ভ্রাম্যমান প্রতিনিধি
দিরাই উপজেলার তাড়ল ইউনিয়নের নোয়াগাঁও গ্রাম। দিরাই–শাল্লা সড়ক ধরে এগোলে প্রথমে চোখে পড়ে একটি বোর্ড—দেখলে মনে হবে সড়কের উন্নয়ন কাজ চলছে। কিন্তু এগিয়ে গেলে দেখা যায় ভিন্ন চিত্র। সড়কের মাঝ বরাবর টানা পাইপ, আর সেই পাইপ দিয়ে ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসছে বিট বালু। রাস্তা ভরাটে ব্যবহৃত হচ্ছে যে বালু—তার উৎস আশেপাশে কোথাও নেই। নদী তো দূরের কথা, পুরো এলাকাজুড়ে কেবল হাওরই হাওর।
বালুর উৎস খুঁজতে গেলে দেখা যায় পাইপের লাইন প্রায় এক কিলোমিটার দূরের জুরি-পানজুরি বিল পর্যন্ত বিস্তৃত। সরমঙ্গল ইউনিয়নের এই বিলের বুক চিরে চলছে গভীর ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে বিট বালু উত্তোলন। স্থানীয়দের ভাষায় এটি “সম্পূর্ণ অবৈধ এবং ভয়াবহ পরিবেশ ধ্বংসের এক মহাযজ্ঞ”।
অভিযোগ করেও ব্যবস্থা নেই! নোয়াগাঁও গ্রামের কৃষক আব্দুল হেকিম মিয়া বিষয়টি নিয়ে একটি লিখিত অভিযোগ জমা দিয়েছেন দিরাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) নিকট। অভিযোগে তিনি উল্লেখ করেন—৩০ থেকে ৪০ ফুট গভীর করে বিট বালু উত্তোলন করলে পার্শ্ববর্তী শত শত একর বোরো জমি ধসে পড়তে পারে। কৃষকদের বছরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মৌসুম বোরো। এই জমি ধসে পড়লে পুরো এলাকার কৃষি ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে।
কিন্তু অভিযোগের ১৫-২০ দিন পেরিয়ে গেলেও প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। বরং দিন-রাত চলছে ড্রেজারের শব্দ, আর পাইপ বেয়ে উঠে আসছে বালুর ঢেউ।
স্থানীয় ওয়ার্ড মেম্বার হুসাইন জানান—“বালু তোলার নির্দিষ্ট স্থান ও সীমারেখা রয়েছে। কিন্তু এভাবে হাওর চিরে গভীর খনন করা আইন অনুযায়ী অবৈধ। এতে ফসলি জমির মারাত্মক ক্ষতি হবে। প্রশাসন দ্রুত হস্তক্ষেপ না করলে বড় বিপর্যয় দেখা দিতে পারে।”
জুরি–পানজুরি বিলটি ধনপুর-নোয়াগাঁও জুরি পানজুরি মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি লিমিটেড–এর ইজারা অধীনে থাকার কথা। কিন্তু স্থানীয়দের অভিযোগ—সমিতির সম্পাদক বিদেশে চলে যাওয়ার পর সভাপতি ও তার অনুসারীরা প্রভাবশালী মহলকে নিয়ে জলমহালের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিয়েছে। যার ফলে জলমহাল নিয়ন্ত্রণ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
দ্বিতীয় পক্ষের অভিযুক্তরা হলেন—১. ওহাদ আলী (৪০) ২. আজি মিয়া (৫০) ৩.মকছুদ্ধ মিয়া (৪০) তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ—জলমহালকে ব্যবহার করে অবৈধভাবে গভীর খনন করে বালু উত্তোলন ও বিক্রির প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, হাওরের নিচের মাটি কোমল। ফসলি জমি ধসে পড়ার উচ্চ ঝুঁকি রয়েছে। গভীর সাকশন ড্রেজারের মাধ্যমে ৩০–৪০ ফুট খনন করলে আশেপাশের মাটির স্তর ধসে পড়ে পানির টান তৈরি হয়, যার ফলে—বোরো জমি ভেঙে বিলীন হয়, গ্রামীণ সড়ক দুর্বল হয়ে পড়ে,
জলধারণ ক্ষমতা নষ্ট হয়ে মাছের প্রজনন ব্যাহত হয়। হাওরের প্রাকৃতিক পরিবেশ ঝুঁকিতে পড়ে।
নোয়াগাঁও ও সরমঙ্গল এলাকার কৃষকরা বলছেন, এভাবে বালু উত্তোলন করলে হাওরের পাড়ের কৃষকদের শেষ সম্বলটুকুও আর থাকবেনা। এলাকায় উত্তেজনা, দাঙ্গা-হাঙ্গামার আশঙ্কা। সমিতির সভাপতি বিষয়টি জানেন না বলে দাবি করলেও বাস্তবে ড্রেজার চলে প্রতিদিন। এ নিয়ে এলাকায় উত্তেজনা বাড়ছে। স্থানীয়রা জানান—কৃষকদের মধ্যে ক্ষোভ তীব্র হয়ে উঠছে এবং যেকোনো সময় সংঘর্ষের আশঙ্কা রয়েছে। প্রশাসনের নীরবতায় রয়েছে প্রশ্নবোধক দৃষ্টি, অভিযোগের কপি দেয়া হয়েছে—জেলা প্রশাসক সুনামগঞ্জ, সহকারী কমিশনার (ভূমি), দিরাই, অফিসার ইনচার্জ, দিরাই থানা, স্থানীয় সংবাদমাধ্যম
তবু প্রশাসন এখনো পর্যন্ত কার্যকর ব্যবস্থা নেয়নি। স্থানীয়রা প্রশ্ন তুলছেন—“অভিযোগের পরেও অবৈধ বালু উত্তোলন বন্ধ না হওয়ার কারণ কি? কারা এই অবৈধ ড্রেজিংয়ের ছায়া-সমর্থক?”
দিরাইয়ের জুরি–পানজুরি বিল আজ অবৈধ খননের শিকার। হাওরের হৃদয়ে এই আঘাত শুধু পরিবেশ নয়—হুমকির মুখে ফসল, রাস্তা, কৃষকের জীবন-জীবিকা। অবিলম্বে প্রশাসনের নজরদারি ও আইনানুগ ব্যবস্থা না নিলে দিরাইয়ে এক পরিবেশ বিপর্যয় অনিবার্য হয়ে উঠবে।
সম্পাদক ও প্রকাশক: কামরুজ্জামান জনি
Copyright © 2025 Muktirlorai | মুক্তির লড়াই. All rights reserved.