
শাহিনুর রহমান পিন্টু, ঝিনাইদহ
ফুল উৎপাদনে দেশের মধ্যে অন্যতম হিসাবে খ্যাতি রয়েছে ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলা। ফুল চাষে সারাদেশের মধ্যে যশোরের ঝিকরগাছা গদখালীর পরই স্থান দখলে নিয়েছে কালীগঞ্জ উপজেলার ফুলনগরী খ্যাত গ্রাম বেলেডাঙ্গা। এখান থেকে সারাদেশে পাঠানো হয় হরেক রকমের ফুল। বাংলাদেশের ফুলের অর্ধেক চাহিদাই পূরণ হয় ওই দুটি স্থান থেকে। আর মাত্র এক’দিন পরই “বিশ্ব ভালবাসা দিবস” এরপর পহেলা ফাল্গুন ও “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা” দিবস। এ দিবস গুলি সামনে রেখে ঝিনাইদহ কালীগঞ্জের ফুলচাষীরা তাদের উৎপাদিত প্রায় ছয় কোটি টাকার ফুল বিক্রির টার্গেট নিয়েছে। বর্তমানে ফুলচাষীরা তাদের ক্ষেতের পরিচযার্য় ব্যস্ত সময় পার করছেন। এ বছর এ উপজেলাতে প্রায় এক’শ হেক্টর জমিতে বিদেশী ফুল লিলিয়াম, জারবেরা, চন্দ্রমল্লিকা, থাইগোলাপ, গ্লাডিওলাস, দেশি রজনীগন্ধা, গোলাপ, চন্দ্র মল্লিকা, ভুট্রা, গাঁদা, ও থাই গোলাপসহ বিভিন্ন রকমের ফুলের আবাদ হয়েছে। উল্লেখ্য, উপজেলার ফুলনগরী খ্যাত গ্রাম বালিয়াডাঙ্গা ২০২২ সালে সরকারীভাবে এক কোটি ৮৫ লাখ টাকা ব্যয়ে একটি ফুল এসেম্বল সেন্টার নির্মাণ করা হয়েছে। এ অঞ্চলের ফুলচাষীদের উৎপাদিত ফুল সুষ্টভাবে বাজারজাত করনের জন্যই কেন্দ্রটি চালু করা হয়।
এ জেলার প্রথম ও বড় ফুলচাষী কালীগঞ্জ উপজেলার ত্রিলোচনপুর গ্রামের টিপু সুলতান জানান, তিনি প্রায় ৩০ বছর যাবৎ ফুল চাষের সাথে জড়িত। ত্রিলোচনপুর ইউনয়নের বালিয়াডাঙ্গা গ্রামের মাঠে ২৩ বিঘা জমিতে ফুলের আবাদ করেছেন। এরমধ্যে ২ বিঘাতে গোলাপ, ৬ বিঘা জারবেরা, ২ বিঘা গ্লাডিওলাস, ৩ বিঘা ভুট্টা ফুল, ২ বিঘা চন্দ্র মল্লিকা ফুল ও বোতাম ফুলসহ জিপসি ফুলের চাষ রয়েছে। তিনি এ মৌসুমে প্রায় ৫০ লাখ টাকার ফুল বিক্রির আশা করছেন। ফুল চাষের পাশাপাশি তার ২ বিঘা জমিতে পেয়ারা, ২ বিঘা ড্রাগনফল ও ৭ কাঠা জমিতে স্ট্রবেরি চাষও করেছেন বলেও জানান তিনি। এছাড়াও ঢাকাতেও রয়েছে তার ফুলের ব্যাবসা। ছোটভাই জনি সেটি পরিচালনা করেন। বর্তমানে তিনি ঢাকার শেরে বাংলানগর ফুলচাষী ও ফুল ব্যবসায়ী সমিতি লিমিটেডের সহ-সভাপতি ও ঝিনাইদহ জেলা ড্রাগন চাষী সমিতির সভাপতি।
টিপু সুলতান আরো জানান, তিনিই সর্ব প্রথম এদেশে গ্লাডিওলাস ফুলের চাষ শুরু করেন। এরপর জারবেরা ও সর্বশেষ ২০১৭ সালে নেদারল্যান্ডের লিলিয়াম ফুলের চাষ করেন। নেদারল্যান্ড থেকে ২৯ লাখ টাকা ব্যায়ে ৬০ হাজার পিচ লিলিয়াম ফুলের বীজ আনেন। জাহাজ ভাড়া সাড়ে ৩ লাখ টাকাসহ লিলিয়াম ফুলের জন্য তার মোট ব্যয় হয়েছিল প্রায় ৪৬ লাখ টাকা। প্রথম বছরে তেমন একটা ফুল বিক্রি করতে না পারলেও পরের বছর থেকে পুরোদমে তিনি লিলিয়াম ফুল বিক্রি করে আসছেন। তার ফুলের আবাদ দেখার জন্য রয়েছে ৭ জন স্থায়ী কর্মী ছাড়াও প্রতিদিন ১৫ থেকে ২০ জন শ্রমিক কাজ করেন। স্থায়ী ৭ জনকে মাসে ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা বেতন ও বাকিদের প্রতিদিন জনপ্রতি ২০০ টাকা করে হাজিরা দেন। পরিচর্যা, সেচ, সার, ্ঔষুধ ও পরিবহনসহ তার প্রতিবছরে ব্যয় হয় ২৪ থেকে ২৫ লাখ টাকা। এ বছরে তিনি অর্ধ কোটি টাকার ফুল বিক্রি করলে সকল ব্যয় বাদে বছরে তার লাভ থাকবে প্রায় ২৫ থেকে ৩০ লাখ টাকা।
