ঢাকা ১০:৫০ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১৭ নভেম্বর ২০২৫, ৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম
Logo প্রতিহিংসা নয় প্রতিযোগিতা, রাজনীতি হোক ঐক্য ভিত্তিক Logo ডানপন্থী উসকানির বিরুদ্ধে তদন্ত দাবি বেইজিংয়ের Logo তাইওয়ান নিয়ে জাপান সরকারের নীতি প্রশ্নবিদ্ধ Logo রাজশাহীর জজ পরিবারের ওপর নৃশংস হামলার প্রতিবাদে গাইবান্ধায় আইনজীবীদের মানববন্ধন Logo ব্রাহ্মণপাড়ায় বসত ঘর হতে ১২ কেজি গাঁজাসহ ৪ জন গ্রেফতার Logo হাওরের বুক চিরে অবৈধ বিট বালু উত্তোলন Logo কুমিল্লা বোর্ডে এইচএসসির খাতা চ্যালেঞ্জ করে ফেল থেকে পাস ১০৮ জন Logo কোনো মহলের ষড়যন্ত্রে জাতীয় নির্বাচন বানচাল হলে দেশ ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে পড়বে Logo ঝিনাইদহে খুচরা সার বিক্রেতাদের মানববন্ধন ও বিক্ষোভ Logo সরাইলে সুমন হত্যা মামলার আসামীদের ফাঁসির দাবিতে মানববন্ধন

প্রতিহিংসা নয় প্রতিযোগিতা, রাজনীতি হোক ঐক্য ভিত্তিক

এম.কে.জাকির হোসাইন বিপ্লবী

রাজনীতি হচ্ছে রাষ্ট্র পরিচালনার কলা-কৌশল। এটি এমন এক মহৎ পেশা যার উদ্দেশ্য মানুষের কল্যাণ সাধন, সমাজে ন্যায় প্রতিষ্ঠা এবং জাতির সার্বিক উন্নয়ন নিশ্চিত করা। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, বর্তমান সময়ে রাজনীতি তার সেই মহৎ উদ্দেশ্য থেকে অনেকটাই বিচ্যুত হয়েছে। রাজনীতিতে নেমে এসেছে বিদ্বেষ, প্রতিহিংসা, বিভাজন ও সংঘাত। ক্ষমতা দখলের লড়াই যেন এখন নীতির চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। অথচ রাজনীতির মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত ছিল জনগণের ঐক্য, উন্নয়ন, এবং দেশকে একটি সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের পথে এগিয়ে নেওয়া। তাই সময় এসেছে নতুন করে ভাবার— রাজনীতি হোক ঐক্য ভিত্তিক, প্রতিহিংসা নয়, হোক সুষ্ঠু প্রতিযোগিতার মাধ্যমে পরিচালিত।

রাজনীতির মূল দর্শন
রাজনীতির মূল দর্শন হলো জনগণের সেবা। মহান দার্শনিক এরিস্টটল বলেছিলেন, “মানুষ একটি রাজনৈতিক প্রাণী”— কারণ মানুষ সমাজবদ্ধভাবে বাস করে এবং সমাজ পরিচালনার জন্য নেতৃত্বের প্রয়োজন হয়। এই নেতৃত্বই রাজনীতির জন্ম দিয়েছে।আমি আমার ব্যাক্তিগত গবেষণার আলোকে বলতে চাই,রাজনীতি এক মহৎ সাধনার ফলাফল। পৃথিবীতে যতো-রকম সাধনা রয়েছে,তার মাঝে রাজনীতি শ্রেষ্ঠ।রাজনীতিতে রয়েছে, আদর্শবাদিতা, দেশপ্রেম, মানবপ্রেম সহ গুরুত্বপূর্ন আরও অনেক বিষয়।কিন্তু যেই রাজনীতির মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে সমাজে শান্তি, ন্যায় ও সমতা প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু আজ রাজনীতি যেন তার নিজস্ব সৌন্দর্য হারিয়ে এক নিকৃষ্টতায় রুপান্তরিত হয়েছে। রাজনীতিবিদদের মধ্যে আদর্শ ও মূল্যবোধের পরিবর্তে প্রতিদ্বন্দ্বীকে ধ্বংস করার প্রবণতা বেড়ে গেছে। ফলে জনগণের মনে রাজনীতির প্রতি আস্থা কমে যাচ্ছে।

