
কামরুজ্জামান জনি
১. ভূমিকা :
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচন দীর্ঘদিন পর অনুষ্ঠিত হয়ে গোটা জাতিকে এক প্রকার গণতন্ত্র চর্চার বাস্তব শিক্ষা দিয়েছে। সদ্যসমাপ্ত এই নির্বাচনকে ঘিরে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার মন্তব্য – “ডাকসু নির্বাচন জাতীয় নির্বাচনের মডেল” – কোনো কেবল রাজনৈতিক বক্তব্য নয়, বরং এর পেছনে রয়েছে একটি গভীর বার্তা।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতে যেখানে নির্বাচন মানেই কখনো কখনো সহিংসতা, অনাস্থা কিংবা জবাবদিহির অভাব, সেখানে ডাকসুর নির্বাচন কিছুটা ব্যতিক্রমী দৃশ্যপট তৈরি করেছে। এর ইতিবাচক দিকগুলো এবং যেসব চ্যালেঞ্জ সামনে এসেছে, সেগুলো বিশ্লেষণ করে জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের জন্য কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা তুলে ধরা যেতে পারে।
২. উৎসবমুখর পরিবেশ ও গণতান্ত্রিক চর্চা :
ডাকসু নির্বাচন ঘিরে বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে যে পরিবেশ তৈরি হয়েছিল, তা নিঃসন্দেহে ছিল উৎসবমুখর। সকাল থেকেই শিক্ষার্থীরা লাইনে দাঁড়িয়ে ভোট দিয়েছেন। নতুন ভোটারদের মাঝে ছিল উৎসাহ ও প্রত্যাশা। বিভিন্ন প্যানেলের প্রার্থীদের মধ্যে প্রাণবন্ত প্রচারণা, ম্যানিফেস্টো প্রকাশ এবং সরাসরি বিতর্ক আয়োজন হয়েছে, যা গণতান্ত্রিক চর্চার অন্যতম দৃষ্টান্ত।
নির্বাচন কমিশন ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ভোটগ্রহণে ছিল সুসংগঠিত। ব্যালট পেপার, সিল, ভোট কেন্দ্র ও পর্যবেক্ষক ব্যবস্থাপনা ছিল মোটামুটি স্বচ্ছ। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিও নিয়ন্ত্রণে ছিল। এ সকল দিক থেকেই এটি একটি কার্যকর ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
৩. অনৈতিক চাপ ও ফলাফল প্রকাশে বিলম্ব :
তবে, নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে একটি প্রশ্নবিদ্ধ অধ্যায়েরও সূচনা হয়। ভোটগ্রহণ শেষে ফলাফল প্রকাশে অযাচিত বিলম্ব এবং প্রশাসনের ওপর ‘বাইরের’ চাপের অভিযোগ সামনে আসে। কিছু প্রার্থী ও সংগঠনের অভিযোগ ছিল, ফলাফলের ধারা পাল্টাতে চেষ্টা করা হয়েছে।
এমন অবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও নির্বাচন পরিচালনাকারী কর্তৃপক্ষ চাপের মুখেও অনড় থেকে সঠিক ফলাফল প্রকাশ করে। যদিও প্রক্রিয়াটি আরও দ্রুত ও স্বচ্ছতার সঙ্গে সম্পন্ন করা যেতো, তথাপি কর্তৃপক্ষের এই অবস্থান প্রশংসনীয় এবং ভবিষ্যতের জন্য একটি দৃষ্টান্ত।
৪. জাতীয় নির্বাচন আয়োজনে সম্ভাব্য শিক্ষা :
ডাকসু নির্বাচন থেকে জাতীয় নির্বাচন কমিশন, রাজনৈতিক দল ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কয়েকটি মৌলিক শিক্ষা নিতে পারে:
(১). স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা: তরুণদের আগ্রহ বাড়াতে হলে রাজনৈতিক পরিবেশ বিশ্বাসযোগ্য হতে হবে।
(২). ভোটগ্রহণের স্বচ্ছতা বজায় রাখা: প্রশাসনিক দক্ষতা ও. জবাবদিহিমূলক নির্বাচন প্রক্রিয়া প্রয়োজন।
(৩). ফলাফল ঘোষণায় সময়নিষ্ঠতা ও স্বচ্ছতা: যে কোনো ধরনের বিলম্বই বিশ্বাসযোগ্যতা ক্ষুন্ন করতে পারে।
(৪). অনৈতিক চাপ প্রতিরোধে সাহসী ভূমিকা: নির্বাচন পরিচালনায় নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে দৃঢ় অবস্থান অপরিহার্য।
(৫). মুক্ত ও নিরাপদ প্রচারণার পরিবেশ: সহিংসতা ও দমননীতির পরিবর্তে যুক্তিভিত্তিক প্রচার-প্রচারণাকে উৎসাহিত করতে হবে।
৫. উপসংহার:
ডাকসু নির্বাচন জাতীয় রাজনীতির জন্য একটি ‘মাইক্রো মডেল’ হিসেবে কাজ করতে পারে। এটি যেমন তরুণ প্রজন্মকে রাজনৈতিক চর্চায় যুক্ত করেছে, তেমনি নির্বাচনী প্রক্রিয়া কীভাবে স্বচ্ছ, অংশগ্রহণমূলক ও বিশ্বাসযোগ্য হতে পারে – তার একটি রূপরেখাও দিয়েছে।
এখন প্রশ্ন হলো, আমরা কি এই শিক্ষাকে জাতীয় পর্যায়ে কার্যকর করতে পারবো? যদি পারি, তাহলে সামনে অপেক্ষা করছে আরও সুসংহত ও গ্রহণযোগ্য একটি গণতান্ত্রিক পথচলা।
—- কামরুজ্জামান জনি
সম্পাদক ও প্রকাশ
দৈনিক মুক্তির লড়াই।