ঢাকা ০৯:২৭ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৯ নভেম্বর ২০২৫, ৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম
Logo ভোলাহাট রেশম উন্নয়ন বোর্ডের জোনাল অফিস দুর্নীতির আখড়া Logo বরুড়া সুন্নিয়া কামিল মাদ্রাসার ১১ অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকের বিদায় সংবর্ধনা Logo টেকনাফে বিপুল পরিমাণ ইয়াবাসহ ১ মাদক পাচারকারী আটক Logo শেরপুরে ১ বছর সাজাপ্রাপ্ত পলাতক কয়েদী গ্রেফতার Logo ঝিনাইদহে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে তিন দিনব্যাপী প্রশিক্ষণ সম্পন্ন Logo বরগুনা জেলা শিক্ষা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি Logo এক ক্ষেতে বহু ফসল: ইউনান লং চিয়াং উপজেলার সবুজ উন্নয়ন Logo তাইওয়ানে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র বিক্রি, চীনের তীব্র নিন্দা Logo কালীগঞ্জে এলজিইডি’র সড়ক নির্মাণে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার করার অভিযোগ Logo ঢাকায় চীনা চলচ্চিত্র ‘স্নো লেপার্ড’ এর প্রদর্শনী

সরকারের কোটি কোটি টাকা গচ্চা

ভোলাহাট রেশম উন্নয়ন বোর্ডের জোনাল অফিস দুর্নীতির আখড়া

মোঃ সোহেল আমান ,রাজশাহী ব্যুরো

চাঁপাইনবাবগঞ্জে রেশম উন্নয়ন বোর্ডের ভোলাহাট জোনাল অফিস যেন দুর্নীতির আখড়া! ক্ষয়িষ্ণু রেশম চাষকে পুনরুজ্জীবিত করার লক্ষ্যে সরকার বেশকিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও অনিয়ম, স্বজনপ্রীতি আর দুর্নীতির কবলে উদ্দিষ্ট লক্ষ্য ভেস্তে গেছে। সরকারী অনুদানে রেশম চাষীদের পলুঘর নির্মাণ, তুঁতচারা রোপণ, প্রশিক্ষণ প্রদান ও অন্যান্য উপকরণ বিতরণে অনিয়ম, ফাঁকিবাজী আর ভাগ-বাটোয়ারার কারণে শুধুই অর্থ অপচয় হয়েছে সরকারের, উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি। এছাড়া রেশমগুটি, রেশমসূতা ও রেশমজাত পণ্যের বাজার না থাকায় “রেশমচাষ” কথিত উন্নয়নের চোরাবালীতে নিশ্চিহ্ন হবার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছে এমন অভিযোগ করেছেন প্রকৃত রেশমচাষীরা।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, রেশম চাষের উন্নয়ন ও এর কৃষিজাত শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে সরকার রেশম চাষী “বসনীদের” একেকজনকে এক বিঘা জমিতে তুঁত চারা (তুঁত মূড়া) রোপণের জন্য ২৫ হাজার টাকা, পলু ঘর নির্মাণের জন্য ১ লাখ টাকা এবং ৬০ হাজার টাকা মূল্যের পলু পালনের উপকরণ (ডালা, চন্দ্রকী, ঘরাশুলা) ও ৩২টি নেট অনুদান প্রদান করার জন্য প্রকল্প গ্রহণ করে। এছাড়া প্রত্যেক বসনীকে ২৬ দিনের প্রশিক্ষণ বাবদ ১৩ হাজার টাকা ভাতা প্রদান করা হয়। এর সাথে পলুপোকার ডিম বিনামূল্যে বিতরণ করা হয় তাদের মাঝে। সবকিছুই সরকারী ভাবে দেয়া হয়, শুধু শ্রম দেয় রেশমচাষী বা বসনীরা।

