স্টাফ কোয়ার্টার। নথিপত্রেও লেখা সেখানে একজন চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী থাকেন। আদতে তা নয়। সেখানে থাকেন একজন নির্বাহী কর্মকর্তা। অনিয়ম করে কর্মচারীদের বঞ্চিত করে একজন কর্মকর্তার বসবাসের বিষয়টি নিয়ে অসন্তোষ কর্মচারীদের মনেও। অনিয়মের এই গল্প কুমিল্লা জেলা পরিষদের। শুধু এটিই নয়, এই কর্মকর্তার আমলনামায় আছে আরও অনিয়মের ঝুলি। এই প্রতিবেদকের অনুসন্ধ্যানে উঠে এসেছে এসব তথ্য।
ওই কর্মচারীর নাম আকতার হোসাইন। তিনি কুমিল্লা জেলা পরিষদের উচ্চমান সহকারী (প্রকৌশল শাখা)। আর কর্মচারী কোয়ার্টার দখল করা কর্মকর্তার নাম তাসলিমুন নেছা। তিনি জেলা পরিষদের নির্বাহী কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করছেন।
কর্মচারীর কোয়ার্টার দখল
অনুসন্ধ্যানে জানা গেছে, কুমিল্লা জেলা পরিষদে যোগদানের পর ২০২৩ সালের ৩১ অক্টোবর থেকে তিনি কর্মচারী আকতার হোসেনের নামে কোয়ার্টার দখল করেন। এরপর থেকে সেখানেই আছেন। তিনি জেলা পরিষদ লাগোয়া চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের স্টাফ কোয়ার্টার ভবনের দ্বিতীয় তলার ডানপাশের ইউনিট কর্মচারী আকতার হোসেনের নামে বুকিং করা রয়েছে। কিন্তু সেখানে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে আকতার নামের কেউ থাকেন না। থাকেন একজন কর্মকর্তা। নাম তার তাসলিমুন নেছা।
সূত্রে জানা গেছে, এই বাসার ভাড়া প্রায় ৬হাজার টাকা। যা চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের জন্য বরাদ্দকৃত। অথচ এই কর্মকর্তার জন্য প্রায় ১৫ হাজার টাকা বাসা ভাড়ার বরাদ্দ রয়েছে। ৬ হাজার টাকার চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের ভবনে থেকে যেমন বাড়তি টাকা উঠাচ্ছেন তেমনি বিপাকে পড়ে আছেন কর্মচারীরাও।
কর্মচারীদের অন্তত ৫ জনের সঙ্গে এবিষয়ে কথা বলতে চাইলে কেউ রাজি হননি। তবে কয়েকজন জানিয়েছেন এই কর্মকর্তা পরিবার নিয়ে থাকলেও কর্মচারীরা তা প্রতিবাদের কোন সুযোগ নেই। কারণ এই নিয়ে মুখ খুললেই বদলি সহ যেকোন ঝামেলায় পড়তে হতে পারে।
যার নামে বুকিং করা কুমিল্লা জেলা পরিষদের উচ্চমান সহকারী (প্রকৌশল শাখা) আকতার হোসাইনকে মঙ্গলবার তার কক্ষে গিয়ে দেখা গেছে বসে আছেন। তার নামে কোয়ার্টার বরাদ্দ আছে তিনি জানেন কিনা এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, আপনাকে এই তথ্য কে দিয়েছে? আমি এই বিষয়ে বলতে পারবো না। পূনরায় জিজ্ঞেস করলে জানেন না বলে জানান।
একই কর্মস্থলে ৬ বছর
সূত্রে জানা গেছে, ৩৪ বিসিএসের এই কর্মকর্তা বিগত সরকারের আস্থাভাজন ছিলেন। ছিলেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের পছন্দের। তাই কোন নিয়মকে মান্য না করেই চাকুরী জীবনের ৮বছরের ৬ বছরই কুমিল্লা কাটিয়েছেন তিনি।
অনুসন্ধ্যানে জানা গেছে, কুমিল্লায় জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সহকারী কমিশনার এবং কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলার এসিল্যান্ড হিসেবে মোট ৪ বছরের বেশি, জেলা পরিষদের সিইওর (একটিং) পদে প্রায় ২ বছরসহ মোট চার বছর তিনি কুমিল্লা আছেন।
বদলীর আদেশ এলেও যান না তিনিÑ
রাষ্ট্রপতির আদেশে উপসচিব খোন্দকার ফরহাদ আহমদের সাক্ষর করে একটি প্রজ্ঞাপনে ৮ জানুয়ারি নির্বাহী কর্মকর্তা তাসলিমুন নেছাকে বদলির আদেশ দেয়া হয়। এতে তাসলিমুন নেছাকে কুমিল্লা জেলা পরিষদ থেকে জামালপুর জেলা পরিষদের নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে বদলি করা হয়। সরকারি বদলীর আদেশও মানেন না এই কর্মকর্তা। নিয়ম অনুযায়ী সর্বোচ্চ ৭ দিনের মধ্যে সেখানে বদলির আদেশ থাকলেও ১৩ দিনেও তিনি যাননি। সরকারি আদেশকে অমান্য করায় গত ২০ জানুয়ারি উপসচিব খোন্দকার ফরহাদ আহমদের সাক্ষর করা আরেকটি প্রজ্ঞাপনে তাকে নেত্রকোনা জেলা পরিষদে বদলি করা হয়।
কর্মকর্তার সরকারি গাড়ি দিয়ে স্বামীর আয়েশÑ
কুমিল্লা বিশ^বিদ্যালয়ে কয়েকটি সূত্রে জানা গেছে, একটি কালো গাড়ি বিশ^বিদ্যালয়ে আসে। কালো গাড়িটি জেলা পরিষদের। তবে এতে জেলা পরিষদের কেউ যান না। যান কুমিল্লা বিশ^বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক। নাম তার তারিক হোসাইন। তারিক হোসাইন কুমিল্লা বিশ^বিদ্যালয়ের একাউন্টিং এন্ড ইনফরমেশন সিস্টেম বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও তাসলিমুন নেছার স্বামী।
এসব অভিযোগের বিষয়ে তাসলিমুন নেছা বলেন, আমি কাজের সুবিধার জন্য কোয়ার্টারে থাকি। আমার বাসা অনেক দূরে। আর প্রথম প্রথম আমি বিশ^বিদ্যালয় এলাকা থেকেই আসতাম। স্বামীর সরকারি গাড়ি ব্যবহারের বিষয়ে তিনি বলেন, আমার সারা জেলায় কাজ। যখন সেদিকে যাই উনাকে নামিয়ে দেই। এছাড়াও বদলির আদেশে নতুন কর্মস্থলে চলে যাবেন বলেও জানান তিনি।
এবিষয়ে কুমিল্লা জেলা প্রশাসক আমিরুল কায়সার বলেন, এখানে অন্য কর্মকর্তা নেই। তাই এই বদলি আরেকজন আসা পর্যন্ত হয়নি। বাকি অভিযোগের বিষয়ে জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী বলতে পারবেন।
জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নজরুল ইসলাম বলেন, আমি নতুন যোগদান করেছি। আপনাদের কাছেই এসব অভিযোগ শুনলাম, বিষয়টি দেখবো।