্টাও চলে আসছে দীর্ঘ সময় থেকেই। সেখান থেকেই ধর্মীয় উগ্রবাদের সূচনা, যেখানে ভক্তি নয়; শক্তিই প্রাধান্য বিস্তার করতে থাকে। সেখান থেকেই সম্ভবত ধর্ম নিয়ে রাজনীতির সূচনা।
নুরাল পাগলা নামে একজন মানুষ মারা গেছে। যদি তার জীবনে অন্যায় করে থাকে, তার জীবনে যদি শিরক করে থাকে, তার জীবনে যদি ভণ্ডামি করে থাকে, তার জীবনে যদি কুফরি করে থাকে, সে যদি এক দিন করে থাকে, এক মাস করে থাকে, আপনি একজন মুসলমান হিসেবে দরকার ছিল বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে তার বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার মামলা করে তাকে গ্রেপ্তার করানো। কিন্তু সেই নুরা পাগলা যখন মারা গেল, কবরের ভেতরে তাকে লাঠি দিয়ে আঘাত করে কবর খুঁড়ে তার লাশটাকে বের করলেন। বের করার পর তার লাশকে নিয়ে উল্লাস করতে করতে ‘আল্লাহু আকবর’ ‘নারায়ে তাকবির’ স্লোগান দিয়ে দিয়ে আপনারা তার লাশটাকে পুড়িয়ে দেয়া কোন সভ্যতা নয়, ধর্মও নয়। ব্যক্তির সম্মান ও মর্যাদা শুধু জীবিত অবস্থার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং মৃত্যুর পরও এ সম্মান অব্যাহত থাকবে। ইসলামী আইনের একটি নীতি হলো, ‘মানবসন্তান জীবিত বা মৃত হোক সম্মানের পাত্র বলে গণ্য হবে।’ (আল মাবসুত : ৫৯/২)
রাজবাড়ির ঘটনা মানুষের মানবিক হৃদয়কে বিদীর্ণ করেছে। কবর থেকে লাশ তুলে এনে সেটি পুড়িয়ে ফেলা কেবল আইনবহির্ভূত কাজ নয়, এটি ইসলামী শরীয়ত, মানবতা এবং সভ্যতার পরিপন্থী এক ভয়ঙ্কর অমানবিকতা। এমন ঘটনার সাক্ষী হওয়া মানে গোটা জাতি হিসেবে আমাদের আত্মসম্মানকে প্রশ্নবিদ্ধ করা। ইসলামে মৃতদেহের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা ঈমানের অংশ। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: “কোনো মৃতদেহের হাড় ভেঙে ফেলা জীবিত অবস্থায় ভেঙে ফেলার মতোই গুনাহ।” (সুনান ইবনে মাজাহ, হাদিস: ১৬১৬)। অতএব মৃতদেহও সম্মানের অধিকারী। তাকে অসম্মান করা বা অপমান করা ইসলামে গুরুতর অপরাধ। ইসলামের ইতিহাসে এমন কোনো নজির নেই যে রাসূল (সা.) বা অন্য কোনো নবী কারো লাশ কবর থেকে তুলে এনে অপমান করেছেন বা আগুনে পুড়িয়েছেন। বরং যুদ্ধক্ষেত্রে নিহত শত্রুপক্ষের মৃতদেহ পর্যন্ত অসম্মান করতে কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে।
এমনকি অমুসলিম মৃতদেহের প্রতিও সম্মান প্রদর্শনের শিক্ষা দিয়েছে ইসলাম। রাসূলুল্লাহ (সা.)–এর জীবনে একটি ঘটনা আছে—একজন ইহুদির জানাজা যখন রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল, তখন তিনি দাঁড়িয়ে গেলেন। সাহাবারা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “হে আল্লাহর রাসূল! সে তো ইহুদি।” রাসূল (সা.) উত্তর দিলেন: “সে-ও তো একজন মানব আত্মা ছিল।” (সহিহ বুখারি: ১৩১২; সহিহ মুসলিম: ৯৬১)। অতএব, মুসলিম হোক বা অমুসলিম, কারো লাশ অপমান করা ইসলামে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
