ঢাকা ০৩:৩২ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৩ নভেম্বর ২০২৫, ২৯ কার্তিক ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম
Logo সুনামগঞ্জে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া চক্রের মূলহোতা সহ ৬জন গ্রেপ্তার Logo বাঁশখালীতে বিপুল পরিমাণ দেশীয় অস্ত্রসহ ৫জন আটক Logo বিএনপির প্রার্থী ঘোষণায় নাটোরে দ্বিধা বিভক্ত দলীয় রাজনীতি: আত্মঘাতী ফলাফলের আশংকা Logo অবসরের পর জেলা পরিষদের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মানবেতর জীবন-যাপন Logo বরুড়া আগানগরে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির অভিযোগ কেন্দ্রের উদ্বোধন Logo লালমনিরহাটে আওয়ামী লীগের ৫ নেতাকর্মী গ্রেফতার Logo নওগাঁর রাণীনগরে ইট ভাটা বন্ধের প্রতিবাদে বিক্ষোভ ও স্মারকলিপি প্রদান Logo চিতলমারীতে বদনা-গয়না ফিরে পেলেন সেই ভুক্তভোগী গৃহবধূ, বরখাস্ত -২ Logo আইওসি সভাপতি কভেন্ট্রির প্রথম চীন সফর শুরু, প্রশংসায় ভাসালেন জাতীয় গেমসকে Logo বিশ্বজুড়ে ঐক্য ও শান্তি প্রচারে আইওসি’র সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী চীন

অবসরের পর জেলা পরিষদের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মানবেতর জীবন-যাপন

শেখ মহিউদ্দিন রাসেল

বাংলাদেশের প্রশাসনিক কাঠামোয় স্থানীয় সরকার একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তর। স্থানীয় সরকারের অন্যতম প্রতিষ্ঠান হচ্ছে জেলা পরিষদ। কেন্দ্রীয় সরকারের উন্নয়ন কার্যক্রমের পাশাপাশি জেলা পরিষদ জেলার স্থানীয় উন্নয়ন, অবকাঠামো, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক কল্যাণমূলক কর্মকাণ্ডসহ মানুষের মৌলিক মানবিক চাহিদাগুলো পূরণে যুগ যুগ ধরে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে এখনো পর্যন্ত জেলা পরিষদের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা সরকারি পেনশন সুবিধার আওতায় আসেননি। একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হলেও জেলা পরিষদ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সরকারি কর্মচারীদের ন্যায় জেলা পর্যায়ে সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বাস্তবায়নে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। তাছাড়া সকল উন্নয়ন কাজ জেলার অভিভাবক হিসেবে তদারকি করেন।
বর্তমানে বাংলাদেশে জেলা পরিষদের কর্মচারীরা স্থানীয় সরকার (জেলা পরিষদ) আইন, ২০০০ অনুযায়ী পরিচালিত হয়। জেলা পরিষদ কর্মচারীর এখনো সরকারি পেনশন ব্যবস্থার আওতায় আসা হয়নি, কারণ জেলা পরিষদ চাকরি “স্থানীয় সরকার পরিষদ” হিসেবে বিবেচিত হয়, সরাসরি সরকারি চাকরি নয়।

জেলা পরিষদের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা মাঠ পর্যায়ের প্রকল্প তদারকি, রাস্তাঘাট ও জনসেবামূলক অবকাঠামো নির্মাণ, স্থানীয় বিদ্যালয় ও স্বাস্থ্যকেন্দ্র,ব্রীজ, মসজিদ, মাদ্রাসা, মন্দিরসহ সার্বিক উন্নয়ন এবং দুর্যোগ মোকাবেলা, অসচ্ছল ব্যক্তিদের অনুদান প্রদান, সরকারের সকল নির্দেশনাসহ বহু গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে আসছে।

এছাড়াও প্রাচীনতম ডাকবাংলো, যাত্রী ছাউনী সেবা দিয়ে আসছে। অথচ সরকারি কর্মচারীদের মতো জেলা পরিষদ কর্মচারীদের অবসরের পর কোনো স্থায়ী আর্থিক সুবিধার নিশ্চয়তা নেই। দীর্ঘদিন চাকরি শেষে এককালীন সামান্য অর্থ বা অনুদান পেয়ে তাঁরা কর্মজীবনের পরবর্তী সময়ে আর্থিক অনিশ্চয়তার মুখোমুখি হন। জেলা পরিষদ কর্মচারীদের ভবিষ্যৎ এক অনিশ্চয়তার দিকে ধাবিত হয়। স্থানীয় সরকারের এ প্রতিষ্ঠানটি সৃষ্টির পর হতে জেলা পরিষদের হাজার হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী অবসর নিয়ে মানবেতর জীবন-যাপন করে অসুস্থ হয়ে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুবরণ করেছেন।

