
১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের মাধ্যমে নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হলেও, প্রকৃতপক্ষে ১৭ ডিসেম্বর ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য প্রথম কঠিন বাস্তবতার দিন। যুদ্ধের গর্জন থেমে গেলেও এই দিনে শুরু হয় নতুন সংগ্রাম একটি বিধ্বস্ত দেশকে শাসনযোগ্য রাষ্ট্রে রূপান্তর করার সংগ্রাম। রাজধানী ঢাকা সহ সারা দেশে তখনও ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল অস্ত্রধারী সহযোগী বাহিনী, ভাঙাচোরা যোগাযোগ ব্যবস্থা, লক্ষ লক্ষ গৃহহীন মানুষ এবং প্রশাসনিক শূন্যতা। বিজয়ের আনন্দের সঙ্গে সঙ্গে তাই ১৭ ডিসেম্বর জাতির সামনে দাঁড়িয়ে যায় দায়িত্ব, শোক ও ভবিষ্যৎ নির্মাণের কঠিন প্রশ্ন।
১৭ ডিসেম্বরের অন্যতম প্রধান কাজ ছিল যুদ্ধবিরতির পূর্ণ বাস্তবায়ন ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। আত্মসমর্পণের পর প্রায় ৯৩ হাজার পাকিস্তানি সেনা, কর্মকর্তা ও সহযোগীকে যুদ্ধবন্দী হিসেবে শনাক্ত করে নিরাপদ শিবিরে স্থানান্তরের প্রক্রিয়া শুরু হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এটি ছিল বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ যুদ্ধবন্দী ব্যবস্থাপনা। আন্তর্জাতিক মানবিক আইন অনুযায়ী এসব বন্দীর নিরাপত্তা, খাদ্য ও চিকিৎসা নিশ্চিত করা ছিল যৌথ বাহিনীর জন্য একটি বড় প্রশাসনিক চ্যালেঞ্জ। একইসঙ্গে দেশের ভেতরে ছড়িয়ে থাকা রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনীর সদস্যদের অস্ত্র উদ্ধারে অভিযান শুরু হয়, যাতে বিজয়ের পর কোনো বিশৃঙ্খলা নতুন রাষ্ট্রকে বিপর্যস্ত না করে।
১৭ ডিসেম্বর দেশের বিভিন্ন স্থানে মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্রবাহিনীর যৌথ টহল জোরদার করা হয়। থানাগুলো পুনরায় কার্যকর করা, সরকারি ভবন দখলমুক্ত করা এবং সাধারণ মানুষের জান-মালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই ছিল এদিনের অগ্রাধিকার। একইসঙ্গে যুদ্ধের সময় ভেঙে পড়া প্রশাসনিক কাঠামো পুনর্গঠনের প্রাথমিক উদ্যোগ নেওয়া হয়। জেলা ও মহকুমা পর্যায়ে অস্থায়ী প্রশাসনিক দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তা, স্থানীয় রাজনৈতিক কর্মী ও সমাজকর্মীরা একযোগে কাজ শুরু করেন। স্কুল, হাসপাতাল, খাদ্যগুদাম ও যোগাযোগব্যবস্থা চালু করার তালিকা তৈরি হয়, যা স্বাধীন বাংলাদেশের পুনর্গঠনের প্রথম লিখিত রূপরেখা হিসেবে বিবেচিত।
