
বিজয়ের মাস ডিসেম্বর এলেই হৃদয়ে ভেসে ওঠে স্বাধীনতার লাল সূর্যের গল্প, নয় মাসের রক্তঝরা সংগ্রামের ইতিহাস। ১৯৭১ সালের এই দিনের ধারাবাহিকতায়, ৫ ডিসেম্বর ছিল মুক্তিযুদ্ধের মোড় ঘোরানোর দিনগুলোর একটি, যখন একের পর এক জেলা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাত থেকে মুক্ত হতে থাকে। মুক্তাঞ্চলে উড়ে যায় লাল–সবুজের পতাকা, বিজয়ের ক্ষণ গতি পায় আরও তীব্র। এই দিনে দেশের বিভিন্ন স্থানে মুক্তিযোদ্ধাদের ঝটিকা আক্রমণ, সম্মুখযুদ্ধ এবং গেরিলা অভিযান পাকবাহিনীর মনোবল ভেঙে দেয়। আর এই সবকিছুর কেন্দ্রীয় প্রেরণা ছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান—যাঁর স্বাধীনতার ঘোষণা, নেতৃত্বের শক্তি এবং অদম্য সাহসই জাতিকে যুদ্ধের পথ দেখিয়েছিল।
পাকিস্তানের সামরিক জান্তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতায় আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার করে। পাকিস্তানকে রক্ষায় উদ্যোগ নেয় যুক্তরাষ্ট্র। একাত্তরের এই দিনে পূর্ব পাকিস্তানের যুদ্ধবিরতি কার্যকর করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে প্রস্তাব পেশ করে। এ প্রস্তাবের পাশাপাশি ভারত-পাকিস্তান সীমান্ত থেকে সৈন্য প্রত্যাহারসহ যুক্তরাষ্ট্র আরও কিছু প্রস্তাব উপস্থাপন করে।
নিরাপত্তা পরিষদের ১৪ সদস্যের মধ্যে বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পোল্যান্ড এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করে, তবে ১০টি দেশ প্রস্তাবের পক্ষে মত দেয়। ব্রিটেন ও ফ্রান্স ভোটদানে বিরত থাকে। এমনই পরিস্থিতিতে প্রস্তাবটি যাতে পাস হতে না পারে, সেজন্য সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রস্তাবের বিপক্ষে ভেটো প্রদান করায় প্রস্তাবের মৃত্যু ঘটে।
অন্যদিকে পূর্ব পাকিস্তানের গবর্নর ভারতীয় হামলা প্রতিরোধে প্রতিরক্ষা তহবিলে মুক্তহস্তে সবাইকে দান করার আহ্বান জানান। পাকিস্তানি সেনাপ্রধান অন্য এক ঘোষণায় অবসরপ্রাপ্ত ৫৫ বছরের কম বয়সী মেজর পর্যন্ত সব সৈনিককে নিকটস্থ রিক্রুটিং অফিসে হাজির হওয়ার জন্য আবার নির্দেশ দেন। বাঙালির জন্মভূমি আদায়ের লড়াইকে আড়াল করতে পাক-ভারত যুদ্ধ শুরু হয়েছে বলে বেতারে ঘোষণা দেন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান।
৫ ডিসেম্বর যে গুরুত্বপূর্ণ জেলা ও অঞ্চল হানাদারমুক্ত হয়েছিল, তার মধ্যে অন্যতম কুমিল্লা, মেহেরপুর, ঝিনাইদহ, দিনাজপুর, পাবনা, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, জয়পুরহাট, নরসিংদী, ফরিদপুরের কিছু অংশ, সহ আরও কয়েকটি এলাকা উল্লেখযোগ্য। এই সকল স্থানে মুক্তিযোদ্ধারা স্থানীয় জনগণকে সঙ্গে নিয়ে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মিলিত আক্রমণ চালান।