পেনশন কেবল একটি আর্থিক সুবিধা নয়। এটি কর্মজীবনের পরিশ্রমের স্বীকৃতি এবং অবসরের পর মর্যাদাপূর্ণ জীবনের নিশ্চয়তা। সরকারি কর্মকর্তা, শিক্ষক, বিভিন্ন সামরিক -বেসামরিক বাহিনী, এমনকি অনেক স্থানীয় সংস্থার কর্মচারীরাও এখন পেনশন পাচ্ছেন; অথচ জেলা পরিষদের কর্মচারীরা পুরোপুরি এই সুবিধা থেকে বঞ্চিত।
এতে করে জেলা পরিষদের কর্মীদের মনোবল ও প্রশাসনিক দক্ষতায় চরমভাবে প্রভাব ফেলছে। আর্থিক নিরাপত্তাহীনতা তাঁদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ব্যাহত করছে, যা প্রশাসনের স্থিতিশীলতা ও সেবার মানেও প্রভাব ফেলছে। অথচ এই প্রতিষ্ঠানে পূর্বে অর্থাৎ ১৯৮৭ সালের পর চেয়ারম্যান একজন উপমন্ত্রী এবং প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদার ছিলেন । বর্তমানে জেলা পরিষদে জেলা প্রশাসক প্রশাসক এবং প্রেষনে উপসচিব প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও সিনিয়র সহকারী সচিব পদমর্যাদার নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এ তিন অফিসারই বিসিএস প্রশাসনের কর্মকর্তা।

জেলা পরিষদের পেনশন সুবিধা চালু করার জন্য সরকারের নীতিগত পদক্ষেপ অত্যন্ত জরুরি। এজন্য স্থানীয় সরকার (জেলা পরিষদ) আইন, ২০০০-এ সংশোধন এনে জেলা পরিষদ কর্মচারীদের জন্য পেনশন বিধান সংযোজন করা যেতে পারে বলে আমি মনে করি।

একইসঙ্গে একটি “জেলা পরিষদ কর্মকর্তা-কর্মচারী (পেনশন) বিধিমালা” প্রণয়ন করা প্রয়োজন। যেখানে চাকরির মেয়াদ, অবসরকালীন সুবিধা, পেনশন হিসাবের ধরন ইত্যাদি স্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকবে। আশ্চর্যের বিষয় হলো, জেলা পরিষদের পূর্বতম প্রতিষ্ঠান ডিস্ট্রিক্ট বোর্ড থেকে অনেক প্রতিষ্ঠান বিশেষ করে এলজিডি, জনস্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সৃষ্টি হয়ে তাদের কর্মকর্তা- কর্মচারীরা পেনশন পেলেও জেলা পরিষদের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা পেনশন থেকে বঞ্চিত রয়েছেন।

বাংলাদেশের সার্বিক উন্নয়ন টেকসই করতে হলে স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করা জরুরি। জেলা পরিষদ সেই কাঠামোর একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। আর এর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সেই স্তম্ভের ভিত্তি। তাঁদের জীবনের পরবর্তী সময়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত না করা পর্যন্ত প্রকৃত বিকেন্দ্রীকরণ ও প্রশাসনিক স্থিতিশীলতা সম্ভব নয়।

পেনশনপ্রথা চালুর জন্য কিছু কার্যক্রম নেয়া যেতে পারে। বিশেষ করে স্থানীয় সরকার বিভাগ (এলজিডি), অর্থ মন্ত্রণালয় এবং জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের যৌথ উদ্যোগে একটি নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে যে জেলা পরিষদ কর্মচারীদেরও সরকারি কর্মচারীদের মতো পেনশন সুবিধা দেয়া হবে। এজন্য একটি কমিটি গঠন করে আর্থিক প্রভাব, জনবল কাঠামো ও বিদ্যমান বিধিবিধান বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন।

