ঢাকা ০৯:২৭ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১০ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম
Logo বিশ্ব মানবাধিকার দিবস: মর্যাদা, স্বাধীনতা ও সাম্যের এক অবিচল অঙ্গীকার Logo বিজয়ের শেষ সীমায় ঢাকা, অচল বন্দর, বিমানবন্দর, ঘিরে ফেলেছে মিত্রবাহিনী Logo কচুয়ায় বেগম জিয়ার সুস্থতার জন্য দোয়া Logo বুড়িচংয়ে ৪০ কেজি গাঁজা সহ এক মাদক ব্যবসায়ী আটক Logo বরুড়ায় বেগম রোকেয়া দিবসে শ্রেষ্ঠ অদম্য নারী সম্মাননা পেলেন ৫ জননী Logo এছিএমবির আয়োজনে ‘যোগ্য নেতৃত্ব নির্বাচনের মাধ্যমে মানবাধিকার উন্নয়ন’ শীর্ষক সেমিনার অনুষ্ঠিত Logo ঝিনাইদহে মহাসড়কের পাশের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ ও পরিচ্ছন্নতা অভিযান শুরু Logo ‎বরুড়ায় দুর্নীতিবিরোধী দিবস উদযাপন Logo ৯ ডিসেম্বর ১৯৭১: ঢাকার পানে বিজয়ের দুর্বার অগ্রযাত্রা, দিশেহারা পাকবাহিনী Logo মায়ানমারে পাচারকালে বিপুল পরিমাণ সিমেন্ট ও ময়দাসহ ৭ পাচারকারী আটক

বিজয়ের শেষ সীমায় ঢাকা, অচল বন্দর, বিমানবন্দর, ঘিরে ফেলেছে মিত্রবাহিনী

১০ ডিসেম্বর ১৯৭১: মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয়ের ঠিক প্রাক্কালে ১০ ডিসেম্বর ছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মিলিত আক্রমণের এক ঐতিহাসিক দিন। এদিন আকাশ, স্থল ও নৌ তিন বাহিনীতে মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর সমন্বিত অভিযান হানাদার বাহিনীকে পুরোপুরি বিপর্যস্ত করে দেয়। ঢাকার আকাশপথে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হলে নিশ্চিত হয়ে যায় পাকিস্তানি বাহিনীর আর কোনো রসদ বা সামরিক সহায়তা পাওয়ার সুযোগ নেই, পালানোর পথও প্রায় বন্ধ।

মিত্রবাহিনীর বিমান হামলায় সকাল থেকেই অচল হয়ে পড়ে রাজধানীর প্রধান বিমানঘাঁটি কুর্মিটোলা। শক্তিশালী বোমাবর্ষণে রানওয়ে, হ্যাঙ্গার ও যোগাযোগ ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে গেলে ঢাকায় সামরিক সহায়তা পাঠানোর আশা শেষ হয়। একই দিনে আঘাতে অচল হয়ে পড়ে দেশের দুটি প্রধান সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রাম ও চালনা। সমুদ্রপথে পালানোর বা রসদ আনার যে সামান্য সম্ভাবনা ছিল, তাও নিভে যায়।

এদিকে স্থলপথে উত্তরের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বিজয়ের পতাকা নিয়ে এগিয়ে আসে মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনী। ৯ ডিসেম্বরের ধারাবাহিকতায় ভৈরব বাজারের ঘাঁটি ভেঙে মেঘনা নদী পেরিয়ে দ্রুত ঢাকার দিকে অগ্রসর হয় ভারতীয় সেনারা। হেলিবোর্ন অভিযান ও স্টিমার কনভয়ে ঢাকার চারপাশে শক্ত ঘেরাও তৈরি হয়। পাকিস্তানি বাহিনীর প্রতিরক্ষা বেষ্টনী ভেঙে পড়ে একের পর এক।

নৌ-মহড়ায়ও নিশ্চিত হয় পাকিস্তানি সেনাদের পরাজয়ের ইঙ্গিত। ১০ ডিসেম্বর খুলনা-মোংলা এলাকায় অভিযানে অংশ নেয় যুদ্ধজাহাজ ‘পদ্মা’ ও ‘পলাশ’। মোংলা বন্দরের নৌঘাঁটিতে হামলার সময় পাকিস্তানি বিমান বাহিনীর আঘাতে ‘পদ্মা’ বিধ্বস্ত হয়ে ডুবে যায়। এতে বহু নৌ-কমান্ডো শহীদ হন। জাহাজে কর্মরত ইঞ্জিন রুম আর্টিফিসার মোহাম্মদ রুহুল আমিন গুরুতর পরিস্থিতিতে জাহাজ ত্যাগ করে তীরে ওঠেন, কিন্তু তীরে পৌঁছে পাকিস্তানি সেনাদের হাতে ধরা পড়ে নির্মমভাবে শহীদ হন। তার এই আত্মত্যাগ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে রয়েছে।

