
১৯৭১ সালের উত্তাল ডিসেম্বর। পুরো দেশজুড়ে তখন মুক্তিযুদ্ধ চূড়ান্ত পর্বে—একদিকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর পশ্চাদপসরণ, অন্যদিকে মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্রবাহিনীর অগ্রযাত্রা। তারই ধারাবাহিকতায় ৬ ডিসেম্বর কৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জেলা ফেনী সম্পূর্ণ মুক্ত হয়। শুভপুর থেকে বিলোনিয়া, ছাগলনাইয়া থেকে মহিপাল—প্রতিটি রণাঙ্গনে এই দিনে সৃষ্টি হয় অদম্য প্রতিরোধের অসংখ্য মহাকাব্য; বধ্যভূমি, লাশের স্তুপ, ধ্বংসস্তূপ পেরিয়ে ধ্বনিত হয় বিজয়ের আনন্দধ্বনি।
এই দিনটি শুধু ফেনী নয়, গোটা বাংলাদেশের ইতিহাসেও বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ—৬ ডিসেম্বরই প্রথম দেশ হিসেবে ভুটানের রাজা জিগমে দর্জি ওয়াংচুক (তৃতীয় রাজা) বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে পাকিস্তানের গণহত্যা, শরণার্থী সংকট, এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার ন্যায়সঙ্গত দাবি ভুটানের রাজপরিবারকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল।
সিদ্ধান্তের পরপরই ভুটান সরকার একটি আনুষ্ঠানিক টেলিগ্রাম পাঠায় প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের কাছে।
গ্রহীতা ছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি।
এই টেলিগ্রামে ভুটান বাংলাদেশকে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়, এবং ভবিষ্যতে বন্ধুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের আগ্রহ জানায়। ঐতিহাসিকভাবে ভুটানই প্রথম দেশ, যারা আনুষ্ঠানিক দলিল, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও কূটনৈতিক রেকর্ড অনুযায়ী বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এবং ওইদিন অল্প কিছু সময় পরেই ভারত বাংলাদেশকে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ঐদিন লোকসভায় দাঁড়িয়ে ঘোষণা করেন, “বাংলাদেশের জনগণ পাকিস্তানি স্বৈরতন্ত্র ও গণহত্যার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করলো।” ভারতের এ সিদ্ধান্ত মুহূর্তেই জানানো হয় সোভিয়েত ইউনিয়নকে। একইদিন বিকেলে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ধন্যবাদ জানিয়ে ইন্দিরা গান্ধীকে তারবার্তা পাঠান। এই স্বীকৃতি পাকিস্তানকে কূটনৈতিক চাপে ফেলে দেয়; মাত্র পাঁচ ঘণ্টা পর পাকিস্তান ভারত সঙ্গে সব ধরনের কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে। এদিকে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে সোভিয়েত ইউনিয়ন দ্বিতীয়বারের মতো ভেটো দেন—যা মুক্তিযুদ্ধকে বিজয়ের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পথ আরও সুগম করে।
দেশব্যাপীও এই দিনে ঘটে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ সামরিক জয়। ৬ ডিসেম্বর ফেনী, যশোর, মেহেরপুর, ঝিনাইদহ, কুড়িগ্রাম, সুনামগঞ্জ ও লালমনিরহাট হানাদার মুক্ত হয়। যশোরে অবস্থানরত পাকিস্তানি নবম ডিভিশন মুক্তিবাহিনীর চাপ সইতে না পেরে ক্যান্টনমেন্ট ছেড়ে মাগুরার দিকে পালিয়ে যায়; এর আগে চৌগাছা-ঝিকরগাছা সংলগ্ন কাবিলপুর গোয়ালহাটিতে হানাদারদের দখলদারিত্ব ছিল।
মেহেরপুরে ভারতের তেহট্ট ক্যাম্প থেকে যোদ্ধারা প্রবেশ করে দারিয়াপুর হয়ে কোলা গ্রাম পর্যন্ত এসে তীব্র আক্রমণে হানাদার বাহিনীকে পিছু হটতে বাধ্য করে। ৬ ডিসেম্বর সকালে ‘জয় বাংলা’ ধ্বনিতে মুক্তিযোদ্ধারা মেহেরপুরে প্রবেশ করেন।
অন্যদিকে, পাকিস্তানি বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার জেনারেল নিয়াজি ঢাকার প্রতিরক্ষা জোরদারের নির্দেশ দিলেও যশোর-ঢাকা সড়ক ইতোমধ্যেই মিত্রবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়ায় তাঁর এ পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। ফলে ঝিনাইদহ ত্যাগ করে পালানোর সময় শহরটি পুরোপুরি মুক্ত হয়।
সুনামগঞ্জে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর ত্রিমুখী আক্রমণে হানাদার বাহিনী দক্ষিণ দিকের সড়ক ও হাওর পথ ধরে পালিয়ে যায়। একইদিন ছাতক শহর মুক্ত হয় এবং পাক সেনারা পশ্চাদপসরণ করে সিলেটের লামাকাজী এলাকায় চলে যায়।
আর ফেনীতে—মুক্তিযোদ্ধারা একের পর এক গেরিলা আক্রমণ, ট্রেঞ্চ যুদ্ধ, সেতু-রাস্তায় অবরোধ, রাতভর সম্মুখসমরের মধ্য দিয়ে শত্রুদের প্রতিরোধ ভেঙে দেন। ফেনী শহরের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পাকিস্তানি সেনারা বিলোনিয়া সীমান্তের দিকে পালানোর চেষ্টা করলে মুক্তিযোদ্ধারা চূড়ান্ত আঘাত হানেন। শুভপুর বধ্যভূমির ক্ষত, ছাগলনাইয়ার নির্যাতিত জনপদ, মহিপালের ধ্বংসস্তূপ—সবকিছু মিলিয়ে এই দিনের বিজয় ছিল গভীর শোক ও সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অর্জিত। অবশেষে ৬ ডিসেম্বর সকালে ফেনীর আকাশে উড়তে থাকে লাল-সবুজের বিজয় পতাকা।
৬ ডিসেম্বর তাই শুধু একটি তারিখ নয়—এটি একটি বীরত্বগাথা, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির দিন, মুক্তিযোদ্ধাদের অদম্য ত্যাগের স্মারক। ফেনীসহ মুক্ত হওয়া প্রতিটি জেলা, প্রতিটি যোদ্ধা, প্রতিটি ত্যাগী মানুষের রক্ত ও অশ্রু মিলেই লিখেছে বাংলাদেশের চূড়ান্ত বিজয়ের প্রাক্কালের এই অমর ইতিহাস।
লেখক : মোহাম্মদ আলী সুমন, সাংবাদিক ও সংগঠক।
সম্পাদক ও প্রকাশক: কামরুজ্জামান জনি
Copyright © 2025 Muktirlorai | মুক্তির লড়াই. All rights reserved.