মোহাম্মদ আলী সুমন
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে সশস্ত্র প্রতিরোধের গৌরবময় অধ্যায়ের স্মৃতি ধারণ করে ২১ নভেম্বর পালিত হয় সশস্ত্র বাহিনী দিবস। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের এই দিনে সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী সম্মিলিতভাবে পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে সমন্বিত আক্রমণ শুরু করে। ইতিহাসের সেই গুরুত্বপূর্ণ প্রতিরোধ শুধু মুক্তিযুদ্ধের গতিপথ দ্রুত বদলে দেয়নি, বরং প্রমাণ করেছিল—জন্ম নিতে যাওয়া বাংলাদেশ শুধুই একটি ভূখণ্ড নয়, বরং সুসংগঠিত, সাহসী ও বিজয়ী জাতির প্রতীক। সেই ঘটনাকে স্মরণ করেই প্রতি বছর রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় উদযাপিত হয় সশস্ত্র বাহিনী দিবস।
মুক্তিযুদ্ধের সময় তিন বাহিনীর যৌথ শক্তির সাফল্য আজও গৌরবচিহ্ন হয়ে রয়েছে। মুজিবনগর সরকার কর্তৃক পরিচালিত বাহিনী দেশব্যাপী বিভিন্ন আক্রমণে পাকবাহিনীকে বিপর্যস্ত করে তোলে। সম্মিলিত অভিযানের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল বৃদ্ধি পায় এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম আরও দৃঢ় ভিত্তি পায়। এদিনের তাৎপর্য তাই শুধু ইতিহাসে নয়, জাতীয় চেতনাতেও গভীরভাবে প্রোথিত।
স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। সীমান্ত পাহারা থেকে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দমন—সবক্ষেত্রেই সেনাবাহিনী দীর্ঘদিন ধরে দায়িত্বশীল ভূমিকা রেখে জাতির আস্থা অর্জন করেছে। নৌবাহিনী সমুদ্রসীমা রক্ষা, সমুদ্রসম্পদ নিরাপত্তা এবং দুর্যোগকালে উদ্ধার তৎপরতায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে। বিমানবাহিনী আকাশসীমার নিরাপত্তা, আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং জরুরি পরিস্থিতিতে দ্রুত মানবিক সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে দেশের প্রতিরক্ষা শক্তিকে আধুনিক যুগে নিয়ে এসেছে।
আন্তর্জাতিক পরিসরেও বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী গৌরবের সঙ্গে দেশের নাম উজ্জ্বল করে চলেছে। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশ অন্যতম শীর্ষস্থানীয় সৈন্য-অবদানকারী দেশ। বিশ্বের বিভিন্ন সংঘাতপূর্ণ এলাকায় শান্তি স্থাপন, চিকিৎসা সহায়তা ও মানবিক কাজের মাধ্যমে তিন বাহিনী দেশের মর্যাদা আরও উঁচুতে তুলে ধরেছে। মানবিকতার এই বৈশ্বিক ভূমিকাই বাংলাদেশের শান্তিপ্রিয় পরিচয়কে সুদৃঢ় করেছে।
দেশের অভ্যন্তরে দুর্যোগকালীন সময়ে সশস্ত্র বাহিনীর অবদান অনস্বীকার্য। ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, ভূমিধস বা যেকোনো দুর্যোগে সবচেয়ে আগে ঝাঁপিয়ে পড়ে সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীর সদস্যরা। মানুষের জীবন বাঁচানো, খাদ্য বিতরণ, নিরাপদ আশ্রয় তৈরি, উদ্ধার অভিযান—সবক্ষেত্রেই তারা মানুষের আস্থার নাম। জাতির সংকটমুহূর্তে এই বাহিনী শুধু রক্ষক নয়, একেকজন মানবতার সৈনিক।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তিন বাহিনীর সক্ষমতা ও আধুনিকায়নে যুক্ত হয়েছে নতুন মাত্রা। আধুনিক যুদ্ধবিমান, সাবমেরিন, উন্নত নজরদারি ব্যবস্থা, সাইবার নিরাপত্তা ও প্রযুক্তিগত শক্তি—সব মিলিয়ে সশস্ত্র বাহিনী আজ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম শক্তিশালী বাহিনীতে পরিণত হয়েছে। দেশের অগ্রগতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে প্রতিরক্ষা নীতিও সময়োপযোগী হচ্ছে, যা জাতীয় নিরাপত্তাকে আরও সুদৃঢ় করছে।
প্রতি বছরের মতো এবারও ২১ নভেম্বর দিবসটি উদযাপিত হচ্ছে যথাযোগ্য মর্যাদায়। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী ঢাকায় সেনাকুঞ্জে ত্রিবাহিনী প্রধানদের সঙ্গে নিয়ে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। সেনানিবাসসহ বিভিন্ন স্থানে অনুষ্ঠিত হয় কুচকাওয়াজ, দরবার, মিলাদ মাহফিল ও পদক প্রদান অনুষ্ঠান। গণমাধ্যমে প্রচারিত হয় বিশেষ প্রতিবেদন, আর সাধারণ মানুষও শ্রদ্ধা জানায় দেশের সাহসী রক্ষকদের।
সশস্ত্র বাহিনী দিবস তাই শুধু একটি ইতিহাস স্মরণ নয়—এটি আত্মত্যাগ, বীরত্ব ও দায়িত্ববোধের প্রতি জাতির শ্রদ্ধা। ১৯৭১ সালের গৌরবময় সেই দিনের চেতনাই আজ দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার প্রেরণা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা, নিরাপত্তা এবং অগ্রগতির পেছনে যে শক্তিটি অটলভাবে দাঁড়িয়ে আছে—সেই সশস্ত্র বাহিনীকে সম্মান জানাতেই ২১ নভেম্বর আজও জাতি গর্বে উচ্চারণ করে: “এই দেশ, এই পতাকা—রক্ষায় আমরা ঐক্যবদ্ধ।”
লেখক : মোহাম্মদ আলী সুমন,
সাংবাদিক ও সংগঠক।
সম্পাদক ও প্রকাশক: কামরুজ্জামান জনি
Copyright © 2025 Muktirlorai | মুক্তির লড়াই. All rights reserved.