
১২ ডিসেম্বর, ১৯৭১: নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের শেষ প্রান্তে এসে ১২ ডিসেম্বর ছিল সামরিক সাফল্য ও জাতীয় ট্র্যাজেডির এক দ্বিমাত্রিক দিন। একদিকে মিত্রবাহিনীর দুঃসাহসিক প্যারাট্রুপ অপারেশন ঢাকার পতনকে ত্বরান্বিত করে তোলে, অন্যদিকে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা শুরু করে জাতির মেধা নিধনের ঘৃণ্যতম পরিকল্পনার কার্যকর বাস্তবায়ন। যুদ্ধের শেষ বাঁকে দাঁড়িয়ে এদিনটি হয়ে ওঠে চূড়ান্ত বিজয়ের সূচনা ও ভয়াবহ বুদ্ধিজীবী হত্যাযজ্ঞের অন্ধকার ইঙ্গিত।
মিত্রবাহিনীর সবচেয়ে কৌশলগত পদক্ষেপের মধ্যে অন্যতম ছিল টাঙ্গাইল অপারেশন, যা ১২ ডিসেম্বর ভোরে আকাশ থেকে অবতরণকারী প্যারাট্রুপারদের মাধ্যমে শুরু হয়। মির্জাপুর ও কালিয়াকৈর এলাকায় হঠাৎ আকাশ থেকে নেমে আসা ভারতীয় প্যারাস্যুট ব্যাটালিয়নের এই অবতরণ ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর কাছে সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত। এর মূল লক্ষ্য ছিল ময়মনসিংহ থেকে ঢাকায় পালিয়ে আসার প্রধান পথ ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক সম্পূর্ণরূপে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া। এতে পাকিস্তানি বাহিনীর পলায়নের পথ রুদ্ধ হয়ে যায় এবং তাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে।
মাটিতে অবতরণের সঙ্গে সঙ্গেই প্যারাট্রুপারদের সঙ্গে যোগ দেয় কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন দুর্ধর্ষ কাদেরিয়া বাহিনী। যৌথ অভিযান ছিল দ্রুত, শক্তিশালী এবং নিখুঁত পরিকল্পিত। রাতভর তুমুল যুদ্ধে পাকিস্তানি সেনারা বিপর্যস্ত হয় এবং ভোরের আলো ফোটার আগেই বহু জায়গায় তারা আত্মসমর্পণে বাধ্য হয়। এই অপারেশন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অন্যতম সফল যৌথ সামরিক অভিযান হিসেবে ইতিহাসে স্থান পায়, যা ঢাকার পতনের পথ চূড়ান্তভাবে প্রশস্ত করে।
এদিকে পরাজয় নিশ্চিত জেনে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা ও তাদের দোসররা শুরু করে আরেকটি ভয়ঙ্কর পরিকল্পনার বাস্তবায়ন জাতির মেধা ধ্বংসের নীলনকশা। মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর তত্ত্বাবধানে, আল-বদর ও আল-শামস বাহিনী ১২ ডিসেম্বর থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সাংবাদিক, চিকিৎসক, বিজ্ঞানীসহ বিশেষজ্ঞ পেশাজীবীদের টার্গেট করে তুলে নেওয়া শুরু করে। যদিও ১৪ ডিসেম্বর সংঘটিত হয় ইতিহাসের ভয়াবহ ‘বুদ্ধিজীবী হত্যা দিবস, তবে এর অ্যাকশন প্ল্যান বাস্তবে শুরু হয়েছিল ১২ ডিসেম্বর থেকেই। সেদিন থেকেই নিখোঁজ হতে শুরু করেন সাংবাদিক নিজাম উদ্দিন আহমেদ, আ ন ম গোলাম মোস্তফা, শিক্ষাবিদ, চিকিৎসকসহ অগণিত বুদ্ধিজীবী যা ছিল এক স্বাধীন রাষ্ট্রকে জন্মের আগেই মেধাশূন্য করার পরিকল্পিত প্রচেষ্টা।
দেশের অন্যান্য রণাঙ্গনেও ১২ ডিসেম্বর ছিল গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতির দিন। নোয়াখালী জেলার লক্ষ্মীপুর এদিন পাক-হানাদারমুক্ত হয়। অন্যদিকে যশোর, চট্টগ্রাম, রংপুর, বগুড়াসহ বিভিন্ন গ্যারিসনে পাকিস্তানি বাহিনী নিজেদের মূল শক্তি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। মিত্রবাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধার সম্মিলিত অগ্রযাত্রায় শত্রুবাহিনী দেশের প্রায় সব কৌশলগত স্থানেই অবরুদ্ধ হয়ে পড়তে থাকে।
১২ ডিসেম্বর ১৯৭১ জাতিকে দিল এক দ্বিবিধ সংকেত একদিকে বিজয় তো অন্যদিকে জাতির সেরা সন্তানদের রক্তক্ষয়ী হারিয়ে ফেলা। ঢাকার পতন তখন কেবল সময়ের অপেক্ষা, কিন্তু একইসঙ্গে শুরু হয়েছিল বাঙালি জাতির হৃদয়ে এক চিরস্থায়ী ক্ষতের রেখা।
লেখক : মোহাম্মদ আলী সুমন, সাংবাদিক ও সংগঠক।
মুক্তির লড়াই ডেস্ক : 

