প্রতিহিংসার রাজনীতি: জাতির জন্য অভিশাপ
দেশ ও জাতির কল্যাণের জন্য যেই রাজনীতি আমাদের করার কথা,আজ তা জাতির ধ্বংস আর নিজেদের স্বার্থরক্ষার হাতিয়ারে পরিনত হয়েছে।বর্তমানে রাজনীতি মানে প্রতিহিংসার অভিশপ্ত বাণী আর জাতির জন্য এক হতাশার কালো জগৎ। প্রতিহিংশার রাজনীতি মানে হচ্ছে— বিরোধী পক্ষকে নিঃশেষ করা, প্রতিপক্ষকে দমন করা, এবং ক্ষমতায় আসতে বা থাকতে অন্যকে অপমান করা। এই ধারা একটি জাতির অগ্রগতিকে স্তব্ধ করে দেয়। প্রতিহিংসা রাজনীতির পরিবেশকে বিষাক্ত করে তোলে। এতে গণতন্ত্র দুর্বল হয়, প্রশাসন পক্ষপাতদুষ্ট হয়, এবং জনগণ বিভক্ত হয়ে পড়ে।

বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে প্রতিহিংসার প্রবণতা বহুকাল ধরে চলে আসছে। এক দলের ক্ষমতায় থাকা মানেই অন্য দলের জন্য কঠিন সময়—এমন বাস্তবতা দীর্ঘদিন ধরে আমরা দেখে আসছি। ক্ষমতার পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে প্রশাসন, বিচার বিভাগ, মিডিয়া ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও দলীয় প্রভাবের শিকার হয়। এতে রাজনীতি আর জনগণের কল্যাণের হাতিয়ার থাকে না, বরং হয়ে ওঠে প্রতিশোধের অস্ত্র। এর ফলেই সৃষ্টি হয় অবিশ্বাস, অস্থিতিশীলতা ও জাতীয় ঐক্যের অভাব।

ঐক্যভিত্তিক রাজনীতির প্রয়োজনীয়তা:-
আমাদের সকলের রাজনৈতিক মূল স্লোগান হচ্ছে,
আমরা যে দলেরই হই না কেনো-আমরা দেশ ও জাতির কল্যাণ চাই।আমরা মাতৃভূমিকে সুন্দর ভাবে সাজাতে চাই।

কিন্তু বাস্তবতার সামনে এই কথাগুলো যদি সত্য প্রমানিত করতে হয়,তাহলে ঐক্যভিত্তির রাজনীতি করতে হবে।ক্ষমতায় যে দলেই থাকুক না কেনো,রাষ্ট্রীয় স্বার্থে ক্ষমতাসীন দলকে,সি-পরামর্শ দিয়ে রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন কাজে সহযোগিতা করা,প্রতিটা রাজনৈতিক দল ও নাগরিকের নৈতিক দায়িত্ব। ক্ষমতাসীন দলের বিরুদ্ধে ততক্ষণ রুখে দাড়ানো যাবে না,যতক্ষণ না সে রাষ্ট্র বিরোধী কর্মকান্ডে জড়িত হচ্ছে। জাতির কল্যাণে ঐক্যভিত্তিক রাজনীতির বিকল্প কিছু নেই।ঐক্যভিত্তিক রাজনীতি হলো এমন এক রাজনৈতিক সংস্কৃতি যেখানে দলীয় পার্থক্য সত্ত্বেও সবাই জাতীয় স্বার্থে একসঙ্গে কাজ করে। এটি গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করে, সমাজে সহনশীলতা ও পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ গড়ে তোলে। একটি জাতির টেকসই উন্নয়ন তখনই সম্ভব, যখন রাজনৈতিক দলগুলো একে অপরকে শত্রু নয়, বরং সহযোগী প্রতিযোগী হিসেবে গ্রহণ করে।