এদিন উত্তরাঞ্চলেও পাকিস্তানি বাহিনী সম্পূর্ণরূপে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। দিনাজপুর, রংপুর ও সৈয়দপুরের শত্রু বাহিনী নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করতে ব্যর্থ হয়। সমন্বিত প্রতিরক্ষা গড়ে তোলার শক্তি হারিয়ে তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে যেতে থাকে।

একই দিনে হানাদার মুক্ত হয়েছিলো-

মাদারীপুর: ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পর মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে দিশেহারা পাকিস্তানি বাহিনীর সদস্যদের আত্মসমার্পণের মধ্য দিয়ে শত্রুমুক্ত হয় মাদারীপুর। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে টানা দুইদিন এবং একরাত সম্মুখযুদ্ধ শেষে দিশেহারা হয়ে হানাদার বাহিনীর সদস্যরা মুক্তিযোদ্ধা খলিল বাহিনীর প্রধান খলিলুর রহমান খানের কাছে আত্মসমর্পণ করে। বিজয়ের পতাকা উড়ে মাদারীপুরের আকাশে। বিজয়ের খবর পৌঁছে গেলে বাইরে বের হয়ে আসে সাধারণ মানুষ। ভীতি কাটিয়ে ‘জয়বাংলা’ স্লোগানে মুখরিত হতে থাকে গ্রাম-মহল্লা।

রাণীনগর (নওগাঁ): স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা সূত্রে জানা যায়, ১৯৭১ সালের ২৪ এপ্রিল রাণীনগরে পাক বাহিনীরা অনুপ্রবেশ করে। এ সময় তারা নিরাপদ স্থান হিসেবে সদরে আহম্মদ আলীর বাসা, থানা ভবন ও পাইলট স্কুলসহ কয়েক জায়গায় ক্যাম্প স্থাপন করে। তৎকালীন সময়ে স্থানীয় কিছু রাজাকার, আলবদর ও তাদের দোসরদেরকে নিয়ে আতাইকুলা পালপাড়া, হরিপুর, স্থল-বড়বরিয়া গ্রামে গণহত্যা, নারী নির্যাতন, অগ্নি সংযোগ ও লুটপাটে মেতে উঠে। তারা আহম্মদ আলীর বাসায় বন্দী শিবির ও নির্যাতন কেন্দ্র বানিয়ে বহু নর-নারীকে পাশবিক নির্যাতন চালায়। ১৯৭১ সালের ৯ ডিসেম্বর সকাল ৯টায় রাণীনগর পাক হানাদার মুক্ত করার লক্ষ্যে মুক্তিযোদ্ধারা থানা সদরে থাকা হানাদার ক্যাম্প চারিদিক থেকে ঘেরাও করেন। মুক্তিযোদ্ধা ও পাক হানাদার বাহিনীর মধ্যে ৩৭ ঘণ্টা ব্যাপী তুমূল গোলা-গুলির শব্দে আকাশ-বাতাস ভারি হয়ে উঠে। ১০ ডিসেম্বর রাত আনুমানিক ১০ টায় মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে পাক-হানাদার বাহিনী ও তার দোসররা পালাতে শুরু করে। দীর্ঘ ৩৭ ঘন্টা সম্মুখ যুদ্ধে অবতীর্ন হয়ে শেষের দিকে উভয় পক্ষের গোলাগুলির এক পর্যায়ে ৪০ জন রাজাকার-আলবদর অস্ত্রসহ মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পন করে এবং রাণীনগর উপজেলা হানাদার মুক্ত হয়।

