
মহান বিজয়ের মাসের ৪ ডিসেম্বর ১৯৭১, দেশের পূর্ব ও উত্তরাঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত গতি শুরু হয় এবং একই দিনে কুমিল্লার দেবিদ্বারসহ বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দখল থেকে পুরোপুরি মুক্ত হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে সংগঠিত মুজিবনগর সরকারের সামরিক নির্দেশনা, মুক্তিবাহিনীর সেক্টরভিত্তিক অপারেশন এবং ভারতীয় মিত্রবাহিনীর সম্মিলিত আক্রমণের ফলে এই দিনটি পরিণত হয় মুক্তিযুদ্ধের মাইলফলক মুহূর্তে। দিনটি ভোর থেকেই পূর্বাঞ্চলে মুক্তিযোদ্ধারা তীব্র আক্রমণে কুমিল্লার বৃহৎ অংশকে দখলমুক্ত করতে সক্ষম হয় এবং বিশেষত দেবিদ্বার উপজেলা যা তৎকালীন কুমিল্লার অন্যতম কৌশলগত করিডোর সেদিন স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের বজ্রগতির আক্রমণে মুক্ত এলাকায় পরিণত হয়। দেবিদ্বারের গোরাজার বাজার, রামনগর, এলাহাবাদ, বরকামতা, রাজামেহার, ফতেহাবাদসহ বিভিন্ন এলাকায় পাক হানাদার বাহিনীর টহল পোস্ট ও ঘাঁটিতে মুক্তিবাহিনী আকস্মিক আক্রমণ করলে হানাদাররা ভয়াবহ ক্ষয়ক্ষতির মুখে পালিয়ে যায়। এর আগে হানাদার বাহিনী দেবিদ্বারের বিভিন্ন গ্রামে গণহত্যা ও লুটপাট চালিয়েছিল, কিন্তু ৪ ডিসেম্বরের ঐতিহাসিক প্রতিরোধে সেসব নিপীড়নের অবসান ঘটে এবং মুক্তিযোদ্ধারা দেবিদ্বারকে আনুষ্ঠানিকভাবে হানাদারমুক্ত ঘোষণা করেন। একই দিনে কুমিল্লা জেলার পরিচিত করিডোর দাউদকান্দি, চান্দিনা, বুড়িচং এবং তিতাসের বড় একটি অংশেও মুক্তিযোদ্ধারা শক্ত অবস্থান দখল করেন, ফলে ঢাকা–চট্টগ্রাম সড়কে পাকিস্তানি বাহিনীর যোগাযোগ ভেঙে পড়ে।
একই দিনে উত্তরের দিকে চলে গেলে দেখা যায় ৪ ডিসেম্বর সবচেয়ে বড় মুক্তাঞ্চল গঠিত হয় ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, লালমনিরহাট ও দিনাজপুরের বিস্তৃত এলাকায়। ঠাকুরগাঁওয়ে পাক সেনাদের সদর ঘাঁটি ভেঙে পড়লে সমগ্র অঞ্চল পতন হয়। পঞ্চগড়ে বোদা, দেবীগঞ্জ, তেতুলিয়া, আটোয়ারী এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের বহুদিনের প্রস্তুত আক্রমণে পাক সেনারা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। লালমনিরহাটে রেলস্টেশন, সেতু, ট্রানজিট ক্যাম্প, পাকিস্তানি যোগাযোগ ব্যারাক সবগুলোতে একযোগে আঘাতে হানাদার বাহিনী দিশেহারা হয়ে পলায়নপর হয়। দিনাজপুরে পার্বতীপুর–বিরামপুর বোচাগঞ্জ করিডোরে তীব্র গোলাবর্ষণে পাক বাহিনী সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ে এবং উত্তরাঞ্চলের সামরিক নিয়ন্ত্রণ মুক্তিবাহিনীর হাতে এসে যায়।
৪ ডিসেম্বরের একদিনেই পূর্বাঞ্চলের দেবিদ্বার থেকে উত্তরাঞ্চলের ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, লালমনিরহাট ও দিনাজপুর পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চল একযোগে মুক্ত হওয়ায় পাকিস্তানি ‘ইস্টার্ন কমান্ড’-এর শক্তি ভেঙে পড়ে এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার পথ আরও সুগম হয়। বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তান কারাগারে বন্দী রেখে তার আদর্শকে দমিয়ে রাখার চেষ্টা সফল হয়নি; তাঁর নেতৃত্বে গঠিত মুজিবনগর সরকারের নির্দেশনা ও জনগণের ঐক্য মুক্তিযুদ্ধকে এই দিনে এনে দেয় অসামান্য বিজয়ের ধারায়। ৪ ডিসেম্বর তাই শুধু মুক্তাঞ্চল বিস্তারের দিন নয় এটি ছিল এমন এক দিন, যখন দেবিদ্বারের মতো গ্রামীণ জনপদ থেকে শুরু করে দিনাজপুর–ঠাকুরগাঁওয়ের সীমান্ত ঘেঁষা অঞ্চলেও একসঙ্গে উঠেছিল বিজয়ের জয়ধ্বনি, আর নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা আর রুদ্ধ করার শক্তি পৃথিবীর কোনো বাহিনীর নেই।
লেখক : মোহাম্মদ আলী সুমন, সাংবাদিক ও সংগঠক।
সম্পাদক ও প্রকাশক: কামরুজ্জামান জনি
Copyright © 2025 Muktirlorai | মুক্তির লড়াই. All rights reserved.