ঐক্যভিত্তিক রাজনীতির তিনটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো:
সহনশীলতা: ভিন্নমতকে গ্রহণ করা ও শ্রদ্ধা করা।
সহযোগিতা: জাতীয় প্রয়োজনে বিরোধী দলগুলোরও একত্রে কাজ করা।
সুস্থ প্রতিযোগিতা: উন্নয়নমূলক কর্মসূচিতে কে ভালো করবে—এই প্রতিযোগিতা, কে কাকে ধ্বংস করবে তা নয়।

গণতন্ত্র ও প্রতিযোগিতার সম্পর্ক
গণতন্ত্রের প্রাণ হলো প্রতিযোগিতা। কিন্তু এই প্রতিযোগিতা হতে হবে নীতিনিষ্ঠ, নিয়মতান্ত্রিক ও জনগণের কল্যাণকেন্দ্রিক। নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকবেই, কিন্তু প্রতিদ্বন্দ্বী মানেই শত্রু নয়। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সরকার ও বিরোধী দল একে অপরের পরিপূরক। সরকারের ভুলত্রুটি ধরিয়ে দেওয়া বিরোধী দলের দায়িত্ব, আর সমালোচনাকে গ্রহণ করে সংশোধন করা সরকারের দায়িত্ব। এভাবেই গড়ে ওঠে একটি শক্তিশালী গণতন্ত্র।
যখন রাজনীতি প্রতিহিংসার পথে হাঁটে, তখন প্রতিযোগিতা হারিয়ে যায়। ক্ষমতায় থাকা মানে তখন ‘দমন’ আর বিরোধী থাকা মানে ‘ধ্বংস’। এই সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে কোনোদিনতোমায় জাতির উন্নয়ন সম্ভব নয়।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে প্রতিহিংসার রাজনীতি একটি বড় বাধা হিসেবে কাজ করেছে। স্বাধীনতার পর থেকেই রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক আস্থা ও সহযোগিতা গড়ে ওঠেনি। নির্বাচন, আন্দোলন, সরকার গঠন—সবক্ষেত্রেই দেখা গেছে সংঘাত, সহিংসতা ও অবিশ্বাসের চিত্র।

অন্যদিকে, উন্নত দেশগুলো যেমন যুক্তরাজ্য, কানাডা বা জাপানে বিরোধী দল সরকারকে গঠনমূলক সমালোচনা করে, আর সরকারও তাদের মতামতকে মূল্যায়ন করে। কিন্তু আমাদের দেশে বিরোধী দল মানেই “রাষ্ট্রবিরোধী”—এমন ধারণা দীর্ঘদিন ধরে রাজনীতিতে বিরাজ করছে। এই ধারা বদলাতে না পারলে জনগণ কখনোই প্রকৃত গণতন্ত্রের সুফল পাবে না।

ঐক্যভিত্তিক রাজনীতির সুফল
ঐক্যভিত্তিক রাজনীতি শুধু রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আনে না, এটি দেশের উন্নয়নেও সরাসরি ভূমিকা রাখে। এর সুফলগুলো হলো:
জাতীয় ঐক্য বৃদ্ধি: দল-মত নির্বিশেষে সবাই একসঙ্গে কাজ করলে জাতি শক্তিশালী হয়।
গণতন্ত্রের বিকাশ: পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সহনশীলতা গণতন্ত্রকে মজবুত করে।
অর্থনৈতিক অগ্রগতি: রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বিনিয়োগ ও উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করে।
আন্তর্জাতিক মর্যাদা বৃদ্ধি: ঐক্যবদ্ধ জাতি বিদেশে অধিক মর্যাদা পায়।
সামাজিক সম্প্রীতি: রাজনীতিতে শত্রুতা কমলে সমাজে ঘৃণার বদলে ভালোবাসা বাড়ে।

