
মোঃ ইলিয়াস আলী, ঠাকুরগাঁও
দীর্ঘ ৮ বছর পূর্বে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ভোট কেন্দ্রে ভোট দিতে গিয়ে গুলিতে নিহত এসইচএসসি পরীক্ষার্থী মাহাবুব আলম পল্টুর বাবা আওয়ামীলীগের সাবেক দুই এমপিসহ ৩৮ জনের নাম উল্লেখ করে মামলা দায়ের করেছেন।
মামলার আইনজীবি জানান, আদালত বালিয়াডাঙ্গী থানা পুলিশকে তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশনা দিয়েছেন। এর আগে বুধবার দুপুরে ঠাকুরগাঁও বিজ্ঞ সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট আমলী আদালতে মামলা করেছেন পল্টুর বাবা আব্দুল জব্বার। তিনি ঠাকুরগাঁওয়ে বালিয়াডাঙ্গী উপজেলা পাড়িয়া ইউনিয়নের ৭নং ওয়ার্ডের বড় মাছখুড়িয়া গ্রামের বাসিন্দা।
মামলার অভিযোগ থেকে জানা গেছে, ঠাকুরগাঁও ২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য দবিরুল ইসলাম, তার ছেলে সদ্য সাবেক সংসদ সদস্য মাজহারুল ইসলাম সুজন, দবিরুল ইসলামের ছোট ভাই সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান শফিকুল ইসলাম, ভাতিজা সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আলী আসলাম জুয়েল, দবিরুল ইসলামের ছোট ছেলে ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি মোমিরুল ইসলাম সুমন, দুই সাবেক এমপি এপিএস কামরুজ্জামান শামীম, ইউপি সদস্য শাহ আলম সহ মোট ৩৮ জনের নাম উল্লেখ্য করে এবং অজ্ঞাত নামা আসামী করা হয়েছে দেড়শ জনকে।
মামলার অভিযোগে বলা হয়েছে, গত ০৭/০৫/২০১৬ ইং তারিখ বেলা অনুমান ১.৪৫ ঘটিকার সময় ৪/৫ নং আসামীর হুকুমে অপরাপর ১-২৬নং সকল আসামীগণ তাহাদের হাতে থাকা দেশীয় মারাত্মক অস্ত্র-সস্ত্র দ্বারা মাদ্রাসার মাঠে সাধারণ ভোটারদের উপর আক্রমন করিয়া হত্যার উদ্দেশ্যে এলোপাথারি ভাবে মারপিট শুরু করে। ফলে নিরীহ অনেক জনসাধারণ আহত ও গুরুত্বর রক্তাক্ত জখম হয়।
একপর্যায় ৪/৫ নং আসামীর হুকুমে ১/২/৬/৭/১৭ নং আসামীগণ ভোট কেন্দ্রে অনধিকার পূর্বক প্রবেশ করিয়া কর্তব্যরত পুলিশ সদস্যদের রাইফেল কাড়িয়া লইয়া হত্যার উদ্দেশ্যে উপস্থিত নিরীহ জনসাধারনের উপর গুলি চালাইতে থাকে এবং ১/২/৬নং আসামীগন তাহাদের সাথে থাকা অবৈধ পিস্তল উচাইয়া হত্যার উদ্দেশ্যে উপস্থিত জনসাধারনের উপরে উপর্যুপরি গুলি চালাইতে থাকে।
আসামীগণ কর্তৃক হত্যার উদ্দেশ্যে উক্তরূপে মারপিট ও গোলাগুলির ফলে আমার পুত্র ডিজিস্ট মোঃ মাহাবুব আলম পল্টু সহ অনেকেই আহত ও গুরুত্বর আহত হইয়া মাদ্রাসা মাঠে পড়িয়া থাকে এবং আমার পুত্র ডিজিস্ট মোঃ মাহাবুবু আলম পল্টু ঘটনাস্থলে মারা যায়। বিগত সরকার দলীয় প্রশাসন আমার পুত্রের লাশ আনিয়া বালিয়াডাঙ্গী হাসপাতালে ফেলিয়া রাখে এবং পর দিন ঠাকুরগাঁও সদর হাসপাতালের অর্ন্তগত আর্টগ্যালারীর মোড় মর্গে লাশের সুরতহাল রিপোর্ট প্রস্তুত ও ময়না তদন্ত করিয়া তৎকালীন সরকার দলীয় বালিয়াডাঙ্গী