কবর খুঁড়ে মরদেহ টেনে এনে প্রকাশ্যে পুড়িয়ে ফেলার মতো ভয়াবহ ঘটনা আমাদের রাষ্ট্রের আইন-শৃঙ্খলা ও সামাজিক নৈতিকতার চরম ব্যর্থতা। আইন হাতে তুলে নেওয়া ইসলাম নয়, বরং ইসলামের নামে ইসলামবিরোধী কর্মকাণ্ড। একদিকে ধর্মের নাম ব্যবহার করে সহিংসতা, অন্যদিকে প্রশাসনের দুর্বলতারই বহিঃপ্রকাশ। এর ফলে আমাদের মানসিকতা ও মানবিকতার বিকৃতির পরিচয় ফুটে উঠেছে মাত্র। এই ঘটনার দায় শুধু হামলাকারীদেরই নয়, এ ঘটনার দায় আমাদের পুরো সমাজের। সমাজের সচেতন অংশ যদি নিরব থাকে, তবে চরমপন্থী ও উগ্রবাদীদের সাথে সাথে ষড়যন্ত্রকারীরা সুযোগ নেবে, আর রাষ্ট্রের ব্যর্থতা তখন আরও স্পষ্ট হয়ে উঠবে।
গত ২০২৪ এর ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার স্বৈরশাসনের পতনের মধ্য দিয়ে দেশ নিয়ে মানুষের মধ্যে নতুন করে আশার সঞ্চার হয়। কিন্তু সারা দেশে রাতারাতি এক শ্রেণির সুবিধাবাদী, সুযোগসন্ধানী এবং অসাধুচক্রের আবির্ভাবের কারণে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠাও তৈরি হচ্ছে। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের অর্জিত বিজয়কে অক্ষুন্ন রাখতে সামাজিকভাবে প্রতিটি গ্রাম মহল্লায় দলমত নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধভাবে জণগণকে ছাত্র জনতার বিজয় নস্যাৎকারী দুষ্কৃতকারীদের রুখে দাঁড়াতে হবে। সবাইকে স্পষ্ট ভাবে স্মরণ রাখতে হবে যে, বহু মত ও পথের বাংলাদেশে মন্দির- মসজিদ – গির্জা- প্যাগোডা- থাকবে। মাজার থাকবে- বাউল- ফকিরসহ সমস্ত সংস্কৃতি থাকবে। এই দেশ সব ধর্মের, সব জাতির, সব মানুষের দেশ।
বাংলাদেশে ঔপনিবেশিক কাল থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত ঘোষণা দিয়ে কেউ কখনও মাজার ভাঙেনি। এবার ঘোষণা দিয়ে আক্রমণ হয়েছে। অনেক জায়গায় একাধিকবার আক্রমণ হয়েছে এবং শাহপরাণে হামলায় একজনকে মেরে ফেলা হয়েছে। এসব ঘটনার দায়ভার ক্ষমতাসীন সরকার এড়াতে পারে না।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, এসব হামলার পেছনে যেমন ধর্মতাত্ত্বিক, দার্শনিক দ্বন্দ্ব-বিতর্ক রয়েছে; তেমনি বিভিন্ন শক্তি নিজেদের স্বার্থে এতে যুক্ত থাকতে পারে। সরকারের উপদেষ্টাদের দুর্বলতা, সব সিদ্ধান্ত ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়ার ফলেও এই ধরনের অবস্থা সৃষ্টি হচ্ছে। এর ফলশ্রুতিতে সামাজিক বিশৃঙ্খলা তৈরি হচ্ছে। এটা হামলাকারীরা বুঝতে পারছে না, নাকি বুঝে শুনে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করে ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের জন্য করছে তাও ভাবনাতে আনতে হবে। তারা রাষ্ট্র ও সমাজকে আরও অস্থিতিশীল করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। ফকির লালন, খালেক দেওয়ান, আব্দুল হালিম, রাধারমণ, আরকুম