ঢাকা ০১:০৪ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৬ ডিসেম্বর ২০২৫, ২ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম
Logo আদালতের রায় পক্ষে থাকার পরও ৩.৮৪ একর জমিতে চাষ করতে পারছেন না কৃষক ইসমাইল Logo কুমিল্লা টাউন হল মাঠে বিজয় মেলা নাকি বাণিজ্য মেলা Logo আজ ১৬ ডিসেম্বর: মহাবিজয়ের আলোয় উদ্ভাসিত একাত্তরের রণক্ষেত্রের চূড়ান্ত ইতিহাস Logo নলছিটিতে ৪০টি টিউবওয়েল বিতরণ Logo অবৈধ ড্রেজারে ধ্বংসের মুখে বারেশ্বর বিলের তিন ফসলি জমি Logo কালীগঞ্জে ভাটা উচ্ছেদে এসে শ্রমিকদের বাধায় ফিরে গেলেন পরিবেশ অধিপ্তর Logo সৈয়দপুর সরকারি বিজ্ঞান কলেজ থেকে ৫১ শিক্ষার্থী মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষায় উত্তির্ন Logo ১৬ই ডিসেম্বর: মুক্তির লড়াই, গণঅভ্যুত্থান ও নতুন বাংলাদেশের প্রত্যাশা Logo চীনের অর্থনীতি: চাপ সামলেও শক্তিশালী অগ্রগতি Logo বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে শক্তিশালী রাষ্ট্র গড়ার লক্ষ্যে চীন

আজ ১৬ ডিসেম্বর: মহাবিজয়ের আলোয় উদ্ভাসিত একাত্তরের রণক্ষেত্রের চূড়ান্ত ইতিহাস

১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের ইতিহাসে চিরভাস্বর এক দিন। এই দিনটি কেবল একটি তারিখ নয়, এটি বাঙালি জাতির আত্মপরিচয়ের চূড়ান্ত ঘোষণা, দীর্ঘ শোষণ-বঞ্চনার অবসান এবং নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় পরিণতি। ১৯৭১ সালের এই দিনে ৩০ লাখ শহীদের আত্মদান, লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রম এবং বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অপরিসীম ত্যাগের বিনিময়ে পৃথিবীর মানচিত্রে জন্ম নেয় একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশ।

এই বিজয়ের পথচলা শুরু হয়েছিল বহু আগে। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণ বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতার চূড়ান্ত সংগ্রামের দিকনির্দেশনা দেয়। ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ‘অপারেশন সার্চলাইট’-এর নৃশংস গণহত্যা এবং বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা বাঙালিকে অস্ত্র হাতে নিতে বাধ্য করে। শুরু হয় নয় মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ গ্রাম থেকে শহর, নদী থেকে পাহাড় সমগ্র বাংলাদেশ পরিণত হয় রণক্ষেত্রে।

ডিসেম্বরের শুরুতেই যুদ্ধ পৌঁছে যায় চূড়ান্ত পর্যায়ে। ভারতীয় মিত্রবাহিনী ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সমন্বয়ে গঠিত যৌথ বাহিনীর সর্বাত্মক আক্রমণে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী দ্রুত কোণঠাসা হয়ে পড়ে। ১০ ডিসেম্বর পাকিস্তান নৌবাহিনীর জাহাজ ধ্বংস হয়ে গেলে তাদের নৌপথের যোগাযোগ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। আকাশে ভারতীয় বিমানবাহিনীর দাপটে ঢাকাসহ গুরুত্বপূর্ণ সামরিক স্থাপনা অচল হয়ে পড়ে। স্থলপথে মেঘনা নদী অতিক্রম, টাঙ্গাইলে ছত্রীসেনা অবতরণ এবং চারদিক থেকে রাজধানী ঘিরে ফেলার মাধ্যমে পাকিস্তানি বাহিনীর পরাজয় হয়ে ওঠে অবশ্যম্ভাবী।

পরাজয় নিশ্চিত জেনে ১৪ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসর আলবদর-আলশামস বাহিনী ইতিহাসের জঘন্যতম অপরাধ সংঘটিত করে। জাতিকে মেধাশূন্য করার ষড়যন্ত্রে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয় দেশের শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিজীবীদের। সেই শোক আর ক্ষোভ নিয়েই ১৫ ডিসেম্বর এগিয়ে চলে বিজয়ের শেষ প্রস্তুতি। মিত্রবাহিনীর প্রধান জেনারেল স্যাম মানেকশ-এর কঠোর আলটিমেটামের মুখে পাকিস্তানি বাহিনীর প্রধান জেনারেল এ এ কে নিয়াজী নিঃশর্ত আত্মসমর্পণে বাধ্য হন।