থানা পুলিশ আমার গ্রামের বাড়ীতে উপস্থিত থাকিয়া লাশ দাফন করায়। থানা পুলিশ আমাকে কিংবা আমার পরিবারের কাউকে লাশের ধারের কাছেও যাইতে দেয় নাই। আমি এজাহারকারী বাদী হইয়া মামলা করিতে গেলে বিগত সরকারের অধীন বালিয়াডাঙ্গী থানা পুলিশ আমার মামলা গ্রহণ করেন নাই। ১/২/৩/৪/৫/৬/১৭ নং আসামীগন আমাকে বারং বার তাহাদের বাড়ীতে ডাকিয়া আনিয়া আমার সন্তানের হত্যার বিচার চাহিয়া আমি যাহাতে কোথাও কোন মামলা-মোকদ্দমা না করি সেই মর্মে আমাকে হুমকি প্রদান করে। তাহাদের ভয়ভীতি ও হুমকির ফলে আমি কোন প্রকার মামলা-মোকদ্দমা করিবার সাহস পাই নাই।
মামলার বাদী আব্দুল জব্বার জানান, ওই সময় আওয়ামীলীগের মনোনীত চেয়ারম্যান প্রার্থীকে নির্বাচিত করতে ভোট কেন্দ্র দখল করেছিল স্থানীয় সাবেক এমপি দবিরুল ইসলাম ও তার লোকজন। সেখানে আমার ছেলে ভোট দিতে গিয়ে গুলিতে মারা যায়। এরপরে ছেলে হত্যার বিচার চেয়ে স্থানীয় সংসদ সদস্য, জনপ্রতিনিধি, থানা পুলিশ এবং আদালতের বারান্দায় দীর্ঘদিন ঘুরেছি কিন্তু বিচার পায়নি। উল্টো আমাদেরকে বিভিন্ন ভাবে হয়রানী করেছে আওয়ামী লীগের এমপি ও তার লোকজন। তাই সরকার পতনের পর ছেলে হত্যার বিচার পাবার আশায় ৮ বছর পর আদালতে গিয়ে মামলা করেচি। আশা করছি ছেলে হত্যার বিচার এবার পাবো এবং বিচার পেয়ে শান্তিতে মরতে পারবো।
নিহত পল্টুর ভাই নুরুল ইসলাম জানান, ঘটনার পর থেকে মাদ্রাসা মাঠেই আমি আর আমার বাবা ঈদের নামাজ পড়ি। এখন পর্যন্ত ঈদের নামাজ পড়ে আসার পর আমরা এক টুকরো মাংস কিংবা সেমাই খেতে পারিনা। সবাই কান্না কাটি করি। আমাদের পরিবার এবং এলাকার লোকজনের একটাই দু:খ হত্যাকাণ্ডের বিচার পাওয়াতো দুরের কথা, বিচার দিতেই পারিনি।
পল্টুর মা দুরজাহান জানান, ছেলেটা সেনাবাহিনীতে চাকরি পাবে, আশায় বুক বেঁধেছিলাম। এইচএসসির ৬টা পরীক্ষা দেওয়ার পর বাড়ীতে এসেছিলো ভোট দিতে। ভোট দিয়ে ফিরে বাকি পরীক্ষাগুলো দিয়ে সেনাবাহিনীর পরীক্ষায় অংশ নিলেই হয়ে যেতো। সব ঠিক ছিল। কিন্তু ভোট চোরদের কারণে ছেলেটাকে মেরে ফেলা হয়েছে। এখন বিচার দেখে মরতে চাই।
মামলার পর স্থানীয়রা বলছেন, ভোট কারচুপি করতে হত্যা করা হয়েছে পল্টুকে। হত্যার পর চুপ থাকেনি আইনশৃংখলা বাহিনী। উল্টো মামলায় জড়ানোর হুমকি দিয়ে দীর্ঘদিন হয়রানী করেছে তাঁদের। অনেকেই বাড়ীতে থাকতে পারিনি স্থানীয় ইউপি সদস্য ও পুলিশের যন্ত্রণায়। পল্টু হত্যার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চায় আমরা।
উল্লেখ্য, ২০১৬ সালে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার কালডাঙ্গা দাখিল মাদ্রাসায় গন্ডগোল তৈরি হয়। সেখানে গুলিতে মারা যান এইচএসসি পরীক্ষার্থী পল্টু। ঘটনার ৮ বছর পর ঠাকুরগাঁও আদালতে মামলা করেছে তার বাবা আব্দুল জব্বার। মামলার পরে নতুন করে আবার আলোচনায় ভোট কেন্দ্রের হত্যাকাণ্ড।