স্থানীয় সরকার (জেলা পরিষদ) আইন, ২০০০-এ পেনশন সংক্রান্ত ধারা সংযোজন বা সংশোধন করতে হবে। একটি “জেলা পরিষদ কর্মকর্তা-কর্মচারী (পেনশন) বিধিমালা” প্রণয়ন করতে হবে। পেনশন প্রদানের জন্য দুটি সম্ভাব্য ব্যবস্থা হতে পারে। সরকারি কোষাগার থেকে অর্থায়ন অর্থাৎ সরকারি পেনশন কাঠামোর সঙ্গে যুক্ত করা। জেলা পরিষদ পেনশন তহবিল গঠন করে পরিষদের নিজস্ব আয় ও সরকারি অনুদান থেকে অর্থ সংগ্রহ করা। জেলা পরিষদে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সেবা রেকর্ড ডিজিটালভাবে সংরক্ষণ করা হবে। প্রত্যেকের চাকরির ধরন, যোগদানের তারিখ ও অবসরের বয়স অনুযায়ী পেনশন হিসাব তৈরি করতে হবে। পেনশন প্রদান সংক্রান্ত কাজ তদারকি করার জন্য একটি পেনশন সেল গঠন করা যেতে পারে।

বাংলাদেশ জেলা পরিষদ কর্মকর্তা-কর্মচারী সমিতি বিষয়টি নিয়ে একটি সমন্বিত প্রস্তাব তৈরি করে স্থানীয় সরকার বিভাগে পাঠাতে পারে। স্থানীয় সরকার বিভাগ তা যাচাই-বাছাই করে অর্থ মন্ত্রণালয় ও মন্ত্রিসভায় অনুমোদনের জন্য প্রেরণ করতে পারে। সম্প্রতি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় জেলা পরিষদ কর্মকর্তা – কর্মচারীদের পেনশন প্রথা চালুর জন্য বিভিন্ন তথ্য চেয়ে জেলা পরিষদগুলোকে পত্র দেয়া হয়।

জেলা পরিষদ থেকে তথ্য প্রেরণ করা হলেও পরবর্তীতে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। তবে ১৫ অক্টোবর ২০২৫ তারিখে ২২৬০ নং স্মারকে স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে জেলা পরিষদের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পেনশন প্রদানের বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের মতামত চাওয়া হয়। অর্থ মন্ত্রণালয় পজিটিভ মতামত দিলে সরকারের কোন টাকা বরাদ্দ দিতে হবে না। জেলা পরিষদে আলাদা গ্র্যাচুইটির তহবিলসহ ব্যাংক হিসাব রয়েছে। শুধুমাত্র সরকার কর্তৃক অনুমোদন পেলেই নিজ তহবিল থেকে অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পেনশন প্রদানের ব্যবস্থা নিতে পারবে।

বাংলাদেশ জেলা পরিষদ কর্মকর্তা-কর্মচারী সমিতির সাবেক সভাপতি ও জেলা পরিষদের জ্যেষ্ঠ প্রশাসনিক কর্মকর্তা মোঃ এনামুল হক বশির আক্ষেপ করে বলেন, জেলা পরিষদের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এখনো পেনশন সুবিধা পাচ্ছে না।এটা চরম হতাশার কথা। অথচ এই প্রতিষ্ঠান থেকে বহু প্রতিষ্ঠানের জন্ম হয়েছে। সেই সব প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা পেনশন ভোগ করছে দীর্ঘদিন যাবত ; আর জেলা পরিষদের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা পেনশন থেকে বঞ্চিত হয়ে ভবিষ্যৎ জীবনে অনিশ্চয়তার মধ্যে ধাবিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। যা চরম বৈষম্যজনক। আমরা এই বৈষম্যের অবসান চাই।

বর্তমানে জেলা পরিষদের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য একটি কার্যকর পেনশন ব্যবস্থা প্রবর্তন সময়ের দাবি। সরকারের সদয় দৃষ্টি ও দ্রুত নীতিগত সিদ্ধান্তই পারে দীর্ঘদিনের জেলা পরিষদের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বঞ্চনার অবসান ঘটাতে। আর বৈষম্য দূরীকরণের সময় এখনই।
উল্লেখ্য, ১৮৭০ সালে গ্রাম চৌকিদারী আইন পাশের মাধ্যমে পল্লী অঞ্চলে এক স্তর বিশিষ্ট স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয়।

