আজিজ উদ্দিন, কক্সবাজার প্রতিনিধিঃ
কক্সবাজারে ২৮ দেশের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে আন্তর্জাতিক নৌশক্তি প্রদর্শন। বাংলাদেশ নৌবাহিনীর আয়োজনে আজ ৬ থেকে ৯ ডিসেম্বর উখিয়ার ইনানীর পাটুয়ারটেকস্থ বঙ্গোপসাগরে এই নৌশক্তি প্রদর্শন অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হবে।
নৌবাহিনীর সদর দপ্তর জানিয়েছে, মহড়ায় বাংলাদেশসহ ২৮ দেশের ৪৩টি যুদ্ধজাহাজ, ২টি বিএন এমপিএ, ৪টি বিএন হেলিকপ্টার অংশ নিচ্ছে। ইতিমধ্যে সবধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছেন আয়োজকরা।
সামরিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মতে, এই নৌশক্তি প্রদর্শন বাংলাদেশের সক্ষমতার ক্ষেত্রে বিরাট মাইলফলক। তারা বলছেন, পারস্পরিক চেনা-জানার মধ্যদিয়ে অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠবে। এটি বিকাশমান জাতির জন্য মঙ্গলজনক।
বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে ‘সীমানা ছাড়িয়ে বন্ধুত্ব’ প্রতিপাদ্যে এই নৌশক্তি প্রদর্শন আগামীকাল ৭ ডিসেম্বর সকাল সাড়ে ১০টায় আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
বাংলাদেশ নৌবাহিনীর ওয়েবসাইট অনুসারে, মহড়ায় বাংলাদেশ ছাড়াও চীন, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, থাইল্যান্ড, চীন, মিয়ানমার ও মালয়েশিয়ার জাহাজসহ প্রায় ২৮টি দেশের নৌ-কমান্ডার, যুদ্ধ জাহাজ অংশ নেবেন।
এছাড়া যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ইতালি, নেদারল্যান্ডস, অস্ট্রেলিয়া, তুরস্ক, মিশর, নাইজেরিয়া, সুদান, মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কা, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, ইন্দোনেশিয়া, সিঙ্গাপুর, তিমুর-লেস্তে থেকে নৌ প্রতিনিধিরা অংশ নেবেন। মহড়ায় ইরান, ওমান, ফিলিস্তিন ও সৌদি আরবের প্রতিনিধিরাও উপস্থিত থাকবেন।
নৌবাহিনী সদর দপ্তর জানিয়েছে, প্রশান্ত মহাসাগরীয় মার্কিন নৌবহরের কমান্ডার অ্যাডমিরাল স্যামুয়েল জে পাপারো জুনিয়র, ভারতীয় নৌবাহিনী প্রধান অ্যাডমিরাল আর হরি কুমার এবং ভারতীয় কোস্টগার্ডের মহাপরিচালক বীরেন্দ্র সিং পাঠানিয়াসহ উধ্বতন সামরিক কর্মকর্তাবৃন্দ কক্সবাজার সফর করবেন।
এই সফরকালে বাংলাদেশ সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষকে কক্সবাজার বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশন, কাস্টমস পরিষেবা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ভারতসহ বন্ধুত্বপূর্ণ দেশগুলোর জন্য বিমান পার্কিং এবং নিরাপত্তা প্রদানসহ অতিরিক্ত সুবিধা চেয়েছেন তারা।
এ ব্যাপারে কক্সবাজার বিমানবন্দরের মহাব্যবস্থাপক গোলাম মর্তুজা হাসান বলেন, ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যেসব প্রতিনিধি আসবেন তারা ঢাকাতেই ইমিগ্রেশন শেষ করবেন। তবে ভারতীয় প্রতিনিধিগণ কক্সবাজার বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশন এবং বিমান পার্কিংসহ সুবিধাগুলো চেয়েছেন। আমরা তাদের সবধরনের সহায়তা দিতে প্রস্তুত আছি।’
এদিকে চীনের জাতীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, তাদের গাইডেড মিসাইল ডেস্ট্রয়ার চাংশা (হুল ১৭৩) এই নৌশক্তি প্রদর্শনীতে অংশ নিচ্ছে। অন্যদিকে রোহিঙ্গা সংকটের কারণে কিছুটা বৈরী সম্পর্ক থাকলেও প্রতিবেশী রাষ্ট্র মিয়ানমারের যুদ্ধ জাহাজ ‘কায়ান সিথা’ প্রদর্শনীতে থাকছেন।