জামালপুর: ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর হানাদার বাহিনীর হাত থেকে মুক্ত হয়েছিল জামালপুর। এর আগে ০৯ ডিসেম্বর রাতভর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর প্রধান ক্যাম্প পিটিআই ঘাটির ওপর চতুমুখি গোলার আক্রমণ চালানো হয়। সেই আক্রমণে ৪ শতাধিক পাকিস্তানি সেনা নিহত হয় এবং আহত হয় আরও শতাধিক। ১০ ডিসেম্বর ভোরে মৃত্যুঞ্জয়ী খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা জহুরুল হক মুন্সীর (বীর প্রতীক বার) নেতৃত্বে হাজারও মুক্তিযোদ্ধা ও স্বাধীনতাকামী মানুষের ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে প্রকম্পিত হয় জামালপুর জেলা শহর। আকাশে উড়ানো হয় স্বাধীন বাংলার পতাকা। জামালপুর মুক্ত করে মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্র বাহিনীর বীর বিক্রমে টাঙ্গাইল হয়ে ঢাকার অভিমুখে রওনা হন। জামালপুরবাসী আজও ৯ ডিসেম্বরের রাতের যুদ্ধ ও ১০ ডিসেম্বরের জামালপুর শহরকে মুক্ত হওয়ার স্মৃতিকে হৃদয়ের মাঝে বহন করে আছেন। দিবসটি স্মরণীয় করে রাখতে প্রতি বছরই জেলা প্রশাসন ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে দিবসটি পালন করা হয়।

ভোলা : ১৯৭১ সালের এ দিনে পাকহানাদার বাহিনীর কবল থেকে মুক্ত হয় আজকের দ্বীপ জেলা ভোলা। সেদিন সকালে পাক বাহিনী ভোলা লঞ্চঘাট হয়ে কার্গো লঞ্চ যোগে পালিয়ে যায়। এ খবর পেয়ে হাজার হাজার মুক্তিকামী মানুষ ভোলার রাজপথে নেমে আসে। ‘জয় বাংলা’ ‘তোমার নেতা, আমার নেতা’ ‘শেখ মুজিব, শেখ মুজিব’ স্লোগানে স্লোাগানে মুখোরিত করে চারপাশ। বিজয়ের উল্লাসে মেতে উঠে সবাই। ডিসেম্বরের প্রথম থেকেই বিভিন্ন স্থান থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের বিজয়ের খবর আসতে শুরু করে। পাক হানাদারেরা নিশ্চিত পরাজয় টের পেয়ে পালানোর পথ খুঁজতে থাকে। ১০ ডিসেম্বর তাদের পালিয়ে যাওয়ার খবর চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লে শহরের ভোলার খালে ব্যারিকেড দিয়ে তাদের লঞ্চের গতিরোধ করার চেষ্টা করে মুক্তিকামী জনতা।
এসময় তারা গুলিবর্ষণ করতে করতে পালিয়ে যায়। পরে অবশ্য চাঁদপুরের ডাকাতিয়া নদীতে মিত্র বাহিনীর বিমান হামলায় কার্গো লঞ্চটি ডুবে গেলে পাক হানাদেরদের সকল সদস্য নিহত হয়।

এ ব্যাপারে বীর মুক্তিযোদ্ধা এম হাবিবুর রহমান বাসস’কে জানান, ভোলার পানি উন্নয়ন বোর্ড কার্যালয়ে (ওয়াপদা) পাক বাহিনীর অবস্থান ছিলো। ১০ ডিসেম্বর রাতে ওয়াপদা ঘেরাও এর পরিকল্পনা নেই আমরা মুক্তিযোদ্ধারা। কিন্তু তারা পরাজয় জেনে আগেই সটকে পরে সেখান থেকে। পরে তাদের পালিয়ে যাবার সময় ভোলার খালে আমরা প্রতিহতের চেষ্টা করি। পাকসেনাদের পালাবার খবরে হাজার-হাজার জনতা রাজপথে নেমে আসে বিজয় উল্লাসে।
তিনি বলেন, পাকসেনারা পালিয়ে গেলে ওয়াপদা থেকে ৩০ জন বীরঙ্গণাকে উদ্ধার করা হয়। তাদের চিকিৎসা শেষে পরিবারের কাছে পৌঁছে দেয়া হয়। সবার অংশগ্রহণে বিজয় র‌্যালি করি আমরা। এক অন্যরকম আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয় সেদিন।

নড়াইল: ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর এ দিনে নড়াইলের মুক্তিপাগল দামাল ছেলেরা বুকের তাজা রক্তদিয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে সম্মুখ যুদ্ধে পরাজিত করে নড়াইলকে মুক্ত করে। জেলা প্রশাসনের আয়োজনে দিবস উপলক্ষে বিভিন্ন কর্মসূচি পালিত হয়েছে। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে রুপগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের গণকবর, জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্সে ভবন, পুরাতন বাসটার্মিনালে বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল, জেলা জজ আদালত সংলগ্ন বদ্ধ ভূমিত ও জেলা শিল্পকলা একাডেমি চত্বরে শহীদ স্মৃতি স্তম্ভে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। শহীদদের স্মরণে এক মিনিট নীরাবতা পালন, বিশেষ মোনাজাত, র‌্যালি ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। পরে এনভায়রনমেন্টাল থিয়েটার ও সন্ধ্যায় জারি গানের আসর অনুষ্ঠিত হবে।