১৮১৭ সনে তৎকালীন বৃটিশ লেজিসলেটিভ কাউন্সিলে জিলা বোর্ড সেস কমিটি বিল উত্থাপিত হয় এবং ঐ বছরেই তা আইনে পরিণত হয়। এ আইনের অধীন প্রতিটি জেলায় জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে জেলা বোর্ড সেস কমিটি গঠিত হয়।১৮৭১ সালে দশম বেঙ্গল এ্যাক্ট এর অধীনে একটি রোড কমিটি গঠিত হয়। ১৮৭১ সাল হতে ১৮৮৫ সাল পর্যন্ত এ কমিটির অস্তিত্ব ছিল। স্থানীয় সরকার গঠনের এটিই ছিল প্রাথমিক পদক্ষেপ।

সেস কমিটির অভিজ্ঞতার আলোকে ১৮৮৫ সালে লোকাল সেলফ গভর্ণমেন্ট এ্যাক্ট প্রণীত হয় এবং রোড সেস কমিটির বদলে জেলা বোর্ডের সৃষ্টি হয়।

১৮৮৫ সালে লোকাল সেলফ গভর্নমেন্ট এ্যাক্ট বলে তৎকালীন বাংলায় ১৬টি জেলায় বিভিন্ন ডিস্ট্রিক্ট বোর্ড গঠিত হয়।১৯৫৯ সনে মৌলিক গণতন্ত্র আদেশের অধীন ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডকে নতুন আঙ্গিকে পরিণত করে। ডিস্ট্রিক্ট কাউন্সিল নামকরন করা হয়।

এ ব্যবস্থায় ১৯৬৩ সালে জেলা পরিষদের প্রথম নির্বাচন হয়। দ্বিতীয় এবং সর্বশেষ ১৯৬৬ সনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার পর স্বাধীনতা পরবর্তী কালে ১৯৭২ সনে নির্বাচিত পরিষদ ভেঙ্গে দিয়ে অন্তবর্তীকালীন ব্যবস্থা হিসেবে জেলা প্রশাসককে এর প্রশাসক করে ডিস্ট্রিক্ট কাউন্সিলের যাবতীয় কার্যাবলী পরিচালনা ও তত্ত্বাবধানের ক্ষমতা অর্পণ করা হয় এবং ডিস্ট্রিক্ট কাউন্সিলের স্থলে জেলা বোর্ড নামকরণ করা হয়। ১৯৭৬ সনের স্থানীয় সরকার অধ্যাদেশ জারী করা হয় এবং জেলা বোর্ডের নামকরণ করা হয় জেলা পরিষদ স্থানীয় সরকার (জেলা পরিষদ) আইন ২০০০। এই আইন দ্বারা জেলা পরিষদ বর্তমানে পরিচালিত হয়ে আসছে।

শেখ মহিউদ্দিন রাসেল,
প্রশাসনিক কর্মকর্তা (চঃ),
জেলা পরিষদ চাঁদপুর।

ট্যাগস
আপলোডকারীর তথ্য

সুনামগঞ্জে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া চক্রের মূলহোতা সহ ৬জন গ্রেপ্তার

SBN

SBN

অবসরের পর জেলা পরিষদের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মানবেতর জীবন-যাপন

আপডেট সময় ০১:০২:০৪ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৩ নভেম্বর ২০২৫

শেখ মহিউদ্দিন রাসেল

বাংলাদেশের প্রশাসনিক কাঠামোয় স্থানীয় সরকার একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তর। স্থানীয় সরকারের অন্যতম প্রতিষ্ঠান হচ্ছে জেলা পরিষদ। কেন্দ্রীয় সরকারের উন্নয়ন কার্যক্রমের পাশাপাশি জেলা পরিষদ জেলার স্থানীয় উন্নয়ন, অবকাঠামো, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক কল্যাণমূলক কর্মকাণ্ডসহ মানুষের মৌলিক মানবিক চাহিদাগুলো পূরণে যুগ যুগ ধরে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে এখনো পর্যন্ত জেলা পরিষদের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা সরকারি পেনশন সুবিধার আওতায় আসেননি। একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হলেও জেলা পরিষদ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সরকারি কর্মচারীদের ন্যায় জেলা পর্যায়ে সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বাস্তবায়নে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। তাছাড়া সকল উন্নয়ন কাজ জেলার অভিভাবক হিসেবে তদারকি করেন।
বর্তমানে বাংলাদেশে জেলা পরিষদের কর্মচারীরা স্থানীয় সরকার (জেলা পরিষদ) আইন, ২০০০ অনুযায়ী পরিচালিত হয়। জেলা পরিষদ কর্মচারীর এখনো সরকারি পেনশন ব্যবস্থার আওতায় আসা হয়নি, কারণ জেলা পরিষদ চাকরি “স্থানীয় সরকার পরিষদ” হিসেবে বিবেচিত হয়, সরাসরি সরকারি চাকরি নয়।

