
-----------------------------
মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর সাঁড়াশি আক্রমণ; নিয়াজীর কণ্ঠে হতাশা; সপ্তম নৌবহর নিয়ে মার্কিন ষড়যন্ত্র ব্যর্থ
--------------------------------
ঢাকা, ৯ ডিসেম্বর, ১৯৭১: নয় মাস ধরে চলা রক্তক্ষয়ী মহান মুক্তিযুদ্ধের শেষ প্রান্তে এসে, ১৯৭১ সালের ৯ ডিসেম্বর দিনটি ছিল বাঙালির জন্য এক অভাবনীয় বিজয়ের পূর্বাভাস এবং হানাদার বাহিনীর জন্য সর্বাত্মক হতাশার দিন। এদিন থেকেই শুরু হয় মুক্তিকামী মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় মিত্রবাহিনীর সম্মিলিত শক্তির চূড়ান্ত ঢাকা দখল লড়াই। চারদিক থেকে মিত্রবাহিনী দুর্বার গতিতে রাজধানী ঢাকার দিকে অগ্রসর হতে শুরু করে।
ঢাকার পতন নিশ্চিত:
নিয়াজীর স্বীকারোক্তি মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর সম্মিলিত আক্রমণের মুখে সেদিন সকালে হানাদার বাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডের সদর দপ্তর ঢাকা থেকে জেনারেল এ. এ. কে. নিয়াজী প্রথমবারের মতো স্বীকার করেন যে, পরিস্থিতি "নিদারুণ সংকটপূর্ণ"। আকাশে মিত্রবাহিনীর পূর্ণ কর্তৃত্বের কারণে কোনো প্রকার সামরিক পুনর্বিন্যাসকরণ (reinforcement) বা বাইরে থেকে হানাদার বাহিনীর প্রবেশ সম্পূর্ণরূপে রুদ্ধ হয়ে যায়। নিয়াজী কার্যত ঢাকার পতন নিশ্চিত হওয়ারই হতাশা জানিয়ে একটি জরুরি সাংকেতিক বার্তা (signal) সেদিন রাওয়ালপিন্ডিতে পাঠান।
একের পর এক জনপদ মুক্ত:
এদিন মিত্রবাহিনী এবং মুক্তিসেনাদের সাঁড়াশি আক্রমণে একে একে গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ও কৌশলগত স্থানগুলো দ্রুত নিয়ন্ত্রণে চলে আসে।
দাউদকান্দি ও মেঘনার পূর্বাঞ্চল: দাউদকান্দি শত্রুমুক্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে মূলত মেঘনার সম্পূর্ণ পূর্বাঞ্চল মুক্তিবাহিনীর দখলে আসে। কুমিল্লা মুক্ত হওয়ার খবর চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে দাউদকান্দির মুক্তিযোদ্ধারা দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসরদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। মুক্তিবাহিনীর হামলায় টিকতে না পেরে পাক হানাদার বাহিনী ঢাকার দিকে পালিয়ে যায়।
কৌশলগত স্থানের পতন: আশুগঞ্জ, দাউদকান্দি, চাঁদপুর এবং ময়মনসিংহ জেলাও এদিন শত্রুমুক্ত হয়, যা ঢাকার চারপাশের বেষ্টনী (encirclement) কে আরও দৃঢ় করে তোলে।
শত্রুমুক্ত হওয়া অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ এলাকা:
৯ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আরও বহু গুরুত্বপূর্ণ এলাকা শত্রুমুক্ত হওয়ার খবর আসে, গাইবান্ধা, কপিলমুনি, ত্রিশাল, নকলা, ঈশ্বরগঞ্জ, নেত্রকোণা, পাইকগাছা, কুমারখালী, শ্রীপুর, অভয়নগর, পূর্বধলা, এবং চট্টগ্রামের নাজিরহাটসহ বিভিন্ন এলাকা এই দিনে শত্রুমুক্ত হয়।
আমেরিকান ষড়যন্ত্র-সপ্তম নৌবহরের আগমন:
বিজয়ের এই চূড়ান্ত মুহূর্তেও মুক্তিযুদ্ধকে নস্যাৎ করে দেওয়ার জন্য পাকিস্তানের সহযোগী যুক্তরাষ্ট্রের প্রচেষ্টা থেমে থাকেনি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে একটি চরম কূটনৈতিক ও সামরিক চাপ সৃষ্টির অংশ হিসেবে এদিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন তাঁর বিখ্যাত সপ্তম নৌবহরকে বঙ্গোপসাগরের দিকে রওনা হওয়ার আদেশ দেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই পদক্ষেপের উদ্দেশ্য ছিল রণাঙ্গনে যুদ্ধরত মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল ভেঙে দেওয়া। তবে, আমেরিকান এই প্রকাশ্য ষড়যন্ত্র সেদিন সফল হতে পারেনি।
৯ ডিসেম্বর ১৯৭১ ছিল সেই দিন, যেদিন বাঙালি জাতি উপলব্ধি করে বিজয় অত্যাসন্ন।
লেখক : মোহাম্মদ আলী সুমন, সাংবাদিক ও সংগঠক।
সম্পাদক ও প্রকাশক: কামরুজ্জামান জনি
Copyright © 2025 Muktirlorai | মুক্তির লড়াই. All rights reserved.