ময়মনসিংহ: ১৯৭১ সালের এইদিনে ময়মনসিংহ জেলা পাকহানাদার বাহিনী মুক্ত হয়েছিল। ১৯৭১ সালের এইদিনে বীর মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্রবাহিনীর সদস্যরা ভোরের দিকে ব্রহ্মপুত্র নদ পাড়ি দিয়ে বিজয়ে মিছিল সহকারে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক অধ্যক্ষ মতিউর রহমানের নেতৃত্বে স্থানীয় সার্কিট হাউজ মাঠে প্রবেশ করে এই সময় খবর পেয়ে শত-শত মুক্তিকামী নারী পুরুষ ও স্বজনরা রাস্তার দুধারে দাড়িয়ে আনন্দ উল্লাস করে এবং তাদের অভিবাদন জানান। এই সময় মুক্তিযোদ্ধাদের স্বজনরা তাদের প্রিয় মানুষদের এক নজর দেখে অনেকেই কান্নায় ভেঙে পড়ে। আনন্দের সাথে এই স্বজন হারানোর বেদনার এই দৃশ্যটি ছিল খুবই বেদনাদায়ক ও অভুতপূর্ব। মুক্তিকামী জনতা ও মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে অধ্যক্ষ মতিউর রহমান স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা সার্কিট হাউস মাঠে উত্তোলন করে ময়মনসিংহকে মুক্ত ঘোষণা করেন। ওই সময় চারদিক থেকে মুক্তিকামী জনতা নারী পুরুষ সার্কিট হাউস মাঠে জড়ো হয় এবং তারা আনন্দ উল্লাসে ফেটে পড়ে এবং জয় বাংলা স্লোগানে মুখরিত করে তোলে ঐতিহাসিক সার্কিট হাউস মাঠটি।এটি ছিল মুক্ত দিবসের এক বিরল দৃশ্য।

এদিকে এর আগের রাতে মুক্তিযোদ্ধাদের তাড়া খেয়ে পাকসেনারা ময়মনসিংহস্থ বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্প থেকে পালিয়ে টাঙ্গাইল হয়ে ঢাকা চলে যায়।

বিশ্বনাথ (সিলেট): ১৯৭১ সালের আজকের এই দিনে দেশের অন্যান্য স্থানের মতো এই এলাকার বীর মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি হায়েনা ও তাদের এদেশীয় দোসরদের পরাজিত করে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। এর মাধ্যমে পাকিস্তানি হানাদার মুক্ত হয় সিলেটের ঐতিহ্যবাহী জনপদ বিশ্বনাথ উপজেলা। এরপর থেকে ১০ ডিসেম্বর বিশ্বনাথ মুক্ত দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। ১০ ডিসেম্বর সকাল ১০টায় বিশ্বনাথ থানা সদরের বর্তমান রামসুন্দর সরকারি অগ্রগামী উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে সমাবেশ করে জাতীয় সংগীত পরিবেশনের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে বিশ্বনাথকে শক্র মুক্ত ঘোষণা করেন ৫ নম্বর সেক্টরের কোম্পানি কমান্ডার মো. আবদুন নূর।

১০ ডিসেম্বরের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছিল ভারতের পূর্বাঞ্চলে নিয়মিত পাকিস্তানি সেনাদের আত্মসমর্পণের শুরু। তৎকালীন পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের কর্নেল ও মেজরদের একটি বড় অংশ এদিন যুদ্ধবন্দী হয়। ঢাকার দিক থেকে দমনযজ্ঞ চালাতে পাঠানো বিখ্যাত ‘আনসার ফোর্স’ও বিভিন্ন স্থানে আত্মসমর্পণ করতে শুরু করে।

এছাড়া ১০ ডিসেম্বর রাতে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে পাকিস্তানি বাহিনীর উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে প্রথমবারের মতো আনুষ্ঠানিকভাবে ‘পরাজয় অনিবার্য’ বলে স্বীকার করা হয়। জেনারেল নিয়াজি ও তার কর্মকর্তারা গোপনে পালানোর পরিকল্পনা করলেও আকাশ-স্থলপথ অচল থাকায় সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হতে পারেনি।