কুমিল্লা অঞ্চলে ৫ ডিসেম্বর ছিল তীব্র যুদ্ধের দিন। দেবিদ্বার, চান্দিনা, ব্রাহ্মণপাড়া, লাকসামসহ বিভিন্ন স্থানে মুক্তিযোদ্ধারা পাকবাহিনীর বাংকার ভেদ করে প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। দেবিদ্বারের যেসব স্থানে হানাদার বাহিনী ঘাঁটি বানিয়েছিল, সেখানে টানা হামলায় তাদের প্রধান অবস্থানগুলো ভেঙে পড়ে। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে সাধারণ জনগণের তরুণ দল যোগ দেয়, ফলে অল্প সময়েই পাকসেনারা এলাকা ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয় এবং সেদিন দেবিদ্বারের বড় অংশ শত্রুমুক্ত হয়। কুমিল্লার অন্যান্য এলাকাতেও ডিফেন্স লাইন ভেঙে পড়ে, ট্রানজিট ক্যাম্প মুক্ত হয় এবং অসংখ্য গ্রাম আবার স্বাধীনতার আলো দেখতে পায়।
মেহেরপুরে মুক্তিযোদ্ধারা পাকবাহিনীর রাস্তা ও ব্রিজ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে তাদের যোগাযোগ ব্যবস্থা ধ্বংস করে দেয়। আক্রমণ চালিয়ে হানাদারদের ঘাঁটি দখল করা হয়। ঝিনাইদহেও একই দিনে পাকিস্তানি বাহিনীর বড় অংশ আত্মসমর্পণ করে পালিয়ে যায়; মুক্তিযোদ্ধারা দখল নেন থানাসহ সরকারি স্থাপনাসমূহ। দিনাজপুরে ৫ ডিসেম্বর ছিল কঠিন লড়াইয়ের দিন। তীব্র লড়াই শেষে পাকবাহিনীর প্রধান ঘাঁটি ভেঙে যায়; স্থানীয় জনগণ মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে শহর হানাদারমুক্ত করে। পাবনার বিভিন্ন স্থানে মুক্তিযোদ্ধাদের ধারাবাহিক আক্রমণে শত্রুর প্রতিরোধ ভেঙে পড়ে। একইভাবে লালমনিরহাট–কুড়িগ্রাম সীমান্ত এলাকায় তুমুল যুদ্ধ শেষে পাকবাহিনী পরাজিত হয় এবং মুক্তিযোদ্ধারা পুরো অঞ্চল নিয়ন্ত্রণে নেন। নরসিংদীতেও সেদিন পাকবাহিনী পালাতে থাকে; শহরের গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলো মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে চলে যায়।
৫ ডিসেম্বরের এসব উল্লেখযোগ্য ঘটনাই ছিল ১৬ ডিসেম্বরের মহান বিজয়ের পূর্বাভাস। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদান ছাড়া এই ইতিহাস কল্পনাও করা যায় না। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর অমানবিক অত্যাচার, বৈষম্য ও রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধু ছিলেন মুক্তির প্রতীক। ’৬৬–র ছয় দফা আন্দোলন থেকে শুরু করে ’৭০-এর নির্বাচনে জনগণের রায়ের প্রতিফলন, ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ, “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম”—এই ঘোষণাই জাতিকে যুদ্ধে নামার প্রেরণা দেয়। তাঁর আহ্বানে বাঙালি জাতি অত্যাচারের বিরুদ্ধে হাতিয়ার তুলে নেয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাঁকে বন্দী করলেও তাঁর আদর্শ ও নেতৃত্ব মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল শতগুণ বাড়িয়ে দিয়েছিল, যা ৫ ডিসেম্বরের প্রতিটি যুদ্ধক্ষেত্রে বিজয়ের শক্তি হয়ে দাঁড়ায়।
বিজয়ের মাসের ৫ ডিসেম্বর তাই কেবল একটি তারিখ নয়—এটি মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনে অগ্রযাত্রার প্রতীক, হানাদারমুক্ত একের পর এক জেলার মুক্তির দিন, এবং বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পথে বাঙালি জাতির অপরাজেয় সংগ্রামের এক উজ্জ্বল অধ্যায়।
লেখক : মোহাম্মদ আলী সুমন, সাংবাদিক ও সংগঠক।
মুক্তির লড়াই ডেস্ক : 






