যুব সমাজ ও শিক্ষিত শ্রেণির ভূমিকা
ঐক্যভিত্তিক রাজনীতি গড়তে হলে তরুণ সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে। তরুণরাই একটি জাতির ভবিষ্যৎ। তারা যদি রাজনীতিতে আদর্শ, সততা ও মানবিকতা নিয়ে প্রবেশ করে, তাহলে প্রতিহিংসার জায়গা সংকুচিত হবে। শিক্ষিত শ্রেণিকেও নিরপেক্ষ থেকে সঠিক দিকনির্দেশনা দিতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ও গণমাধ্যম হতে পারে নীতিনিষ্ঠ রাজনীতির অনুপ্রেরণার কেন্দ্র।

ধর্মীয় ও নৈতিক দৃষ্টিকোণ
ইসলামসহ সব ধর্মই ন্যায়, সহনশীলতা ও ভ্রাতৃত্বের শিক্ষা দেয়। কুরআনে বলা হয়েছে: “তোমরা সবাই আল্লাহর দড়ি দৃঢ়ভাবে ধরো এবং বিভক্ত হয়ো না।” (সূরা আল-ইমরান: ১০৩)। এই আয়াতই প্রমাণ করে যে, বিভক্তি নয়—ঐক্যই শক্তি। রাজনৈতিক নেতাদের যদি এই শিক্ষা হৃদয়ে ধারণ করা যায়, তাহলে রাজনীতি হবে মানবতার সেবায় নিয়োজিত এক মহৎ কর্মযজ্ঞ।

ঐক্যভিত্তিক রাজনীতি গঠনের উপায়
১. রাজনৈতিক শিক্ষা বিস্তার: জনগণকে সচেতন করতে হবে যে রাজনীতি মানে প্রতিশোধ নয়, উন্নয়ন। ২. সংলাপ ও সমঝোতা সংস্কৃতি: মতবিরোধ সমাধানে সংলাপকে প্রাধান্য দিতে হবে। ৩. গণমাধ্যমের নিরপেক্ষ ভূমিকা: সংবাদপত্র ও টেলিভিশন যেন বিভেদ নয়, ঐক্য জাগায়। ৪. আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা: অপরাধ করলে যেই করুক, তার বিচার হবে—এই নীতি প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।প্রশাসনকে তার নিজস্ব গতিতে চলার অগ্রাধিকার দিতে হবে,কোন দলের এজেন্ডা বাস্তবায়নের মাধ্যম হিসেবে প্রশাসনকে ব্যবহার করা যাবে না। ৫. নৈতিক শিক্ষা: রাজনীতিবিদদের মধ্যে নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধ গড়ে তুলতে হবে।

বর্তমান প্রেক্ষাপটে বার্তা
আজকের বৈশ্বিক বিশ্বে প্রতিযোগিতা অপরিহার্য, কিন্তু সেই প্রতিযোগিতা হতে হবে নীতিনিষ্ঠ ও গঠনমূলক। কোনো জাতি তখনই এগিয়ে যেতে পারে যখন তার রাজনীতি ঐক্য, সহনশীলতা ও দায়িত্ববোধে পরিচালিত হয়। ক্ষমতা নয়—দেশপ্রেম, দল নয়—জাতি, এ চিন্তাধারা যদি রাজনীতিতে স্থান পায়, তাহলে বাংলাদেশ সত্যিকার অর্থে উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হবে