এ ব্যাপারে নৌবাহিনীর গোয়েন্দা পরিচালক কমডোর মনিরুজ্জামান জানিয়েছেন, আন্তর্জাতিক নৌশক্তি প্রদর্শনে প্রভাবশালী যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ভারতের প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করায় সবধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে।
সামরিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, আন্তর্জাতিক নৌশক্তি প্রদর্শন আয়োজনের মূল উদ্দেশ্য হবে প্রশান্ত মহাসাগরীয় নৌবাহিনীর মধ্যে সম্পর্ক গভীর করা।
এ ব্যাপারে সামরিক বিশ্লেষক অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল শহীদুল হক বলেন, ‘প্রথমবারের মতো নৌশক্তি প্রদর্শনের পর্যালোচনা হবে বিশ্বে বাংলাদেশের সক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ। তিনি বলেন, ‘এই আয়োজন অংশগ্রহণকারী রাষ্ট্রগুলো বাংলাদেশ সম্পর্কে ভাল দৃষ্টিভঙ্গি পড়বে।’
লিবিয়াস্থ বাংলাদেশের সাবেক এই রাষ্ট্রদূত অবশ্য, আন্তর্জাতিক এই অনুষ্ঠানের ভূ-রাজনৈতিক বা কৌশলগত প্রভাব দেখছেন না।
তবে নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর (অব:) এমদাদুল হক বলেছেন, ‘বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশের প্রয়োজন অংশগ্রহণকারী দেশগুলো বুঝতে পেরেছে। তারা বুঝতে পেরেছে, এই অঞ্চলে আমাদের গুরুত্ব।’
‘একইভাবে আমাদের নৌবাহিনীতে এখন সাবমেরিন, ফ্রিগেট যুক্ত হয়েছে। নেভাল এয়ারক্রাফটসহ কমান্ডো, হেলিকপ্টারসহ স্কোয়াডনও যুক্ত হয়েছে। এসব তারা কল্পনাও করেনি। সমুদ্র পাহারা দেওয়া এই যানগুলো একসময় ছিল না। তারা বুঝবে, বাংলাদেশেরও সক্ষমতা ত্রি-মাত্রিক। এই বিষয়গুলো এগিয়ে যাওয়ার জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ।’
মেজর (অব:) এমদাদুল হক দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের বিষয়টি উল্লেখ করে বলেন, ‘এখন তারাও আমাদের ডাকবে। পারস্পরিক চেনা-জানা বিকাশমান জাতির জন্য মঙ্গলজনক। কারো বৈরী মনোভাব থাকলেও বুঝবে বাংলাদেশের সক্ষমতা আছে, বন্ধু আছে। এসব দৃষ্টিকোন থেকে এই মহড়া খুবই ভালো উদ্যোগ।’
নৌবাহিনী সদর দপ্তর বলছে, এই আয়োজন বিশ্বের নৌবাহিনীর জন্য একটি আদর্শ প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজ করবে। যাতে তারা বাংলাদেশের জলসীমায় বিশ্ব নৌবাহিনীর সাথে যোগাযোগের পাশাপাশি তাদের দক্ষতা, নৌ কূটনীতি, শুভেচ্ছা ও সহযোগিতা প্রদর্শন করতে পারে। পাশাপাশি উপকূলীয় অঞ্চলে পর্যটন ও অবকাঠামো উন্নয়নে ভুমিকা রাখবে।
তিন দিনের এই আয়োজন মধ্যে রয়েছে, উদ্বোধনের পরে বিচ প্যারেড, সমুদ্রে স্পেশাল ফোর্সের প্রদর্শনী ঝলক এবং ফ্লিট রিভিউ। এছাড়া বিদেশী অংশগ্রহণকারীদের অংশগ্রহণে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, দেশীয় সংস্কৃতি তুলে ধরা, এবং অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি ও সমৃদ্ধ ঐতিহ্য তুলে ধরতে আন্তর্জাতিক খাদ্য উৎসব।
প্রসঙ্গত, এর আগে বাংলাদেশ নৌবাহিনী ২০১৭ সালের নভেম্বরে কক্সবাজারে ইন্ডিয়ান ওশান নেভাল সিম্পোজিয়াম বহুপাক্ষিক মেরিটাইম অনুসন্ধান ও উদ্ধার মহড়ার আয়োজন করেছিল। এরপর গত ১২ থেকে ১৫ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর যৌথ ব্যবস্থাপনায় ঢাকা ও কক্সবাজারে ৪৬তম ইন্দো-প্যাসিফিক আর্মিস ম্যানেজমেন্ট সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়।