মোঃ আবদুল আউয়াল সরকার
রাসেলস ভাইপার দক্ষ সাঁতারু হওয়ায় নদীর স্রোতে ও বন্যার পানিতে দেশের বিভিন্ন এলাকায় বিস্তৃত হয়েছে। তাই, সকলকে সাবধানতা অবলম্বন করার অনুরোধ রইল।
দেশে রাসেলস ভাইপার বা চন্দ্রবোড়া সাপ নিয়ে যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে সরকারি-বেসরকারি বিশেষজ্ঞরা আতঙ্কের বদলে সতর্কতা ও সচেতনতার তাগিদ দিয়েছেন। তাঁরা বলছেন, সতর্ক থাকলে এবং সাপের বিচরণস্থল এড়িয়ে চললে দংশিত হওয়ার ঝুঁকি কম। আর সময়মতো হাসপাতালে গেলে মৃত্যুর আশঙ্কাও কমে যায়।আগ বাড়িয়ে সাপ মারার চেষ্টা করা বিপজ্জনক। আতঙ্কিত না হয়ে রাসেলস ভাইপার সম্পর্কে সঠিক তথ্য জেনে সতর্ক হতে হবে।
মানুষের সঙ্গে এই সাপের মুখোমুখি হওয়ার সম্ভাবনা কম। সাপটি সাধারণত নিচু ভূমির ঘাসবন, ঝোপ-জঙ্গল, উন্মুক্ত বন ও কৃষি এলাকায় বাস করে। জনবসতি এড়িয়ে চলে। মেটে রঙের হওয়ায় সাপটি মাটির সঙ্গে সহজে মিশে যেতে পারে।
লোকে খেয়াল না করে খুব কাছে গেলে সাপটি নিজেই ভয় পেয়ে আক্রমণ করে।
চলাচলে বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করতে বলা হয়েছে। বলা হয়েছে, লম্বা ঘাস, ঝোপঝাড় ও কৃষি এলাকায় হাঁটার সময় সতর্ক থাকতে হবে। ক্ষেত বা ঝোপঝাড়পূর্ণ এলাকায় কাজ করার সময় বুট ও লম্বা প্যান্ট পরতে হবে। এ ছাড়া রাতে অন্ধকার স্থানে চলাচলের সময় অবশ্যই টর্চলাইট ব্যবহার করা, বাড়ির চারপাশ পরিষ্কার রাখা, পড়ে থাকা গাছ, লাকড়ি বা খড় সরানোর সময় সাবধান থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। সাপ দেখলে ধরা বা মারার চেষ্টা করা যাবে না। প্রয়োজনে জাতীয় হেল্পলাইন ৩৩৩ নম্বরে কল করতে হবে বা কাছের বন বিভাগ কার্যালয়কে জানাতে হবে।
এ দেশে সাপের কামড়ে যারা মারা যায় তাদের মধ্যে ৯০ শতাংশই সাত-আট ঘণ্টা পর হাসপাতালে আসে। এ কারণে মৃত্যুর সংখ্যা বেশি হয়। তবে হাসপাতালে নেওয়া ৭০ শতাংশের বেশি রোগী ভালো হয়ে যায়।’ ‘সর্পদংশন হলো স্বাস্থ্য সমস্যা। এ ক্ষেত্রে বিষ-প্রতিক্রিয়া জানা জরুরি। বিশ্বের অনেক দেশে অ্যান্টিজেন টেস্টের মাধ্যমে এটি জানার সুযোগ থাকলেও আমাদের তা নেই।’গোখরা সাপের দংশনের গড় আট ঘণ্টা পর, কেউটে সাপের দংশনের গড় ১৮ ঘণ্টা পর ও রাসেলস ভাইপার সাপের দংশনের গড় ৭২ ঘণ্টা বা তিন দিন পর রোগীর মৃত্যু হতে পারে।
১৮৮০ সালে ব্রিটিশ ভারতে সরকার সাপ মারা উৎসাহিত করে পুরস্কার ঘোষণা করেছিল। কিন্তু পরে দেখা যায়, এতে প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। তখন আবার পুরস্কার বন্ধ ঘোষণা করা হয়।
সাপে কামড়ালে করণীয় কী?