শাহসহ বিভিন্ন ফকির, দরবেশ, পীর, মুরশিদের গান শুনলে দেখা যাবে যে, সেখানে ধর্মতত্ত্বের গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক জিজ্ঞাসাগুলো তুলে ধরা হয়েছে। যে কারণে স্বভাবতই মানুষ এতে আকৃষ্ট হয়। এই তত্ত্বগুলো দাঁড় করানোর মধ্য দিয়ে যে নতুন চিন্তা হাজির হয়, তার সঙ্গে কথিত পরকালবাদীদের একটা দ্বন্দ্ব তৈরি হয়, বিশেষত যারা ধর্ম বলতে পরকালকেই বোঝে। তারা আক্রমণের শুরুতে গাঁজার কথা বলে, অথবা জমি নিয়ে বা আধিপত্য নিয়ে মারধর কিংবা দানের বাক্স কার কাছে আছে, এসব দ্বন্দ্ব এসে হাজির হয়। এটা বড় কোনো বিষয় ছিল না। তবে এখন এটিকে রাজনৈতিক রূপ দেওয়া হচ্ছে। কারণ, রাষ্ট্র এখন খুবই দুর্বল।
আমাদের দেশের একটা শ্রেণি চায় না যে, মানুষের ভেতর যে প্রেমের চর্চা এতদিন ধরে হচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও হবে; সেই ধারাটা চলমান থাকুক। তারা নিজেদের জন্য একে হুমকিস্বরূপ মনে করে। মাজার শরিফ, আখড়া, আশ্রম, দরগা শরিফ–সেখানে সব সময় শুদ্ধচিন্তা, প্রেমের চর্চা হয়। সেখানকার সাঁই মানবতার মন্ত্রে দীক্ষিত, শিষ্যের ভেতরে সেটাই প্রতিষ্ঠিত করেন। যে নামেই ডাকুক, সব মানুষই এক স্রষ্টার সৃষ্টি। আমাদের দেশে শান্তির ধর্ম এসেছে ১০৫৩ সালে নেত্রকোনার মদনে শাহ মুহাম্মদ সুলতান কমরউদ্দিন রুমির (র.) মাধ্যমে। তিনি ওই অঞ্চলে মারফতি ঘরানার ইসলাম চর্চা করেন। এ ধারাটাই বাংলাদেশে শক্তিশালী। যারা এখন ক্ষমতায় আছে, দায়দায়িত্ব তাদের নিতে হবে। তারা জানে কোন কোন জায়গায় আঘাত আসতে পারে। তারা যদি আগে থেকে ঘোষণা দিত যে, মাজার কিংবা ধর্মীয় কোনো জায়গায় আঘাত করা যাবে না, তাহলে কিন্তু এমনটা হতো না।
প্রধান উপদেষ্টা ঘোষণা দেওয়ার পরই কিন্তু মাজার ভাঙা কমে এসেছে। তিনি যদি প্রথম থেকেই বলতেন যে, এটা আমাদের ঐতিহ্য, এটা আমাদের জাতিগত পরিচয়ের জায়গা; তাহলে এ ধরনের ঘটনা ঘটতো না। আসলে গোটা বিষয়ই গভীরভাবে উপলব্ধি করতে হবে। মানুষের প্রতি সম্মান ও তার মর্যাদা রক্ষা করতে না পারাটা অধর্মেরই অংশ; তা সে মানুষ যে ধর্মেই বিশ্বাসী হোক কিংবা অবিশ্বাসী হোক না কেন। রাজবাড়ির ঘটনাটি কোনো সাধারণ ঘটনা নয়। এটি আমাদের ধর্মীয় মূল্যবোধ, সামাজিক বিবেক ও রাষ্ট্রীয় সক্ষমতার ওপর এক কঠিন প্রশ্নচিহ্ন এঁকে দিয়েছে।
জনমনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে হায়রে বাংলাদেশ! মুসলমান মুসলমানের চামড়া খুবলে খাচ্ছে। মুসলমান মুসলমানের লাশ কবর থেকে তুলে পুড়িয়ে ফেলছে! এ কোন বাংলাদেশের দিকে যাচ্ছে আমরা। জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের চেতনা কি তাহলে পদদলীত হচ্ছে ?
(লেখক : রাজনীতিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলাম লেখক)
সম্পাদক ও প্রকাশক: কামরুজ্জামান জনি
Copyright © 2025 Muktirlorai | মুক্তির লড়াই. All rights reserved.