আরেক ফুল চাষী বালিয়াডাঙ্গা গ্রামের বন্ধু এগ্রো ফার্মের পরিচালক শেখ রাসেল আহম্মেদ জানান, ১২ বিঘা জমিতে ফুলের চাষ করছেন। জারবেরা, চন্দ্রমল্লিকা গোলাপ ও গাদাফুল সহ বিভিন্ন ধরনের ফুল আছে। এ চাষের সাথে রেজাউল করিম, নাজমুল হুদা, দিদারুল ইসলাম ও আক্তারুজ্জামান সহ ৬ বন্ধু শেয়ার আছেন। সরেজমিনে তার জারবেরা ফুল ক্ষেতে গিয়ে দেখা যায়, বিদেশি জাতের এই ফুল লাল, সাদা, হলুদ ও গোলাপিসহ ৮টি বাহারি রঙের ধরে আছে। তবে এই ফুলের কোন গন্ধ না থাকলেও দেখতে অপরুপ। কোনটি ফুটন্ত. কোনটি অর্ধ ফুটন্ত আবার কোনটি সবেমাত্র কড়ি। যার বিশেষ নজদারিতে রেখে পরিচর্যা সানানো হচ্ছে ফেব্রুয়ারী ঘিরে। কেননা এ মাসেই আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা, পহেলা ফাল্গুন ও বিশ্ব ভালোবাসা দিবসসহ বিভিন্ন দিবস পালন হবে। এ সময় ফুলের কাটতি হবে বিরাট। রাসেল জানান, এ বছরে তাদের ক্ষেত থেকে প্রায় ৪০/৫০ লাখ টাকার ফুল বিক্রি করতে পারবেন বলে আশা করছেন।
তারমত ওই গ্রামের মডান এগ্রো ফার্মের মালিক মিজানুর রহমান জানান. তিনি গাদা, গোলাপ রজনীগন্ধা ফুল সহ ২৯ বিঘা জমিতে চাষ করছেন। এবারে ১০ লাখ টাকার ফুল বিক্রি করবেন বলে জানান তিনি।
জেলার মধ্যে বড় ও অন্যতম ফুল চাষী টিপু সুলতান আরো জানান, বছরে ডিসেম্বর মাস থেকে মার্চ পর্যন্ত ফুলের ব্যবসা ভাল হয়। এ সময় ফুলের দামও ভাল পাওয়া যায়। তিনি বলেন, একদিন পরই বিশ্ব ভালবাসা দিবস, পহেলা ফাল্গুন ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। এ তিনটি দিবসে তিনি একাই ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকার ফুল বিক্রি করতে পারবেন। তিনি দাবি করেন, চলতি বছরে এ উপজেলা থেকে তিন দিবসের জন্য প্রায় ৬/৭ কোটি টাকার ফুল বিক্রির সম্ভাবনা আছে।
কালীগঞ্জ উপজেলার সুন্দরপুর ইউনিয়নের ডুমুরতলা গ্রামের ফুলচাষি মিজানুর রহমান জানান, তিনি গাঁদা ফুলের চাষ করেন। এলাকার তারমত অনেকেই এ ফুল চাষের সাথে জড়িত। দড়িতে ফুল গেঁথে ঝোপা তৈরি করা হয়। এক ঝোপায় সাড়ে ৬’শ থেকে ৭’শ গাদা ফুল থাকে। বর্তমানে প্রতি ঝোপাফুল সর্বোচ্চ ৭’শ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করতে পারবেন। তবে বাজার কম থাকলে লোকসানও হয় ।
এদিকে ফুলের আবাদকে কেন্দ্র করে কালীগঞ্জ উপজেলার বালিয়াডাঙ্গা বাজারে গড়ে উঠেছে ফুল বিক্রির আলাদা বাজার। সরেজমিনে বালিয়াডাঙ্গা বাজার ও কালীগঞ্জের মেইন বাসস্ট্যান্ডে দেখা যায়, দুপুর থেকেই শত শত কৃষক তাদের ক্ষেতের উৎপাদিত ফুল ভ্যান, স্কুটার ও ইঞ্জিনচালিত বিভিন্ন পরিবহন যোগে নিয়ে আসছেন। বেলা গড়ানোর সাথে সাথে বালিয়াডাঙ্গা বাজার ও কালীগঞ্জ মেইন বাসস্ট্যাণ্ড ভরে যায় লাল, সাদা আর হলুদ ফুলে ফুলে।
ফুল ব্যবসায়ী বালিয়াডাঙ্গা গোপীনাথপুর গ্রামের শুকুর আলী জানান, তিনি ফুলচাষীদের কাছ থেকে সরাসরি গাঁদা ফুল ক্রয় করে থাকেন। এ এলাকার ফুল রাজধানী ঢাকা সহ চট্রাগ্রাম, সিলেট, রংপুর, দিনাজপুর, পঞ্চগড়, খুলনা, বরিশাল, সিরাজগঞ্জ, সৈয়দপুর, রংপুর, নওগা, ফরিদপ