দিনভর সম্মিলিত বাহিনীর অগ্রযাত্রা, বিচ্ছিন্ন পাকিস্তানি বাহিনী, অচল বন্দর-বিমানবন্দর এবং নৌ-যুদ্ধে ‘পদ্মা’র আত্মত্যাগ সব মিলিয়ে ১০ ডিসেম্বর স্পষ্ট হয়ে যায় যে, স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম শুধু সময়ের অপেক্ষা। বাংলাদেশের বিজয়ের শুভক্ষণ আর দূরে নয় এটাই ছিল ১০ ডিসেম্বর ১৯৭১-এর ঐতিহাসিক বার্তা।

লেখক : মোহাম্মদ আলী সুমন, সাংবাদিক ও সংগঠক।

ট্যাগস
আপলোডকারীর তথ্য

জনপ্রিয় সংবাদ

বিশ্ব মানবাধিকার দিবস: মর্যাদা, স্বাধীনতা ও সাম্যের এক অবিচল অঙ্গীকার

SBN

SBN

বিজয়ের শেষ সীমায় ঢাকা, অচল বন্দর, বিমানবন্দর, ঘিরে ফেলেছে মিত্রবাহিনী

আপডেট সময় ০৮:৩২:৩৫ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১০ ডিসেম্বর ২০২৫

১০ ডিসেম্বর ১৯৭১: মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয়ের ঠিক প্রাক্কালে ১০ ডিসেম্বর ছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মিলিত আক্রমণের এক ঐতিহাসিক দিন। এদিন আকাশ, স্থল ও নৌ তিন বাহিনীতে মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর সমন্বিত অভিযান হানাদার বাহিনীকে পুরোপুরি বিপর্যস্ত করে দেয়। ঢাকার আকাশপথে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হলে নিশ্চিত হয়ে যায় পাকিস্তানি বাহিনীর আর কোনো রসদ বা সামরিক সহায়তা পাওয়ার সুযোগ নেই, পালানোর পথও প্রায় বন্ধ।

মিত্রবাহিনীর বিমান হামলায় সকাল থেকেই অচল হয়ে পড়ে রাজধানীর প্রধান বিমানঘাঁটি কুর্মিটোলা। শক্তিশালী বোমাবর্ষণে রানওয়ে, হ্যাঙ্গার ও যোগাযোগ ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে গেলে ঢাকায় সামরিক সহায়তা পাঠানোর আশা শেষ হয়। একই দিনে আঘাতে অচল হয়ে পড়ে দেশের দুটি প্রধান সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রাম ও চালনা। সমুদ্রপথে পালানোর বা রসদ আনার যে সামান্য সম্ভাবনা ছিল, তাও নিভে যায়।

এদিকে স্থলপথে উত্তরের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বিজয়ের পতাকা নিয়ে এগিয়ে আসে মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনী। ৯ ডিসেম্বরের ধারাবাহিকতায় ভৈরব বাজারের ঘাঁটি ভেঙে মেঘনা নদী পেরিয়ে দ্রুত ঢাকার দিকে অগ্রসর হয় ভারতীয় সেনারা। হেলিবোর্ন অভিযান ও স্টিমার কনভয়ে ঢাকার চারপাশে শক্ত ঘেরাও তৈরি হয়। পাকিস্তানি বাহিনীর প্রতিরক্ষা বেষ্টনী ভেঙে পড়ে একের পর এক।

নৌ-মহড়ায়ও নিশ্চিত হয় পাকিস্তানি সেনাদের পরাজয়ের ইঙ্গিত। ১০ ডিসেম্বর খুলনা-মোংলা এলাকায় অভিযানে অংশ নেয় যুদ্ধজাহাজ ‘পদ্মা’ ও ‘পলাশ’। মোংলা বন্দরের নৌঘাঁটিতে হামলার সময় পাকিস্তানি বিমান বাহিনীর আঘাতে ‘পদ্মা’ বিধ্বস্ত হয়ে ডুবে যায়। এতে বহু নৌ-কমান্ডো শহীদ হন। জাহাজে কর্মরত ইঞ্জিন রুম আর্টিফিসার মোহাম্মদ রুহুল আমিন গুরুতর পরিস্থিতিতে জাহাজ ত্যাগ করে তীরে ওঠেন, কিন্তু তীরে পৌঁছে পাকিস্তানি সেনাদের হাতে ধরা পড়ে নির্মমভাবে শহীদ হন। তার এই আত্মত্যাগ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে রয়েছে।

এদিন উত্তরাঞ্চলেও পাকিস্তানি বাহিনী সম্পূর্ণরূপে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। দিনাজপুর, রংপুর ও সৈয়দপুরের শত্রু বাহিনী নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করতে ব্যর্থ হয়। সমন্বিত প্রতিরক্ষা গড়ে তোলার শক্তি হারিয়ে তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে যেতে থাকে।