রাজনীতি একটি পবিত্র দায়িত্ব। এটি জাতির ভাগ্যনির্ধারণের মাধ্যম। কিন্তু যদি রাজনীতি প্রতিহিংসার কারণে কলুষিত হয়, তাহলে দেশ কখনোই এগিয়ে যেতে পারে না। তাই সময় এসেছে এই মনোবৃত্তির পরিবর্তনের। রাজনীতি হোক নীতির, ভালোবাসার, সহনশীলতার ও ঐক্যের— যেখানে প্রতিদ্বন্দ্বী হবে প্রতিপক্ষ নয়, বরং সহযোগী প্রতিযোগী; যেখানে লক্ষ্য হবে ক্ষমতা নয়, বরং জনগণের কল্যাণ; আর যেখানে শ্লোগান হবে— “প্রতিহিংসা নয় প্রতিযোগিতা, রাজনীতি হোক ঐক্য ভিত্তিক।”

ট্যাগস
আপলোডকারীর তথ্য

জনপ্রিয় সংবাদ

প্রতিহিংসা নয় প্রতিযোগিতা, রাজনীতি হোক ঐক্য ভিত্তিক

SBN

SBN

প্রতিহিংসা নয় প্রতিযোগিতা, রাজনীতি হোক ঐক্য ভিত্তিক

আপডেট সময় ০৮:০৭:০৩ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১৭ নভেম্বর ২০২৫

এম.কে.জাকির হোসাইন বিপ্লবী

রাজনীতি হচ্ছে রাষ্ট্র পরিচালনার কলা-কৌশল। এটি এমন এক মহৎ পেশা যার উদ্দেশ্য মানুষের কল্যাণ সাধন, সমাজে ন্যায় প্রতিষ্ঠা এবং জাতির সার্বিক উন্নয়ন নিশ্চিত করা। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, বর্তমান সময়ে রাজনীতি তার সেই মহৎ উদ্দেশ্য থেকে অনেকটাই বিচ্যুত হয়েছে। রাজনীতিতে নেমে এসেছে বিদ্বেষ, প্রতিহিংসা, বিভাজন ও সংঘাত। ক্ষমতা দখলের লড়াই যেন এখন নীতির চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। অথচ রাজনীতির মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত ছিল জনগণের ঐক্য, উন্নয়ন, এবং দেশকে একটি সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের পথে এগিয়ে নেওয়া। তাই সময় এসেছে নতুন করে ভাবার— রাজনীতি হোক ঐক্য ভিত্তিক, প্রতিহিংসা নয়, হোক সুষ্ঠু প্রতিযোগিতার মাধ্যমে পরিচালিত।

রাজনীতির মূল দর্শন
রাজনীতির মূল দর্শন হলো জনগণের সেবা। মহান দার্শনিক এরিস্টটল বলেছিলেন, “মানুষ একটি রাজনৈতিক প্রাণী”— কারণ মানুষ সমাজবদ্ধভাবে বাস করে এবং সমাজ পরিচালনার জন্য নেতৃত্বের প্রয়োজন হয়। এই নেতৃত্বই রাজনীতির জন্ম দিয়েছে।আমি আমার ব্যাক্তিগত গবেষণার আলোকে বলতে চাই,রাজনীতি এক মহৎ সাধনার ফলাফল। পৃথিবীতে যতো-রকম সাধনা রয়েছে,তার মাঝে রাজনীতি শ্রেষ্ঠ।রাজনীতিতে রয়েছে, আদর্শবাদিতা, দেশপ্রেম, মানবপ্রেম সহ গুরুত্বপূর্ন আরও অনেক বিষয়।কিন্তু যেই রাজনীতির মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে সমাজে শান্তি, ন্যায় ও সমতা প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু আজ রাজনীতি যেন তার নিজস্ব সৌন্দর্য হারিয়ে এক নিকৃষ্টতায় রুপান্তরিত হয়েছে। রাজনীতিবিদদের মধ্যে আদর্শ ও মূল্যবোধের পরিবর্তে প্রতিদ্বন্দ্বীকে ধ্বংস করার প্রবণতা বেড়ে গেছে। ফলে জনগণের মনে রাজনীতির প্রতি আস্থা কমে যাচ্ছে।