জেলা পরিষদের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা মাঠ পর্যায়ের প্রকল্প তদারকি, রাস্তাঘাট ও জনসেবামূলক অবকাঠামো নির্মাণ, স্থানীয় বিদ্যালয় ও স্বাস্থ্যকেন্দ্র,ব্রীজ, মসজিদ, মাদ্রাসা, মন্দিরসহ সার্বিক উন্নয়ন এবং দুর্যোগ মোকাবেলা, অসচ্ছল ব্যক্তিদের অনুদান প্রদান, সরকারের সকল নির্দেশনাসহ বহু গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে আসছে।

এছাড়াও প্রাচীনতম ডাকবাংলো, যাত্রী ছাউনী সেবা দিয়ে আসছে। অথচ সরকারি কর্মচারীদের মতো জেলা পরিষদ কর্মচারীদের অবসরের পর কোনো স্থায়ী আর্থিক সুবিধার নিশ্চয়তা নেই। দীর্ঘদিন চাকরি শেষে এককালীন সামান্য অর্থ বা অনুদান পেয়ে তাঁরা কর্মজীবনের পরবর্তী সময়ে আর্থিক অনিশ্চয়তার মুখোমুখি হন। জেলা পরিষদ কর্মচারীদের ভবিষ্যৎ এক অনিশ্চয়তার দিকে ধাবিত হয়। স্থানীয় সরকারের এ প্রতিষ্ঠানটি সৃষ্টির পর হতে জেলা পরিষদের হাজার হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী অবসর নিয়ে মানবেতর জীবন-যাপন করে অসুস্থ হয়ে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুবরণ করেছেন।

পেনশন কেবল একটি আর্থিক সুবিধা নয়। এটি কর্মজীবনের পরিশ্রমের স্বীকৃতি এবং অবসরের পর মর্যাদাপূর্ণ জীবনের নিশ্চয়তা। সরকারি কর্মকর্তা, শিক্ষক, বিভিন্ন সামরিক -বেসামরিক বাহিনী, এমনকি অনেক স্থানীয় সংস্থার কর্মচারীরাও এখন পেনশন পাচ্ছেন; অথচ জেলা পরিষদের কর্মচারীরা পুরোপুরি এই সুবিধা থেকে বঞ্চিত।
এতে করে জেলা পরিষদের কর্মীদের মনোবল ও প্রশাসনিক দক্ষতায় চরমভাবে প্রভাব ফেলছে। আর্থিক নিরাপত্তাহীনতা তাঁদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ব্যাহত করছে, যা প্রশাসনের স্থিতিশীলতা ও সেবার মানেও প্রভাব ফেলছে। অথচ এই প্রতিষ্ঠানে পূর্বে অর্থাৎ ১৯৮৭ সালের পর চেয়ারম্যান একজন উপমন্ত্রী এবং প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদার ছিলেন । বর্তমানে জেলা পরিষদে জেলা প্রশাসক প্রশাসক এবং প্রেষনে উপসচিব প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও সিনিয়র সহকারী সচিব পদমর্যাদার নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এ তিন অফিসারই বিসিএস প্রশাসনের কর্মকর্তা।

জেলা পরিষদের পেনশন সুবিধা চালু করার জন্য সরকারের নীতিগত পদক্ষেপ অত্যন্ত জরুরি। এজন্য স্থানীয় সরকার (জেলা পরিষদ) আইন, ২০০০-এ সংশোধন এনে জেলা পরিষদ কর্মচারীদের জন্য পেনশন বিধান সংযোজন করা যেতে পারে বলে আমি মনে করি।

একইসঙ্গে একটি “জেলা পরিষদ কর্মকর্তা-কর্মচারী (পেনশন) বিধিমালা” প্রণয়ন করা প্রয়োজন। যেখানে চাকরির মেয়াদ, অবসরকালীন সুবিধা, পেনশন হিসাবের ধরন ইত্যাদি স্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকবে। আশ্চর্যের বিষয় হলো, জেলা পরিষদের পূর্বতম প্রতিষ্ঠান ডিস্ট্রিক্ট বোর্ড থেকে অনেক প্রতিষ্ঠান বিশেষ করে এলজিডি, জনস্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সৃষ্টি হয়ে তাদের কর্মকর্তা- কর্মচারীরা পেনশন পেলেও জেলা পরিষদের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা পেনশন থেকে বঞ্চিত রয়েছেন।