অবশেষে আসে ১৬ ডিসেম্বর মহাবিজয়ের দিন। বিকেল ৪টা ৩১ মিনিটে ঢাকার ঐতিহাসিক রমনা রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) স্বাক্ষরিত হয় সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় সামরিক কমান্ডের প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজী যৌথ বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করেন। এর মধ্য দিয়ে ৯৩ হাজারেরও বেশি পাকিস্তানি সেনা বিশ্বের ইতিহাসে একসঙ্গে যুদ্ধবন্দী হয় যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সবচেয়ে বড় আত্মসমর্পণের ঘটনা।

আত্মসমর্পণের পর জেনারেল নিয়াজী তাঁর কোমরের পিস্তল অরোরার হাতে তুলে দেন এই মুহূর্তটি হয়ে ওঠে ঔপনিবেশিক ও সামরিক আগ্রাসনের চূড়ান্ত পরাজয়ের প্রতীক। সঙ্গে সঙ্গে লাল-সবুজের পতাকা উড়তে থাকে স্বাধীন বাংলাদেশের আকাশে। ঢাকাসহ সারাদেশে বাঁধভাঙা উল্লাসে ফেটে পড়ে মানুষ। ‘জয় বাংলা’, ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগানে মুখরিত হয় বাংলার আকাশ-বাতাস। আনন্দাশ্রু আর বিজয়ের হাসিতে মিলেমিশে যায় নয় মাসের শোক ও সংগ্রাম।

১৬ ডিসেম্বরের বিজয় কেবল একটি সামরিক সাফল্য নয়—এটি ছিল একটি আদর্শের বিজয়। এটি ছিল গণতন্ত্র, মানবিকতা, অসাম্প্রদায়িকতা এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিজয়। এই বিজয়ের মধ্য দিয়েই বাস্তবায়িত হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের স্বাধীন বাংলাদেশ।

আজ মহান বিজয় দিবসে আমরা গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করি সেই সকল শহীদ ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের, যাঁদের ত্যাগ ছাড়া এই বিজয় সম্ভব হতো না। আমাদের অঙ্গীকার হোক এই স্বাধীনতাকে রক্ষা করব মুক্তিযুদ্ধের চেতনায়, সত্য ও ন্যায়ের পথে, একটি ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত, জ্ঞানভিত্তিক ও মানবিক বাংলাদেশ গড়ে তুলে।

বিজয় আমাদের। এই পতাকার সম্মান রক্ষায় প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে আমরা থাকব অটুট।

লেখক : মোহাম্মদ আলী সুমন, সাংবাদিক ও সংগঠক।

ট্যাগস
আপলোডকারীর তথ্য

জনপ্রিয় সংবাদ

আদালতের রায় পক্ষে থাকার পরও ৩.৮৪ একর জমিতে চাষ করতে পারছেন না কৃষক ইসমাইল

SBN

SBN

আজ ১৬ ডিসেম্বর: মহাবিজয়ের আলোয় উদ্ভাসিত একাত্তরের রণক্ষেত্রের চূড়ান্ত ইতিহাস

আপডেট সময় ০৭:১৬:৫৫ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৬ ডিসেম্বর ২০২৫

১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের ইতিহাসে চিরভাস্বর এক দিন। এই দিনটি কেবল একটি তারিখ নয়, এটি বাঙালি জাতির আত্মপরিচয়ের চূড়ান্ত ঘোষণা, দীর্ঘ শোষণ-বঞ্চনার অবসান এবং নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় পরিণতি। ১৯৭১ সালের এই দিনে ৩০ লাখ শহীদের আত্মদান, লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রম এবং বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অপরিসীম ত্যাগের বিনিময়ে পৃথিবীর মানচিত্রে জন্ম নেয় একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশ।

এই বিজয়ের পথচলা শুরু হয়েছিল বহু আগে। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণ বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতার চূড়ান্ত সংগ্রামের দিকনির্দেশনা দেয়। ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ‘অপারেশন সার্চলাইট’-এর নৃশংস গণহত্যা এবং বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা বাঙালিকে অস্ত্র হাতে নিতে বাধ্য করে। শুরু হয় নয় মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ গ্রাম থেকে শহর, নদী থেকে পাহাড় সমগ্র বাংলাদেশ পরিণত হয় রণক্ষেত্রে।