একই দিনে হানাদার মুক্ত হয়েছিলো-

মাদারীপুর: ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পর মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে দিশেহারা পাকিস্তানি বাহিনীর সদস্যদের আত্মসমার্পণের মধ্য দিয়ে শত্রুমুক্ত হয় মাদারীপুর। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে টানা দুইদিন এবং একরাত সম্মুখযুদ্ধ শেষে দিশেহারা হয়ে হানাদার বাহিনীর সদস্যরা মুক্তিযোদ্ধা খলিল বাহিনীর প্রধান খলিলুর রহমান খানের কাছে আত্মসমর্পণ করে। বিজয়ের পতাকা উড়ে মাদারীপুরের আকাশে। বিজয়ের খবর পৌঁছে গেলে বাইরে বের হয়ে আসে সাধারণ মানুষ। ভীতি কাটিয়ে ‘জয়বাংলা’ স্লোগানে মুখরিত হতে থাকে গ্রাম-মহল্লা।

রাণীনগর (নওগাঁ): স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা সূত্রে জানা যায়, ১৯৭১ সালের ২৪ এপ্রিল রাণীনগরে পাক বাহিনীরা অনুপ্রবেশ করে। এ সময় তারা নিরাপদ স্থান হিসেবে সদরে আহম্মদ আলীর বাসা, থানা ভবন ও পাইলট স্কুলসহ কয়েক জায়গায় ক্যাম্প স্থাপন করে। তৎকালীন সময়ে স্থানীয় কিছু রাজাকার, আলবদর ও তাদের দোসরদেরকে নিয়ে আতাইকুলা পালপাড়া, হরিপুর, স্থল-বড়বরিয়া গ্রামে গণহত্যা, নারী নির্যাতন, অগ্নি সংযোগ ও লুটপাটে মেতে উঠে। তারা আহম্মদ আলীর বাসায় বন্দী শিবির ও নির্যাতন কেন্দ্র বানিয়ে বহু নর-নারীকে পাশবিক নির্যাতন চালায়। ১৯৭১ সালের ৯ ডিসেম্বর সকাল ৯টায় রাণীনগর পাক হানাদার মুক্ত করার লক্ষ্যে মুক্তিযোদ্ধারা থানা সদরে থাকা হানাদার ক্যাম্প চারিদিক থেকে ঘেরাও করেন। মুক্তিযোদ্ধা ও পাক হানাদার বাহিনীর মধ্যে ৩৭ ঘণ্টা ব্যাপী তুমূল গোলা-গুলির শব্দে আকাশ-বাতাস ভারি হয়ে উঠে। ১০ ডিসেম্বর রাত আনুমানিক ১০ টায় মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে পাক-হানাদার বাহিনী ও তার দোসররা পালাতে শুরু করে। দীর্ঘ ৩৭ ঘন্টা সম্মুখ যুদ্ধে অবতীর্ন হয়ে শেষের দিকে উভয় পক্ষের গোলাগুলির এক পর্যায়ে ৪০ জন রাজাকার-আলবদর অস্ত্রসহ মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পন করে এবং রাণীনগর উপজেলা হানাদার মুক্ত হয়।

জামালপুর: ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর হানাদার বাহিনীর হাত থেকে মুক্ত হয়েছিল জামালপুর। এর আগে ০৯ ডিসেম্বর রাতভর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর প্রধান ক্যাম্প পিটিআই ঘাটির ওপর চতুমুখি গোলার আক্রমণ চালানো হয়। সেই আক্রমণে ৪ শতাধিক পাকিস্তানি সেনা নিহত হয় এবং আহত হয় আরও শতাধিক। ১০ ডিসেম্বর ভোরে মৃত্যুঞ্জয়ী খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা জহুরুল হক মুন্সীর (বীর প্রতীক বার) নেতৃত্বে হাজারও মুক্তিযোদ্ধা ও স্বাধীনতাকামী মানুষের ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে প্রকম্পিত হয় জামালপুর জেলা শহর। আকাশে উড়ানো হয় স্বাধীন বাংলার পতাকা। জামালপুর মুক্ত করে মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্র বাহিনীর বীর বিক্রমে টাঙ্গাইল হয়ে ঢাকার অভিমুখে রওনা হন। জামালপুরবাসী আজও ৯ ডিসেম্বরের রাতের যুদ্ধ ও ১০ ডিসেম্বরের জামালপুর শহরকে মুক্ত হওয়ার স্মৃতিকে হৃদয়ের মাঝে বহন করে আছেন। দিবসটি স্মরণীয় করে রাখতে প্রতি বছরই জেলা প্রশাসন ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে দিবসটি পালন করা হয়।