বাংলাদেশের সার্বিক উন্নয়ন টেকসই করতে হলে স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করা জরুরি। জেলা পরিষদ সেই কাঠামোর একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। আর এর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সেই স্তম্ভের ভিত্তি। তাঁদের জীবনের পরবর্তী সময়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত না করা পর্যন্ত প্রকৃত বিকেন্দ্রীকরণ ও প্রশাসনিক স্থিতিশীলতা সম্ভব নয়।

পেনশনপ্রথা চালুর জন্য কিছু কার্যক্রম নেয়া যেতে পারে। বিশেষ করে স্থানীয় সরকার বিভাগ (এলজিডি), অর্থ মন্ত্রণালয় এবং জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের যৌথ উদ্যোগে একটি নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে যে জেলা পরিষদ কর্মচারীদেরও সরকারি কর্মচারীদের মতো পেনশন সুবিধা দেয়া হবে। এজন্য একটি কমিটি গঠন করে আর্থিক প্রভাব, জনবল কাঠামো ও বিদ্যমান বিধিবিধান বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন।

স্থানীয় সরকার (জেলা পরিষদ) আইন, ২০০০-এ পেনশন সংক্রান্ত ধারা সংযোজন বা সংশোধন করতে হবে। একটি “জেলা পরিষদ কর্মকর্তা-কর্মচারী (পেনশন) বিধিমালা” প্রণয়ন করতে হবে। পেনশন প্রদানের জন্য দুটি সম্ভাব্য ব্যবস্থা হতে পারে। সরকারি কোষাগার থেকে অর্থায়ন অর্থাৎ সরকারি পেনশন কাঠামোর সঙ্গে যুক্ত করা। জেলা পরিষদ পেনশন তহবিল গঠন করে পরিষদের নিজস্ব আয় ও সরকারি অনুদান থেকে অর্থ সংগ্রহ করা। জেলা পরিষদে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সেবা রেকর্ড ডিজিটালভাবে সংরক্ষণ করা হবে। প্রত্যেকের চাকরির ধরন, যোগদানের তারিখ ও অবসরের বয়স অনুযায়ী পেনশন হিসাব তৈরি করতে হবে। পেনশন প্রদান সংক্রান্ত কাজ তদারকি করার জন্য একটি পেনশন সেল গঠন করা যেতে পারে।

বাংলাদেশ জেলা পরিষদ কর্মকর্তা-কর্মচারী সমিতি বিষয়টি নিয়ে একটি সমন্বিত প্রস্তাব তৈরি করে স্থানীয় সরকার বিভাগে পাঠাতে পারে। স্থানীয় সরকার বিভাগ তা যাচাই-বাছাই করে অর্থ মন্ত্রণালয় ও মন্ত্রিসভায় অনুমোদনের জন্য প্রেরণ করতে পারে। সম্প্রতি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় জেলা পরিষদ কর্মকর্তা – কর্মচারীদের পেনশন প্রথা চালুর জন্য বিভিন্ন তথ্য চেয়ে জেলা পরিষদগুলোকে পত্র দেয়া হয়।

জেলা পরিষদ থেকে তথ্য প্রেরণ করা হলেও পরবর্তীতে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। তবে ১৫ অক্টোবর ২০২৫ তারিখে ২২৬০ নং স্মারকে স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে জেলা পরিষদের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পেনশন প্রদানের বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের মতামত চাওয়া হয়। অর্থ মন্ত্রণালয় পজিটিভ মতামত দিলে সরকারের কোন টাকা বরাদ্দ দিতে হবে না। জেলা পরিষদে আলাদা গ্র্যাচুইটির তহবিলসহ ব্যাংক হিসাব রয়েছে। শুধুমাত্র সরকার কর্তৃক অনুমোদন পেলেই নিজ তহবিল থেকে অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পেনশন প্রদানের ব্যবস্থা নিতে পারবে।