প্রতিহিংসার রাজনীতি: জাতির জন্য অভিশাপ
দেশ ও জাতির কল্যাণের জন্য যেই রাজনীতি আমাদের করার কথা,আজ তা জাতির ধ্বংস আর নিজেদের স্বার্থরক্ষার হাতিয়ারে পরিনত হয়েছে।বর্তমানে রাজনীতি মানে প্রতিহিংসার অভিশপ্ত বাণী আর জাতির জন্য এক হতাশার কালো জগৎ। প্রতিহিংশার রাজনীতি মানে হচ্ছে— বিরোধী পক্ষকে নিঃশেষ করা, প্রতিপক্ষকে দমন করা, এবং ক্ষমতায় আসতে বা থাকতে অন্যকে অপমান করা। এই ধারা একটি জাতির অগ্রগতিকে স্তব্ধ করে দেয়। প্রতিহিংসা রাজনীতির পরিবেশকে বিষাক্ত করে তোলে। এতে গণতন্ত্র দুর্বল হয়, প্রশাসন পক্ষপাতদুষ্ট হয়, এবং জনগণ বিভক্ত হয়ে পড়ে।

বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে প্রতিহিংসার প্রবণতা বহুকাল ধরে চলে আসছে। এক দলের ক্ষমতায় থাকা মানেই অন্য দলের জন্য কঠিন সময়—এমন বাস্তবতা দীর্ঘদিন ধরে আমরা দেখে আসছি। ক্ষমতার পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে প্রশাসন, বিচার বিভাগ, মিডিয়া ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও দলীয় প্রভাবের শিকার হয়। এতে রাজনীতি আর জনগণের কল্যাণের হাতিয়ার থাকে না, বরং হয়ে ওঠে প্রতিশোধের অস্ত্র। এর ফলেই সৃষ্টি হয় অবিশ্বাস, অস্থিতিশীলতা ও জাতীয় ঐক্যের অভাব।

ঐক্যভিত্তিক রাজনীতির প্রয়োজনীয়তা:-
আমাদের সকলের রাজনৈতিক মূল স্লোগান হচ্ছে,
আমরা যে দলেরই হই না কেনো-আমরা দেশ ও জাতির কল্যাণ চাই।আমরা মাতৃভূমিকে সুন্দর ভাবে সাজাতে চাই।

কিন্তু বাস্তবতার সামনে এই কথাগুলো যদি সত্য প্রমানিত করতে হয়,তাহলে ঐক্যভিত্তির রাজনীতি করতে হবে।ক্ষমতায় যে দলেই থাকুক না কেনো,রাষ্ট্রীয় স্বার্থে ক্ষমতাসীন দলকে,সি-পরামর্শ দিয়ে রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন কাজে সহযোগিতা করা,প্রতিটা রাজনৈতিক দল ও নাগরিকের নৈতিক দায়িত্ব। ক্ষমতাসীন দলের বিরুদ্ধে ততক্ষণ রুখে দাড়ানো যাবে না,যতক্ষণ না সে রাষ্ট্র বিরোধী কর্মকান্ডে জড়িত হচ্ছে। জাতির কল্যাণে ঐক্যভিত্তিক রাজনীতির বিকল্প কিছু নেই।ঐক্যভিত্তিক রাজনীতি হলো এমন এক রাজনৈতিক সংস্কৃতি যেখানে দলীয় পার্থক্য সত্ত্বেও সবাই জাতীয় স্বার্থে একসঙ্গে কাজ করে। এটি গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করে, সমাজে সহনশীলতা ও পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ গড়ে তোলে। একটি জাতির টেকসই উন্নয়ন তখনই সম্ভব, যখন রাজনৈতিক দলগুলো একে অপরকে শত্রু নয়, বরং সহযোগী প্রতিযোগী হিসেবে গ্রহণ করে।