দংশিত অঙ্গ নড়াচড়া করা যাবে না। পায়ে দংশন হলে বসে যেতে হবে, হাঁটা যাবে না। হাতে দংশনের ক্ষেত্রে হাত নাড়াচাড়া করা যাবে না। নাড়াচাড়া করলে বিষ দ্রুত শরীরে ছড়িয়ে যেতে পারে। আক্রান্ত স্থান সাবান দিয়ে আলতোভাবে ধুতে বা ভেজা কাপড় দিয়ে আলতোভাবে মুছতে হবে। পরনে ঘড়ি বা অলংকার বা তাবিজজাতীয় কিছু থাকলে খুলে ফেলতে হবে। দংশিত স্থানে কাটাছেঁড়া করা, সুই ফোটানো বা কোনো রকম প্রলেপ লাগানো যাবে না। ওঝার কাছে না গিয়ে যত দ্রুত সম্ভব কাছের হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে যেতে হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির প্রকল্প ভেনম রিসার্চ সেন্টারের স্নেক রেসকিউ টিম দেশের ২৭টি জেলা থেকে ৫০টি রাসেলস ভাইপার সাপ ধরেছে। ভেনম রিসার্চ সেন্টারের সমন্বয়ক ও গবেষক বন্য প্রাণী ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ মো. আবদুল্লাহ আবু সাঈদ বলেন, এই সাপ লোকালয়ে আসার অন্যতম কারণ বনাঞ্চল ধ্বংস এবং কৃষিজমির সম্প্রসারণ। এ কারণে সব সাপের প্রাকৃতিক বাসস্থান নষ্ট হয়ে গেছে। জলবায়ুর পরিবর্তনও একটি কারণ। মাঝে কয়েক দশক রাসেলস ভাইপারকে বিলুপ্ত ভাবা হয়েছিল। ২০১২ সালে রাজশাহীর তানোর উপজেলায় এ সাপের দংশনে একজন কৃষকের মৃত্যু হয়। তখন আবার এটি শনাক্ত হয়। এর পর থেকে ধীরে ধীরে আবার এর সংখ্যা বাড়ছে। বাংলাদেশে যেসব সাপের দংশনে মৃত্যু হয় তার মধ্যে তিন ধরনের সাপ উল্লেখযোগ্য। গোখরার দুই প্রজাতি, কেউটের পাঁচ প্রজাতি এবং ভাইপার প্রজাতির মধ্যে রাসেলস ভাইপার।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, বেজি, গুইসাপ, বাগডাশ, গন্ধগোকুল, বনবিড়াল, মেছো বিড়াল, তিলা নাগ ইগল, সারস, মদনটাক এমনকি কিছু প্রজাতির সাপও রাসেলস ভাইপার সাপ খেয়ে তাদের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে রাখে। নির্বিচারে এসব বন্য প্রাণী হত্যার কারণেও প্রকৃতিতে রাসেলস ভাইপার বেড়ে যাচ্ছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রের (এনসিডিসি) সর্বশেষ জরিপ (১৮ জুন, ২০২৩) অনুযায়ী, ২০২১-২২ সালে দেশে প্রায় চার লাখ তিন হাজার মানুষকে সাপে কেটেছিল। এর মধ্যে সাত হাজার ৫১১ জন মারা যায়। ২০২০ সালে সাপের কামড়ের শিকার হয়েছিল ছয় লাখ মানুষ। ওই বছর মারা যায় ছয় হাজার জন। ২০১৭ সালে মার্কিন একটি জার্নালে প্রকাশিত আরেকটি গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ৯ লাখ মানুষকে সাপে কামড়ায়, যাদের মধ্যে ছয় হাজার জন মারা যায়।
কুমিল্লার সিভিল সার্জন ডাঃ নাছিমা আকতার বলেন,রাসেল ভাইপার একটি বিষাক্ত সাপ।আমরা সবাই জানি।আতঙ্কিত হওয়ার কিছুই নাই।যদি কাউকে সাপ কামড় দিয়ে দেয়।তৎক্ষনাৎ তাকে নিকটস্থ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স অথবা সদর হাসপাতালে নিয়ে আসে। আমাদের প্রত্যেকটি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও সদর হাসপাতালে এন্টিবেনাম আছে।
লেখক: চিকিৎসা প্রযুক্তিবিদ, শিক্ষক ও গণমাধ্যমকর্মী।
সম্পাদক ও প্রকাশক: কামরুজ্জামান জনি
Copyright © 2024 Muktirlorai | মুক্তির লড়াই. All rights reserved.