বাংলাদেশ জেলা পরিষদ কর্মকর্তা-কর্মচারী সমিতির সাবেক সভাপতি ও জেলা পরিষদের জ্যেষ্ঠ প্রশাসনিক কর্মকর্তা মোঃ এনামুল হক বশির আক্ষেপ করে বলেন, জেলা পরিষদের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এখনো পেনশন সুবিধা পাচ্ছে না।এটা চরম হতাশার কথা। অথচ এই প্রতিষ্ঠান থেকে বহু প্রতিষ্ঠানের জন্ম হয়েছে। সেই সব প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা পেনশন ভোগ করছে দীর্ঘদিন যাবত ; আর জেলা পরিষদের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা পেনশন থেকে বঞ্চিত হয়ে ভবিষ্যৎ জীবনে অনিশ্চয়তার মধ্যে ধাবিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। যা চরম বৈষম্যজনক। আমরা এই বৈষম্যের অবসান চাই।

বর্তমানে জেলা পরিষদের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য একটি কার্যকর পেনশন ব্যবস্থা প্রবর্তন সময়ের দাবি। সরকারের সদয় দৃষ্টি ও দ্রুত নীতিগত সিদ্ধান্তই পারে দীর্ঘদিনের জেলা পরিষদের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বঞ্চনার অবসান ঘটাতে। আর বৈষম্য দূরীকরণের সময় এখনই।
উল্লেখ্য, ১৮৭০ সালে গ্রাম চৌকিদারী আইন পাশের মাধ্যমে পল্লী অঞ্চলে এক স্তর বিশিষ্ট স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয়।

১৮১৭ সনে তৎকালীন বৃটিশ লেজিসলেটিভ কাউন্সিলে জিলা বোর্ড সেস কমিটি বিল উত্থাপিত হয় এবং ঐ বছরেই তা আইনে পরিণত হয়। এ আইনের অধীন প্রতিটি জেলায় জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে জেলা বোর্ড সেস কমিটি গঠিত হয়।১৮৭১ সালে দশম বেঙ্গল এ্যাক্ট এর অধীনে একটি রোড কমিটি গঠিত হয়। ১৮৭১ সাল হতে ১৮৮৫ সাল পর্যন্ত এ কমিটির অস্তিত্ব ছিল। স্থানীয় সরকার গঠনের এটিই ছিল প্রাথমিক পদক্ষেপ।

সেস কমিটির অভিজ্ঞতার আলোকে ১৮৮৫ সালে লোকাল সেলফ গভর্ণমেন্ট এ্যাক্ট প্রণীত হয় এবং রোড সেস কমিটির বদলে জেলা বোর্ডের সৃষ্টি হয়।

১৮৮৫ সালে লোকাল সেলফ গভর্নমেন্ট এ্যাক্ট বলে তৎকালীন বাংলায় ১৬টি জেলায় বিভিন্ন ডিস্ট্রিক্ট বোর্ড গঠিত হয়।১৯৫৯ সনে মৌলিক গণতন্ত্র আদেশের অধীন ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডকে নতুন আঙ্গিকে পরিণত করে। ডিস্ট্রিক্ট কাউন্সিল নামকরন করা হয়।

এ ব্যবস্থায় ১৯৬৩ সালে জেলা পরিষদের প্রথম নির্বাচন হয়। দ্বিতীয় এবং সর্বশেষ ১৯৬৬ সনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার পর স্বাধীনতা পরবর্তী কালে ১৯৭২ সনে নির্বাচিত পরিষদ ভেঙ্গে দিয়ে অন্তবর্তীকালীন ব্যবস্থা হিসেবে জেলা প্রশাসককে এর প্রশাসক করে ডিস্ট্রিক্ট কাউন্সিলের যাবতীয় কার্যাবলী পরিচালনা ও তত্ত্বাবধানের ক্ষমতা অর্পণ করা হয় এবং ডিস্ট্রিক্ট কাউন্সিলের স্থলে জেলা বোর্ড নামকরণ করা হয়। ১৯৭৬ সনের স্থানীয় সরকার অধ্যাদেশ জারী করা হয় এবং জেলা বোর্ডের নামকরণ করা হয় জেলা পরিষদ স্থানীয় সরকার (জেলা পরিষদ) আইন ২০০০। এই আইন দ্বারা জেলা পরিষদ বর্তমানে পরিচালিত হয়ে আসছে।

শেখ মহিউদ্দিন রাসেল,
প্রশাসনিক কর্মকর্তা (চঃ),
জেলা পরিষদ চাঁদপুর।