ভোলা : ১৯৭১ সালের এ দিনে পাকহানাদার বাহিনীর কবল থেকে মুক্ত হয় আজকের দ্বীপ জেলা ভোলা। সেদিন সকালে পাক বাহিনী ভোলা লঞ্চঘাট হয়ে কার্গো লঞ্চ যোগে পালিয়ে যায়। এ খবর পেয়ে হাজার হাজার মুক্তিকামী মানুষ ভোলার রাজপথে নেমে আসে। ‘জয় বাংলা’ ‘তোমার নেতা, আমার নেতা’ ‘শেখ মুজিব, শেখ মুজিব’ স্লোগানে স্লোাগানে মুখোরিত করে চারপাশ। বিজয়ের উল্লাসে মেতে উঠে সবাই। ডিসেম্বরের প্রথম থেকেই বিভিন্ন স্থান থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের বিজয়ের খবর আসতে শুরু করে। পাক হানাদারেরা নিশ্চিত পরাজয় টের পেয়ে পালানোর পথ খুঁজতে থাকে। ১০ ডিসেম্বর তাদের পালিয়ে যাওয়ার খবর চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লে শহরের ভোলার খালে ব্যারিকেড দিয়ে তাদের লঞ্চের গতিরোধ করার চেষ্টা করে মুক্তিকামী জনতা।
এসময় তারা গুলিবর্ষণ করতে করতে পালিয়ে যায়। পরে অবশ্য চাঁদপুরের ডাকাতিয়া নদীতে মিত্র বাহিনীর বিমান হামলায় কার্গো লঞ্চটি ডুবে গেলে পাক হানাদেরদের সকল সদস্য নিহত হয়।

এ ব্যাপারে বীর মুক্তিযোদ্ধা এম হাবিবুর রহমান বাসস’কে জানান, ভোলার পানি উন্নয়ন বোর্ড কার্যালয়ে (ওয়াপদা) পাক বাহিনীর অবস্থান ছিলো। ১০ ডিসেম্বর রাতে ওয়াপদা ঘেরাও এর পরিকল্পনা নেই আমরা মুক্তিযোদ্ধারা। কিন্তু তারা পরাজয় জেনে আগেই সটকে পরে সেখান থেকে। পরে তাদের পালিয়ে যাবার সময় ভোলার খালে আমরা প্রতিহতের চেষ্টা করি। পাকসেনাদের পালাবার খবরে হাজার-হাজার জনতা রাজপথে নেমে আসে বিজয় উল্লাসে।
তিনি বলেন, পাকসেনারা পালিয়ে গেলে ওয়াপদা থেকে ৩০ জন বীরঙ্গণাকে উদ্ধার করা হয়। তাদের চিকিৎসা শেষে পরিবারের কাছে পৌঁছে দেয়া হয়। সবার অংশগ্রহণে বিজয় র‌্যালি করি আমরা। এক অন্যরকম আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয় সেদিন।

নড়াইল: ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর এ দিনে নড়াইলের মুক্তিপাগল দামাল ছেলেরা বুকের তাজা রক্তদিয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে সম্মুখ যুদ্ধে পরাজিত করে নড়াইলকে মুক্ত করে। জেলা প্রশাসনের আয়োজনে দিবস উপলক্ষে বিভিন্ন কর্মসূচি পালিত হয়েছে। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে রুপগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের গণকবর, জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্সে ভবন, পুরাতন বাসটার্মিনালে বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল, জেলা জজ আদালত সংলগ্ন বদ্ধ ভূমিত ও জেলা শিল্পকলা একাডেমি চত্বরে শহীদ স্মৃতি স্তম্ভে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। শহীদদের স্মরণে এক মিনিট নীরাবতা পালন, বিশেষ মোনাজাত, র‌্যালি ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। পরে এনভায়রনমেন্টাল থিয়েটার ও সন্ধ্যায় জারি গানের আসর অনুষ্ঠিত হবে।