এই দিন থেকেই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের উপস্থিতি নতুন মাত্রা পেতে শুরু করে। ১৭ ডিসেম্বর বিশ্ব গণমাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও পাকিস্তানের পরাজয়ের খবর ছিল প্রধান শিরোনাম। ভারত ও ভুটানের পর আরও কয়েকটি দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করে। আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে স্পষ্ট হয়ে ওঠে বাংলাদেশ আর কোনো অস্থায়ী বাস্তবতা নয়, এটি একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র। জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা যুদ্ধবিধ্বস্ত মানুষের জন্য জরুরি ত্রাণ, খাদ্য, ওষুধ ও পুনর্বাসনের বিষয়ে আলোচনা শুরু করে। সীমান্ত পেরিয়ে থাকা শরণার্থীদের নিরাপদ প্রত্যাবর্তন নিয়েও আন্তর্জাতিক পরিকল্পনা প্রণীত হতে থাকে।
১৭ ডিসেম্বরের দিনটি একইসঙ্গে ছিল গভীর শোকের দিন। বিজয়ের পর জাতি আরও স্পষ্টভাবে উপলব্ধি করে ১৪ ডিসেম্বর সংঘটিত বুদ্ধিজীবী হত্যাযজ্ঞের ভয়াবহতা। রায়েরবাজার, মিরপুর ও আশপাশের এলাকায় বধ্যভূমি থেকে একে একে উদ্ধার হতে থাকে শিক্ষক, সাংবাদিক, চিকিৎসক, সাহিত্যিক ও গবেষকদের মরদেহ। এই দৃশ্যগুলো পুরো জাতিকে স্তব্ধ করে দেয়। বিজয়ের আনন্দ মুহূর্তেই বিষাদের গভীর ছায়ায় ঢেকে যায়। স্পষ্ট হয়ে ওঠে, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা পরিকল্পিতভাবে বাংলাদেশের মেধাভিত্তিক নেতৃত্বকে নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা করেছিল।
এই বধ্যভূমিগুলো থেকে মরদেহ উদ্ধার কেবল শোকের বহিঃপ্রকাশ ছিল না; এটি ছিল ভবিষ্যৎ ন্যায়বিচারের জন্য প্রামাণ্য দলিল সংগ্রহের সূচনা। স্থানীয় মানুষ, মুক্তিযোদ্ধা ও প্রশাসনিক কর্মকর্তারা এই হত্যাকাণ্ডের তথ্য সংরক্ষণ শুরু করেন, যা পরবর্তীকালে যুদ্ধাপরাধের বিচার, স্মৃতিসৌধ নির্মাণ এবং জাতীয় ইতিহাস রচনার ভিত্তি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ১৭ ডিসেম্বর তাই শোককে শক্তিতে রূপান্তরের এক নীরব সিদ্ধান্তের দিন হিসেবেও বিবেচিত।
রাষ্ট্র গঠনের দৃষ্টিকোণ থেকে ১৭ ডিসেম্বর ছিল এক মৌলিক সূচনাবিন্দু। এই দিন থেকেই মুক্তিযোদ্ধারা ধীরে ধীরে অস্ত্র জমা দিয়ে বিজয়ী বেশে ঘরে ফিরতে শুরু করেন। তাঁদের প্রত্যাবর্তন ছিল শুধু যুদ্ধশেষের প্রতীক নয়, বরং নতুন রাষ্ট্রের নাগরিক জীবনে অংশগ্রহণের ঘোষণা। একইসঙ্গে যুদ্ধাহত পরিবার, শহীদ পরিবার ও বাস্তুচ্যুত মানুষের তালিকা তৈরির কাজ শুরু হয়, যা ভবিষ্যৎ পুনর্বাসন ও ক্ষতিপূরণ নীতির ভিত্তি গড়ে দেয়।
১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১ ইতিহাসে তাই কেবল বিজয়ের পরদিন নয় এটি ছিল স্বাধীনতাকে কার্যকর রাষ্ট্রে রূপ দেওয়ার প্রথম বাস্তব দিন। এই দিনে বাংলাদেশ শিখেছিল, স্বাধীনতা অর্জনের মতোই কঠিন স্বাধীনতা রক্ষা করা, ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা এবং একটি মানবিক রাষ্ট্র গড়ে তোলা। ধ্বংসস্তূপের মধ্যেও যে দিন জাতি প্রশাসন, কূটনীতি, মানবিকতা ও স্মৃতি সংরক্ষণের পথে হাঁটতে শুরু করেছিল, ইতিহাসে সেই দিনটি চিহ্নিত হয়ে আছে নতুন বাংলাদেশের প্রথম প্রভাত হিসেবে।
লেখক : মোহাম্মদ আলী সুমন, সাংবাদিক ও সংগঠক।
সম্পাদক ও প্রকাশক: কামরুজ্জামান জনি
Copyright © 2025 Muktirlorai | মুক্তির লড়াই. All rights reserved.