ঢাকা ০১:২৪ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৩ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম
Logo উত্তরা গ্রীন টি ফ্যাক্টরি পুনরুদ্ধার: সন্ত্রাসীদের হামলার শঙ্কায় সিইও, নিরব ভূমিকায় পুলিশ Logo আগামী ২৫ ডিসেম্বর দেশে ফিরছেন তারেক রহমান (ভিডিও) Logo স্বপ্নভঙ্গের প্রতিচ্ছবি: বাংলাদেশ, নিরাপত্তা ও রাষ্ট্রীয় দায়বদ্ধতা Logo ঢাকার উপকণ্ঠে মুক্তিবাহিনী, আত্মসমর্পণের প্রস্তুতি শুরু রাজধানী ঘেরাও, হানাদারদের শেষ আশা নিভে যাওয়ার দিন Logo মতলব দক্ষিণে দাঁড়িপাল্লা মার্কার উঠান বৈঠক অনুষ্ঠিত Logo লাকসামে বিএনপির মহিলা দলের উঠান বৈঠক অনুষ্ঠিত Logo বৈশ্বিক মন্থরতাকে পেছনে ফেলে স্থির অগ্রযাত্রায় চীনের অর্থনীতি Logo বেইজিং সম্মেলনে উচ্চমানের সংস্কার ও উন্মুক্ততার ওপর জোর Logo সমন্বিত পদক্ষেপে বিশ্ব প্রশাসন উন্নয়নে নতুন গতি Logo পাচারকালে বিপুল পরিমাণ সিমেন্ট ও বার্মিজ লুঙ্গিসহ ২২ পাচারকারী আটক

ঢাকার উপকণ্ঠে মুক্তিবাহিনী, আত্মসমর্পণের প্রস্তুতি শুরু রাজধানী ঘেরাও, হানাদারদের শেষ আশা নিভে যাওয়ার দিন

১৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১: মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ১৩ ডিসেম্বর ছিল চূড়ান্ত আত্মসমর্পণের আগমুহূর্তের উত্তাল দিন। আগের দিনের ছত্রীসেনা অবতরণ ও টাঙ্গাইল করিডোরে ভারতীয় মিত্রবাহিনীর প্রবল সাফল্যের পর এই দিনে রাজধানী ঢাকা কার্যত চারদিক থেকে সামরিকভাবে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় মিত্রবাহিনীর অগ্রসরমান বাহিনী ঢাকার উপকণ্ঠে অবস্থান নিয়ে পাকিস্তানি হানাদারদের শেষ পথগুলো একে একে বন্ধ করে দেয়। কাদেরিয়া বাহিনী ও টাঙ্গাইল প্যারাস্যুট ব্রিগেডের সমন্বিত অগ্রযাত্রা, পূর্বাঞ্চল থেকে মেঘনা নদী পেরিয়ে আসা ভারতীয় বাহিনীর দ্রুত অগ্রগতি, এবং গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাদের নগরীর ভেতরে সংগঠিত হামলা সব মিলিয়ে ঢাকার সামরিক বেষ্টনী এমনভাবে কঠোর হয়ে ওঠে যে পাকিস্তানি বাহিনীর আর পালানোর কোনো পথ খোলা থাকেনি। দেশের অন্যান্য অঞ্চলেও বিজয়ের অগ্রযাত্রা ছিল অব্যাহত; নানা স্থানে বিপর্যস্ত হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণ করছিল। খুলনা, বগুড়া ও চট্টগ্রামে বিচ্ছিন্ন যুদ্ধ চললেও ঢাকার পতনই ছিল তাদের ভাগ্যের চূড়ান্ত রায়। রাজধানীর উপকণ্ঠে তখন প্রতিটি ঘণ্টাই নিয়াজীর পরাজয়ের ঘন্টা আরও জোরালো করে তুলছিল।