ঐক্যভিত্তিক রাজনীতির তিনটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো:
সহনশীলতা: ভিন্নমতকে গ্রহণ করা ও শ্রদ্ধা করা।
সহযোগিতা: জাতীয় প্রয়োজনে বিরোধী দলগুলোরও একত্রে কাজ করা।
সুস্থ প্রতিযোগিতা: উন্নয়নমূলক কর্মসূচিতে কে ভালো করবে—এই প্রতিযোগিতা, কে কাকে ধ্বংস করবে তা নয়।

গণতন্ত্র ও প্রতিযোগিতার সম্পর্ক
গণতন্ত্রের প্রাণ হলো প্রতিযোগিতা। কিন্তু এই প্রতিযোগিতা হতে হবে নীতিনিষ্ঠ, নিয়মতান্ত্রিক ও জনগণের কল্যাণকেন্দ্রিক। নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকবেই, কিন্তু প্রতিদ্বন্দ্বী মানেই শত্রু নয়। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সরকার ও বিরোধী দল একে অপরের পরিপূরক। সরকারের ভুলত্রুটি ধরিয়ে দেওয়া বিরোধী দলের দায়িত্ব, আর সমালোচনাকে গ্রহণ করে সংশোধন করা সরকারের দায়িত্ব। এভাবেই গড়ে ওঠে একটি শক্তিশালী গণতন্ত্র।
যখন রাজনীতি প্রতিহিংসার পথে হাঁটে, তখন প্রতিযোগিতা হারিয়ে যায়। ক্ষমতায় থাকা মানে তখন ‘দমন’ আর বিরোধী থাকা মানে ‘ধ্বংস’। এই সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে কোনোদিনতোমায় জাতির উন্নয়ন সম্ভব নয়।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে প্রতিহিংসার রাজনীতি একটি বড় বাধা হিসেবে কাজ করেছে। স্বাধীনতার পর থেকেই রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক আস্থা ও সহযোগিতা গড়ে ওঠেনি। নির্বাচন, আন্দোলন, সরকার গঠন—সবক্ষেত্রেই দেখা গেছে সংঘাত, সহিংসতা ও অবিশ্বাসের চিত্র।

অন্যদিকে, উন্নত দেশগুলো যেমন যুক্তরাজ্য, কানাডা বা জাপানে বিরোধী দল সরকারকে গঠনমূলক সমালোচনা করে, আর সরকারও তাদের মতামতকে মূল্যায়ন করে। কিন্তু আমাদের দেশে বিরোধী দল মানেই “রাষ্ট্রবিরোধী”—এমন ধারণা দীর্ঘদিন ধরে রাজনীতিতে বিরাজ করছে। এই ধারা বদলাতে না পারলে জনগণ কখনোই প্রকৃত গণতন্ত্রের সুফল পাবে না।

ঐক্যভিত্তিক রাজনীতির সুফল
ঐক্যভিত্তিক রাজনীতি শুধু রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আনে না, এটি দেশের উন্নয়নেও সরাসরি ভূমিকা রাখে। এর সুফলগুলো হলো:
জাতীয় ঐক্য বৃদ্ধি: দল-মত নির্বিশেষে সবাই একসঙ্গে কাজ করলে জাতি শক্তিশালী হয়।
গণতন্ত্রের বিকাশ: পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সহনশীলতা গণতন্ত্রকে মজবুত করে।
অর্থনৈতিক অগ্রগতি: রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বিনিয়োগ ও উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করে।
আন্তর্জাতিক মর্যাদা বৃদ্ধি: ঐক্যবদ্ধ জাতি বিদেশে অধিক মর্যাদা পায়।
সামাজিক সম্প্রীতি: রাজনীতিতে শত্রুতা কমলে সমাজে ঘৃণার বদলে ভালোবাসা বাড়ে।

যুব সমাজ ও শিক্ষিত শ্রেণির ভূমিকা
ঐক্যভিত্তিক রাজনীতি গড়তে হলে তরুণ সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে। তরুণরাই একটি জাতির ভবিষ্যৎ। তারা যদি রাজনীতিতে আদর্শ, সততা ও মানবিকতা নিয়ে প্রবেশ করে, তাহলে প্রতিহিংসার জায়গা সংকুচিত হবে। শিক্ষিত শ্রেণিকেও নিরপেক্ষ থেকে সঠিক দিকনির্দেশনা দিতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ও গণমাধ্যম হতে পারে নীতিনিষ্ঠ রাজনীতির অনুপ্রেরণার কেন্দ্র।