ডিসেম্বরের শুরুতেই যুদ্ধ পৌঁছে যায় চূড়ান্ত পর্যায়ে। ভারতীয় মিত্রবাহিনী ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সমন্বয়ে গঠিত যৌথ বাহিনীর সর্বাত্মক আক্রমণে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী দ্রুত কোণঠাসা হয়ে পড়ে। ১০ ডিসেম্বর পাকিস্তান নৌবাহিনীর জাহাজ ধ্বংস হয়ে গেলে তাদের নৌপথের যোগাযোগ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। আকাশে ভারতীয় বিমানবাহিনীর দাপটে ঢাকাসহ গুরুত্বপূর্ণ সামরিক স্থাপনা অচল হয়ে পড়ে। স্থলপথে মেঘনা নদী অতিক্রম, টাঙ্গাইলে ছত্রীসেনা অবতরণ এবং চারদিক থেকে রাজধানী ঘিরে ফেলার মাধ্যমে পাকিস্তানি বাহিনীর পরাজয় হয়ে ওঠে অবশ্যম্ভাবী।

পরাজয় নিশ্চিত জেনে ১৪ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসর আলবদর-আলশামস বাহিনী ইতিহাসের জঘন্যতম অপরাধ সংঘটিত করে। জাতিকে মেধাশূন্য করার ষড়যন্ত্রে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয় দেশের শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিজীবীদের। সেই শোক আর ক্ষোভ নিয়েই ১৫ ডিসেম্বর এগিয়ে চলে বিজয়ের শেষ প্রস্তুতি। মিত্রবাহিনীর প্রধান জেনারেল স্যাম মানেকশ-এর কঠোর আলটিমেটামের মুখে পাকিস্তানি বাহিনীর প্রধান জেনারেল এ এ কে নিয়াজী নিঃশর্ত আত্মসমর্পণে বাধ্য হন।

অবশেষে আসে ১৬ ডিসেম্বর মহাবিজয়ের দিন। বিকেল ৪টা ৩১ মিনিটে ঢাকার ঐতিহাসিক রমনা রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) স্বাক্ষরিত হয় সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় সামরিক কমান্ডের প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজী যৌথ বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করেন। এর মধ্য দিয়ে ৯৩ হাজারেরও বেশি পাকিস্তানি সেনা বিশ্বের ইতিহাসে একসঙ্গে যুদ্ধবন্দী হয় যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সবচেয়ে বড় আত্মসমর্পণের ঘটনা।

আত্মসমর্পণের পর জেনারেল নিয়াজী তাঁর কোমরের পিস্তল অরোরার হাতে তুলে দেন এই মুহূর্তটি হয়ে ওঠে ঔপনিবেশিক ও সামরিক আগ্রাসনের চূড়ান্ত পরাজয়ের প্রতীক। সঙ্গে সঙ্গে লাল-সবুজের পতাকা উড়তে থাকে স্বাধীন বাংলাদেশের আকাশে। ঢাকাসহ সারাদেশে বাঁধভাঙা উল্লাসে ফেটে পড়ে মানুষ। ‘জয় বাংলা’, ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগানে মুখরিত হয় বাংলার আকাশ-বাতাস। আনন্দাশ্রু আর বিজয়ের হাসিতে মিলেমিশে যায় নয় মাসের শোক ও সংগ্রাম।

১৬ ডিসেম্বরের বিজয় কেবল একটি সামরিক সাফল্য নয়—এটি ছিল একটি আদর্শের বিজয়। এটি ছিল গণতন্ত্র, মানবিকতা, অসাম্প্রদায়িকতা এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিজয়। এই বিজয়ের মধ্য দিয়েই বাস্তবায়িত হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের স্বাধীন বাংলাদেশ।

আজ মহান বিজয় দিবসে আমরা গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করি সেই সকল শহীদ ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের, যাঁদের ত্যাগ ছাড়া এই বিজয় সম্ভব হতো না। আমাদের অঙ্গীকার হোক এই স্বাধীনতাকে রক্ষা করব মুক্তিযুদ্ধের চেতনায়, সত্য ও ন্যায়ের পথে, একটি ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত, জ্ঞানভিত্তিক ও মানবিক বাংলাদেশ গড়ে তুলে।

বিজয় আমাদের। এই পতাকার সম্মান রক্ষায় প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে আমরা থাকব অটুট।

লেখক : মোহাম্মদ আলী সুমন, সাংবাদিক ও সংগঠক।