কিন্তু সামরিক পতনের মুখোমুখি হয়েও পাকিস্তানি সামরিক জান্তা ও তাদের দোসররা থেমে থাকেনি। প্রিয় বাংলাদেশকে মেধাশূন্য করার গভীর ষড়যন্ত্রে তারা নেমে পড়ে বুদ্ধিজীবী নিধনের চূড়ান্ত প্রক্রিয়ায়। আল-বদর ও আল-শামস বাহিনী পাকিস্তানি সেনাদের প্রত্যক্ষ নির্দেশে সুপরিকল্পিত তালিকার ভিত্তিতে দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান শিক্ষক, সাংবাদিক, চিকিৎসক, সাহিত্যিক, প্রকৌশলী এদের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে অপহরণ শুরু করে। ১৩ ডিসেম্বর থেকেই রাজধানীর বিভিন্ন নির্যাতনকেন্দ্রে বুদ্ধিজীবীদের ঠাঁই করে রাখা হয়, পরদিন ১৪ ডিসেম্বরের ভয়াল হত্যাযজ্ঞের জন্য। রায়েরবাজার, মিরপুর ও মোহাম্মদপুরের নির্জন বধ্যভূমি তখন প্রস্তুত হয়ে ওঠে পাকিস্তানি সামরিক জান্তার ইতিহাসের সবচেয়ে ঘৃণ্য গণহত্যার মঞ্চ হিসেবে।

আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও ১৩ ডিসেম্বর ছিল তীব্র কূটনৈতিক তৎপরতার দিন। যুক্তরাষ্ট্রসহ কয়েকটি রাষ্ট্র জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে যুদ্ধবিরতির দাবি জোরালো করতে থাকে। পাকিস্তানকে রক্ষার শেষ চেষ্টা হিসেবে ভারত-পাকিস্তান সংঘাত বন্ধের প্রস্তাব তোলা হয়। কিন্তু ভারতের মিত্র সোভিয়েত ইউনিয়ন ধারাবাহিকভাবে এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করে এবং ভেটো প্রয়োগ করে পাকিস্তানের শেষ আশাটুকুও নিভিয়ে দেয়। কূটনৈতিক ব্যর্থতার ফলে জেনারেল নিয়াজী নিশ্চিত হন যে আর কোনো আন্তর্জাতিক সহায়তা বা সামরিক পুনর্বিন্যাস সম্ভব নয়; আত্মসমর্পণই একমাত্র পথ।

এদিন আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে পূর্বাঞ্চলের নদীপথে। মেঘনা-ব্রহ্মপুত্র নৌ-অপারেশন ছিল মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম দ্রুততম ও কৌশলগত সামরিক সফলতা; ১৩ ডিসেম্বর ভারতীয় নৌ-বাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর যৌথ নৌ-অবরোধে পাকিস্তানি শক্তির উত্তর ও পূর্ব দিক থেকে সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। আকাশে ভারতীয় বিমানবাহিনীর টহল ঢাকার আকাশকে সম্পূর্ণভাবে দখলে নিয়ে শহরকে কার্যত একটি বন্দী ঘাঁটিতে পরিণত করে। শহরের ভেতরে তখন মুক্তিযোদ্ধাদের ‘অপারেশন জ্যাকপট’–এর সাফল্যের ধারাবাহিকতায় গেরিলা হামলা বাড়তে থাকে এবং পাকিস্তানি বাহিনীর মনোবল ভেঙে যায়।

১৩ ডিসেম্বরের প্রতিটি মুহূর্ত তাই ছিল মুক্তিবাহিনীর বিজয়ের অগ্রযাত্রায় এক মহান পদক্ষেপ, আর একই সঙ্গে ছিল জাতির ইতিহাসে গভীরতম ট্র্যাজেডির অন্ধকার পর্বের সূচনা। সামরিক ঘেরাও, আন্তর্জাতিক ব্যর্থতা এবং মেধাবী জাতিসন্তানদের পরিকল্পিতভাবে নিশ্চিহ্ন করার অপচেষ্টা এই তিন প্রবল ঘটনার সংঘাতে ১৩ ডিসেম্বর হয়ে ওঠে মুক্তিযুদ্ধের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ও বেদনাবিধুর দিনগুলোর একটি। ঠিক এই দিনের সামরিক-রাজনৈতিক চাপে এবং মুক্তির মশাল হাতে তরুণ মুক্তিযোদ্ধাদের আপসহীন অগ্রযাত্রায় পরদিন ১৪ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণের চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছায় এবং বিজয় ছিনিয়ে আনার পথ পুরোপুরি সুগম হয়।

