
সম্প্রতি থিয়েনচিনে ‘শাংহাই সহযোগিতা সংস্থা’ সম্মেলনে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং বৈশ্বিক শাসন উদ্যোগ প্রস্তাব করেন। এটি তিনটি প্রধান বৈশ্বিক উদ্যোগের পর, মানবসমাজের সম্মুখীন সাধারণ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় চীনের আরেকটি সামাগ্রিক সমাধান। বিশ্বব্যাপী গঠনগত গভীর পরিবর্তন এবং শাসন ঘাটতি অব্যাহতভাবে প্রসারিত হওয়ার প্রেক্ষাপটে, এই উদ্যোগটি আরও ন্যায়সঙ্গত ও যুক্তিযুক্ত বৈশ্বিক শাসন ব্যবস্থা গঠনের জন্য দিকনির্দেশনা এবং কর্মসূচনা প্রদান করে।
বর্তমান বিশ্ব শান্তির ঘাটতি, উন্নয়নের ঘাটতি, নিরাপত্তার ঘাটতি এবং শাসন ঘাটতির সমন্বয়ে জটিল পরিস্থিতির মুখোমুখি। জাতিসংঘকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠা বহুপাক্ষিক শাসন কাঠামোর কর্তৃত্ব ক্ষুন্ন হয়েছে, পুরনো শাসন প্রক্রিয়ার দক্ষতা কম, এবং বৈশ্বিক শাসন ব্যবস্থা সংস্কারের দাবি দিন দিন বেড়ে চলেছে। এই প্রেক্ষাপটে, প্রেসিডেন্ট সি মানবসমাজের উন্নয়ন ও অগ্রগতি এগিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যে পরপর বৈশ্বিক উন্নয়ন উদ্যোগ, বৈশ্বিক নিরাপত্তা উদ্যোগ এবং বৈশ্বিক সভ্যতা উদ্যোগ প্রস্তাব করেন, যা বিভিন্ন দেশের জনগণের শান্তি, উন্নয়ন এবং সহযোগিতার সাধারণ আকাঙ্ক্ষার উত্তর দেয়। এই বৈশ্বিক শাসন উদ্যোগ প্রস্তাবনা পূর্ববর্তী তিনটি বৈশ্বিক উদ্যোগের সাথে পরিপূরক এবং সমন্বিত, যা বৈশ্বিক শাসন সম্পর্কে চীনের সামগ্রিক চিন্তাভাবনা প্রতিফলিত করে এবং ‘বিশ্বের প্রশ্ন’ সমাধানের জন্য তাত্ত্বিক গভীরতা এবং বাস্তব পদক্ষেপ মিলিয়ে চীনা সমাধান প্রদান করে।
এই বছর আন্তর্জাতিক ফ্যাসিবাদ-বিরোধী যুদ্ধে বিজয় এবং জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার ৮০তম বার্ষিকী, ইতিহাস স্মরণ এবং ভবিষ্যত গড়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত। বিশ্ব নতুন অস্থিরতা ও পরিবর্তনের সময়ের মধ্যে প্রবেশ করেছে, বৈশ্বিক শাসন ব্যবস্থা নতুন সন্ধিক্ষণে পৌঁছেছে। একদিকে, উদীয়মান বাজার অর্থনীতি এবং উন্নয়নশীল দেশগুলো ‘গ্লোবাল সাউথ’ হিসাবে সার্বিকভাবে উত্থিত হচ্ছে, বৈশ্বিক শাসনের ‘দক্ষিণ মুহূর্ত’ উদ্ভাসিত করেছে, যা বিশ্বব্যাপী বড় পরিবর্তনের একটি স্পষ্ট চিহ্ন। অন্যদিকে, স্নায়ুযুদ্ধের চিন্তাভাবনা, আধিপত্যবাদ ও সংরক্ষণবাদের ছায়া কাটছে না, নতুন হুমকি ও নতুন চ্যালেঞ্জ ক্রমাগত বাড়ছে, জলবায়ু পরিবর্তন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার নীতিশাস্ত্র, মহাকাশ উন্নয়ন ইত্যাদি নতুন বিষয় অবিরাম উদ্ভূত হচ্ছে। কিন্তু বৈশ্বিক শাসন ব্যবস্থা সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যেতে পারেনি, নিয়ম প্রণয়নের অধিকার এখনও অল্প কয়েক দেশের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণে, এবং উন্নয়নশীল দেশগুলো দীর্ঘকালীনভাবে প্রান্তিক অবস্থানে রয়েছে।