ধর্মীয় ও নৈতিক দৃষ্টিকোণ
ইসলামসহ সব ধর্মই ন্যায়, সহনশীলতা ও ভ্রাতৃত্বের শিক্ষা দেয়। কুরআনে বলা হয়েছে: “তোমরা সবাই আল্লাহর দড়ি দৃঢ়ভাবে ধরো এবং বিভক্ত হয়ো না।” (সূরা আল-ইমরান: ১০৩)। এই আয়াতই প্রমাণ করে যে, বিভক্তি নয়—ঐক্যই শক্তি। রাজনৈতিক নেতাদের যদি এই শিক্ষা হৃদয়ে ধারণ করা যায়, তাহলে রাজনীতি হবে মানবতার সেবায় নিয়োজিত এক মহৎ কর্মযজ্ঞ।

ঐক্যভিত্তিক রাজনীতি গঠনের উপায়
১. রাজনৈতিক শিক্ষা বিস্তার: জনগণকে সচেতন করতে হবে যে রাজনীতি মানে প্রতিশোধ নয়, উন্নয়ন। ২. সংলাপ ও সমঝোতা সংস্কৃতি: মতবিরোধ সমাধানে সংলাপকে প্রাধান্য দিতে হবে। ৩. গণমাধ্যমের নিরপেক্ষ ভূমিকা: সংবাদপত্র ও টেলিভিশন যেন বিভেদ নয়, ঐক্য জাগায়। ৪. আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা: অপরাধ করলে যেই করুক, তার বিচার হবে—এই নীতি প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।প্রশাসনকে তার নিজস্ব গতিতে চলার অগ্রাধিকার দিতে হবে,কোন দলের এজেন্ডা বাস্তবায়নের মাধ্যম হিসেবে প্রশাসনকে ব্যবহার করা যাবে না। ৫. নৈতিক শিক্ষা: রাজনীতিবিদদের মধ্যে নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধ গড়ে তুলতে হবে।

বর্তমান প্রেক্ষাপটে বার্তা
আজকের বৈশ্বিক বিশ্বে প্রতিযোগিতা অপরিহার্য, কিন্তু সেই প্রতিযোগিতা হতে হবে নীতিনিষ্ঠ ও গঠনমূলক। কোনো জাতি তখনই এগিয়ে যেতে পারে যখন তার রাজনীতি ঐক্য, সহনশীলতা ও দায়িত্ববোধে পরিচালিত হয়। ক্ষমতা নয়—দেশপ্রেম, দল নয়—জাতি, এ চিন্তাধারা যদি রাজনীতিতে স্থান পায়, তাহলে বাংলাদেশ সত্যিকার অর্থে উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হবে

রাজনীতি একটি পবিত্র দায়িত্ব। এটি জাতির ভাগ্যনির্ধারণের মাধ্যম। কিন্তু যদি রাজনীতি প্রতিহিংসার কারণে কলুষিত হয়, তাহলে দেশ কখনোই এগিয়ে যেতে পারে না। তাই সময় এসেছে এই মনোবৃত্তির পরিবর্তনের। রাজনীতি হোক নীতির, ভালোবাসার, সহনশীলতার ও ঐক্যের— যেখানে প্রতিদ্বন্দ্বী হবে প্রতিপক্ষ নয়, বরং সহযোগী প্রতিযোগী; যেখানে লক্ষ্য হবে ক্ষমতা নয়, বরং জনগণের কল্যাণ; আর যেখানে শ্লোগান হবে— “প্রতিহিংসা নয় প্রতিযোগিতা, রাজনীতি হোক ঐক্য ভিত্তিক।”