লেখক : মোহাম্মদ আলী সুমন, সাংবাদিক ও সংগঠক।

ট্যাগস
আপলোডকারীর তথ্য

জনপ্রিয় সংবাদ

উত্তরা গ্রীন টি ফ্যাক্টরি পুনরুদ্ধার: সন্ত্রাসীদের হামলার শঙ্কায় সিইও, নিরব ভূমিকায় পুলিশ

SBN

SBN

ঢাকার উপকণ্ঠে মুক্তিবাহিনী, আত্মসমর্পণের প্রস্তুতি শুরু রাজধানী ঘেরাও, হানাদারদের শেষ আশা নিভে যাওয়ার দিন

আপডেট সময় ০৮:১৮:৫৩ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১৩ ডিসেম্বর ২০২৫

১৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১: মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ১৩ ডিসেম্বর ছিল চূড়ান্ত আত্মসমর্পণের আগমুহূর্তের উত্তাল দিন। আগের দিনের ছত্রীসেনা অবতরণ ও টাঙ্গাইল করিডোরে ভারতীয় মিত্রবাহিনীর প্রবল সাফল্যের পর এই দিনে রাজধানী ঢাকা কার্যত চারদিক থেকে সামরিকভাবে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় মিত্রবাহিনীর অগ্রসরমান বাহিনী ঢাকার উপকণ্ঠে অবস্থান নিয়ে পাকিস্তানি হানাদারদের শেষ পথগুলো একে একে বন্ধ করে দেয়। কাদেরিয়া বাহিনী ও টাঙ্গাইল প্যারাস্যুট ব্রিগেডের সমন্বিত অগ্রযাত্রা, পূর্বাঞ্চল থেকে মেঘনা নদী পেরিয়ে আসা ভারতীয় বাহিনীর দ্রুত অগ্রগতি, এবং গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাদের নগরীর ভেতরে সংগঠিত হামলা সব মিলিয়ে ঢাকার সামরিক বেষ্টনী এমনভাবে কঠোর হয়ে ওঠে যে পাকিস্তানি বাহিনীর আর পালানোর কোনো পথ খোলা থাকেনি। দেশের অন্যান্য অঞ্চলেও বিজয়ের অগ্রযাত্রা ছিল অব্যাহত; নানা স্থানে বিপর্যস্ত হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণ করছিল। খুলনা, বগুড়া ও চট্টগ্রামে বিচ্ছিন্ন যুদ্ধ চললেও ঢাকার পতনই ছিল তাদের ভাগ্যের চূড়ান্ত রায়। রাজধানীর উপকণ্ঠে তখন প্রতিটি ঘণ্টাই নিয়াজীর পরাজয়ের ঘন্টা আরও জোরালো করে তুলছিল।

কিন্তু সামরিক পতনের মুখোমুখি হয়েও পাকিস্তানি সামরিক জান্তা ও তাদের দোসররা থেমে থাকেনি। প্রিয় বাংলাদেশকে মেধাশূন্য করার গভীর ষড়যন্ত্রে তারা নেমে পড়ে বুদ্ধিজীবী নিধনের চূড়ান্ত প্রক্রিয়ায়। আল-বদর ও আল-শামস বাহিনী পাকিস্তানি সেনাদের প্রত্যক্ষ নির্দেশে সুপরিকল্পিত তালিকার ভিত্তিতে দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান শিক্ষক, সাংবাদিক, চিকিৎসক, সাহিত্যিক, প্রকৌশলী এদের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে অপহরণ শুরু করে। ১৩ ডিসেম্বর থেকেই রাজধানীর বিভিন্ন নির্যাতনকেন্দ্রে বুদ্ধিজীবীদের ঠাঁই করে রাখা হয়, পরদিন ১৪ ডিসেম্বরের ভয়াল হত্যাযজ্ঞের জন্য। রায়েরবাজার, মিরপুর ও মোহাম্মদপুরের নির্জন বধ্যভূমি তখন প্রস্তুত হয়ে ওঠে পাকিস্তানি সামরিক জান্তার ইতিহাসের সবচেয়ে ঘৃণ্য গণহত্যার মঞ্চ হিসেবে।

আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও ১৩ ডিসেম্বর ছিল তীব্র কূটনৈতিক তৎপরতার দিন। যুক্তরাষ্ট্রসহ কয়েকটি রাষ্ট্র জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে যুদ্ধবিরতির দাবি জোরালো করতে থাকে। পাকিস্তানকে রক্ষার শেষ চেষ্টা হিসেবে ভারত-পাকিস্তান সংঘাত বন্ধের প্রস্তাব তোলা হয়। কিন্তু ভারতের মিত্র সোভিয়েত ইউনিয়ন ধারাবাহিকভাবে এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করে এবং ভেটো প্রয়োগ করে পাকিস্তানের শেষ আশাটুকুও নিভিয়ে দেয়। কূটনৈতিক ব্যর্থতার ফলে জেনারেল নিয়াজী নিশ্চিত হন যে আর কোনো আন্তর্জাতিক সহায়তা বা সামরিক পুনর্বিন্যাস সম্ভব নয়; আত্মসমর্পণই একমাত্র পথ।

এদিন আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে পূর্বাঞ্চলের নদীপথে। মেঘনা-ব্রহ্মপুত্র নৌ-অপারেশন ছিল মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম দ্রুততম ও কৌশলগত সামরিক সফলতা; ১৩ ডিসেম্বর ভারতীয় নৌ-বাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর যৌথ নৌ-অবরোধে পাকিস্তানি শক্তির উত্তর ও পূর্ব দিক থেকে সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। আকাশে ভারতীয় বিমানবাহিনীর টহল ঢাকার আকাশকে সম্পূর্ণভাবে দখলে নিয়ে শহরকে কার্যত একটি বন্দী ঘাঁটিতে পরিণত করে। শহরের ভেতরে তখন মুক্তিযোদ্ধাদের ‘অপারেশন জ্যাকপট’–এর সাফল্যের ধারাবাহিকতায় গেরিলা হামলা বাড়তে থাকে এবং পাকিস্তানি বাহিনীর মনোবল ভেঙে যায়।

১৩ ডিসেম্বরের প্রতিটি মুহূর্ত তাই ছিল মুক্তিবাহিনীর বিজয়ের অগ্রযাত্রায় এক মহান পদক্ষেপ, আর একই সঙ্গে ছিল জাতির ইতিহাসে গভীরতম ট্র্যাজেডির অন্ধকার পর্বের সূচনা। সামরিক ঘেরাও, আন্তর্জাতিক ব্যর্থতা এবং মেধাবী জাতিসন্তানদের পরিকল্পিতভাবে নিশ্চিহ্ন করার অপচেষ্টা এই তিন প্রবল ঘটনার সংঘাতে ১৩ ডিসেম্বর হয়ে ওঠে মুক্তিযুদ্ধের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ও বেদনাবিধুর দিনগুলোর একটি। ঠিক এই দিনের সামরিক-রাজনৈতিক চাপে এবং মুক্তির মশাল হাতে তরুণ মুক্তিযোদ্ধাদের আপসহীন অগ্রযাত্রায় পরদিন ১৪ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণের চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছায় এবং বিজয় ছিনিয়ে আনার পথ পুরোপুরি সুগম হয়।

লেখক : মোহাম্মদ আলী সুমন, সাংবাদিক ও সংগঠক।