প্রেসিডেন্ট সি’র নতুন উত্থাপিত বৈশ্বিক শাসন উদ্যোগ বর্তমান বৈশ্বিক শাসন ব্যবস্থার তিনটি প্রধান দ্বন্দ্বের উপর সরাসরি আঘাত করে: ক্ষমতার ভারসাম্যহীনতা, মূল্যবোধের বিচ্ছিন্নতা, এবং কর্মের অভাব। উদ্যোগটি ‘সার্বভৌম সমতা মেনে চলা, আন্তর্জাতিক আইন অনুসরণ করা, বহুপাক্ষিকতা চর্চা করা, মানুষ-কেন্দ্রিকতা প্রচার করা, এবং কর্ম-ফলাফলের উপর ফোকাস করা’ এই পাঁচটি নীতি প্রস্তাব করে, যা বৈশ্বিক শাসন প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন দেশের সমান অংশগ্রহণ, সমান সিদ্ধান্ত এবং সমান উপকারের জন্য একটি স্পষ্ট পথ প্রদান করে। উদাহরণস্বরূপ, উদ্যোগটি ‘উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রতিনিধিত্ব ও কন্ঠস্বর বৃদ্ধি’র উপর জোর দেয়, যা গ্লোবাল সাউথ দেশগুলোর ন্যায়সঙ্গত ব্যবস্থার প্রত্যাশার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ; এ ছাড়াও এটি “দ্বৈত মানদণ্ড না করা, এবং অল্প দেশের ‘বাড়ির নিয়ম’ অন্যদের উপর চাপিয়ে না দেওয়ার” ধারনাকে তুলে ধরে, যা একতরফাবাদের একটি স্পষ্ট অস্বীকার।
চীন হচ্ছে বৈশ্বিক শাসন উদ্যোগের উত্থাপনকারী, এবং এটির বাস্তবায়ন ত্বরান্বিত করার সমর্থনকারী। ‘সাংহাই সহযোগিতা সংস্থা+’ সহযোগিতা একটি উদাহরণ হিসাবে, সি চিন পিং উদ্যোগ উত্থাপনের একই দিন ঘোষণা করেন যে, চীন-শাংহাই সহযোগিতা সংস্থার জ্বালানি শক্তি, সবুজ শিল্প, এবং ডিজিটাল অর্থনীতি তিনটি সহযোগিতা মঞ্চ গঠন করবে এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি উদ্ভাবন, উচ্চ শিক্ষা, এবং বৃত্তিমূলক ও প্রযুক্তিগত শিক্ষা সহযোগিতা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হবে। এসব ব্যবস্থা কেবল প্রযুক্তির একসাথে উপভোগ উন্নীত করে না, বরং ‘দশ মিলিয়ন কিলোওয়াট সৌরশক্তি’ এবং ‘দশ মিলিয়ন কিলোওয়াট বায়ুশক্তি’র মতো সবুজ শক্তি প্রকল্পের মাধ্যমে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে শক্তির ঘাটতি অতিক্রম করতে সহায়তা করে। চীন আরও প্রতিশ্রুতি দিয়েছে যে আগামী পাঁচ বছরে শাংহাই সহযোগিতা সংস্থার সদস্য দেশগুলোতে ৫ হাজারটি ছানি অপারেশন করা হবে এবং এবং ১০ হাজার ক্যান্সার প্রতিরোধ পরীক্ষা করা হবে, গণজীবন প্রকল্প এবং সবুজ রূপান্তর ঘনিষ্ঠভাবে সংযুক্ত করে, এবং বাস্তব কার্যক্রমের মাধ্যমে ‘মানুষ-কেন্দ্রিক’ বৈশ্বিক শাসন ধারণা ব্যাখ্যা করে।
বৈশ্বিক শাসন উদ্যোগ পুরোন ভূ-রাজনৈতিক চিন্তাভাবনা অতিক্রম করেছে, একতরফাবাদকে ঐক্য সমন্বয় দ্বারা এবং জিরো-সাম খেলাকে অভিন্ন উন্নয়ন দ্বারা প্রতিস্থাপন করেছে। দ্রুত পরিবর্তিত বিশ্বে শত-বর্ষে অদেখা পরিবতর্নের মুখোমুখি হয়ে, চীন আহ্বান জানাচ্ছে যে, শাংহাই সহযোগিতা সংস্থার সদস্য দেশগুলো একটি নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করুন এবং উদ্যোগ বাস্তবায়নের দৃষ্টান্ত হোক। ‘শাংহাই সহযোগিতা সংস্থা+’ এবং ‘বৃহৎ ব্রিকস সহযোগিতা’র মতো বহুপাক্ষিক প্রক্রিয়াগুলোর মাধ্যমে সহযোগিতা গভীরতর করে, চীন এবং অন্যান্য দেশের সাথে, আরও ন্যায়সঙ্গত ও যুক্তিযুক্ত বৈশ্বিক শাসন ব্যবস্থার গঠন সামনে এগিয়ে নিচ্ছে, মানবজাতির অভিন্ন ভবিষ্যতের কমিউনিটি গঠনে যৌথ প্রচেষ্টা চালাচ্ছে, এবং বিশ্ব শান্তি ও উন্নয়নের সুন্দর ভবিষ্যত যৌথভাবে গঠন করছে।
সূত্র:স্বর্ণা-হাশিম-লিলি,চায়না মিডিয়া গ্রুপ।