ময়মনসিংহ: ১৯৭১ সালের এইদিনে ময়মনসিংহ জেলা পাকহানাদার বাহিনী মুক্ত হয়েছিল। ১৯৭১ সালের এইদিনে বীর মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্রবাহিনীর সদস্যরা ভোরের দিকে ব্রহ্মপুত্র নদ পাড়ি দিয়ে বিজয়ে মিছিল সহকারে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক অধ্যক্ষ মতিউর রহমানের নেতৃত্বে স্থানীয় সার্কিট হাউজ মাঠে প্রবেশ করে এই সময় খবর পেয়ে শত-শত মুক্তিকামী নারী পুরুষ ও স্বজনরা রাস্তার দুধারে দাড়িয়ে আনন্দ উল্লাস করে এবং তাদের অভিবাদন জানান। এই সময় মুক্তিযোদ্ধাদের স্বজনরা তাদের প্রিয় মানুষদের এক নজর দেখে অনেকেই কান্নায় ভেঙে পড়ে। আনন্দের সাথে এই স্বজন হারানোর বেদনার এই দৃশ্যটি ছিল খুবই বেদনাদায়ক ও অভুতপূর্ব। মুক্তিকামী জনতা ও মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে অধ্যক্ষ মতিউর রহমান স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা সার্কিট হাউস মাঠে উত্তোলন করে ময়মনসিংহকে মুক্ত ঘোষণা করেন। ওই সময় চারদিক থেকে মুক্তিকামী জনতা নারী পুরুষ সার্কিট হাউস মাঠে জড়ো হয় এবং তারা আনন্দ উল্লাসে ফেটে পড়ে এবং জয় বাংলা স্লোগানে মুখরিত করে তোলে ঐতিহাসিক সার্কিট হাউস মাঠটি।এটি ছিল মুক্ত দিবসের এক বিরল দৃশ্য।

এদিকে এর আগের রাতে মুক্তিযোদ্ধাদের তাড়া খেয়ে পাকসেনারা ময়মনসিংহস্থ বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্প থেকে পালিয়ে টাঙ্গাইল হয়ে ঢাকা চলে যায়।

বিশ্বনাথ (সিলেট): ১৯৭১ সালের আজকের এই দিনে দেশের অন্যান্য স্থানের মতো এই এলাকার বীর মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি হায়েনা ও তাদের এদেশীয় দোসরদের পরাজিত করে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। এর মাধ্যমে পাকিস্তানি হানাদার মুক্ত হয় সিলেটের ঐতিহ্যবাহী জনপদ বিশ্বনাথ উপজেলা। এরপর থেকে ১০ ডিসেম্বর বিশ্বনাথ মুক্ত দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। ১০ ডিসেম্বর সকাল ১০টায় বিশ্বনাথ থানা সদরের বর্তমান রামসুন্দর সরকারি অগ্রগামী উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে সমাবেশ করে জাতীয় সংগীত পরিবেশনের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে বিশ্বনাথকে শক্র মুক্ত ঘোষণা করেন ৫ নম্বর সেক্টরের কোম্পানি কমান্ডার মো. আবদুন নূর।

১০ ডিসেম্বরের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছিল ভারতের পূর্বাঞ্চলে নিয়মিত পাকিস্তানি সেনাদের আত্মসমর্পণের শুরু। তৎকালীন পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের কর্নেল ও মেজরদের একটি বড় অংশ এদিন যুদ্ধবন্দী হয়। ঢাকার দিক থেকে দমনযজ্ঞ চালাতে পাঠানো বিখ্যাত ‘আনসার ফোর্স’ও বিভিন্ন স্থানে আত্মসমর্পণ করতে শুরু করে।

এছাড়া ১০ ডিসেম্বর রাতে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে পাকিস্তানি বাহিনীর উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে প্রথমবারের মতো আনুষ্ঠানিকভাবে ‘পরাজয় অনিবার্য’ বলে স্বীকার করা হয়। জেনারেল নিয়াজি ও তার কর্মকর্তারা গোপনে পালানোর পরিকল্পনা করলেও আকাশ-স্থলপথ অচল থাকায় সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হতে পারেনি।

দিনভর সম্মিলিত বাহিনীর অগ্রযাত্রা, বিচ্ছিন্ন পাকিস্তানি বাহিনী, অচল বন্দর-বিমানবন্দর এবং নৌ-যুদ্ধে ‘পদ্মা’র আত্মত্যাগ সব মিলিয়ে ১০ ডিসেম্বর স্পষ্ট হয়ে যায় যে, স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম শুধু সময়ের অপেক্ষা। বাংলাদেশের বিজয়ের শুভক্ষণ আর দূরে নয় এটাই ছিল ১০ ডিসেম্বর ১৯৭১-এর ঐতিহাসিক বার্তা।

লেখক : মোহাম্মদ আলী সুমন, সাংবাদিক ও সংগঠক।