উপজেলার সদর ইউনিয়নের ধরমপুর গ্রামের বসনী তোফাজ্জল হোসেন জানান, যাদের নিজস্ব জমি নেই তারা অপরের ১ বিঘা জমি অন্তত ১০ বছরের জন্য লীজ গ্রহণ করলে তুঁত মূড়া রোপণ বাবদ ২৫ হাজার টাকা ও পলুঘর নির্মাণ বাবদ ১ লাখ টাকা ১ জন বসনী অনুদান পাবেন। এছাড়া প্রায় ৬০ হাজার টাকা মূল্যের ডালা, চন্দ্রকী, ঘরাশুলা ও ৩২টি নেট পাবেন; আর প্রশিক্ষণ বাবদ পাবেন ২৬ দিনে ১৩ হাজার টাকা। কিন্তু ৩শ’ টাকার নন-জুডিশিয়্যাল ষ্ট্যাম্পে তুঁত মূড়া রোপণের জন্য ১ বিঘা জমির ভূয়া ডিড তৈরি করে যোগসাজশী ভাবে জমি তৈরীর জন্য ২৫ হাজার টাকা ও পলুঘর নির্মাণের জন্য ১ লাখ টাকা সরকারী কোষাগার থেকে উঠিয়ে ভাগ-বাটোয়ারা করে নেয়া হয়। আর নির্মাণকৃত ঘর অপরিকল্পিত ভাবে দুর্বল করে তৈরি করা হয়।
এমনকি ধরমপুর গ্রামের আসিরুদ্দিনের ছেলে সাইদকে পুরাতন পলুঘর দেখিয়েই ১ লাখ টাকা বরাদ্দ করে ভাগ-বাটোয়ারা করে নেয়া হয়। ইমামনগর গ্রামের বাসেদ আলী জানান, তাঁকে ঘর নির্মাণ বাবদ ৭০ হাজার টাকা দিয়ে ৩০ হাজার টাকা অফিসের লোকেরা নিয়ে নেন। বর্তমানে তিনি জমি থেকে তুঁতমূড়া মেরে দিয়েছেন। একই গ্রামের সাজেদ আলী পলু পালন করেন না। অথচ ভোলাহাট জোনাল অফিসের অস্থায়ী কর্মচারী মনিরুল ইসলাম এ ব্যক্তিকে (মনিরুলের শ্বশুড়কে) পলুঘর নির্মাণ বাবদ অনুদানসহ প্রয়োজনীয় সুবিধা প্রদান করেছেন। পলু পালন করেন না এমন ব্যক্তিকে অনুদান দেয়ার অভিযোগ অনেক । পলুঘর নির্মাণের টাকা মোবাইল নম্বরে ৪ কিস্তিতে বিতরণ করা হয়। পলুঘর নির্মাণ বাবদ ৭০ হাজার টাকা বসনীকে দিয়ে ৩০ হাজার টাকা এডি, রেশম বোর্ডের সদস্য সমিরুদ্দিন, অস্থায়ী কর্মচারী মনিরুল ইসলাম ও বসনী সমিতির সেক্রেটারী মোঃ সেকামউদ্দিন গং ভাগ-বাটোয়ারা করে নেন। সমস্ত কিছু অনুদান ও প্রশিক্ষণ পাওয়া হয়ে গেলে রেশমচাষ বন্ধ করে দিচ্ছে সুবিধাভোগীরা। চরধরমপুর গ্রামের ইমাম হোসেন মাষ্টারের চার ছেলে সাইফুল্লাহ্, সফিউল্লাহ, আমানুল্লাহ ও ওলিউল্লাহ ৪টি ঘরসহ সকল সুবিধাদি নিয়ে জমি থেকে তুঁতমূড়া উপড়ে ফেলে পলুপালন বন্ধ করে দিয়েছে। বর্তমানে ২৭০ জন বসনী এ অনুদান প্রকল্পের আওতায় সুবিধা ভোগ করছেন। এর আগে ১২ হাজার বসনী (রেশমচাষী) ভোলাহাট উপজেলায় রেশম চাষ করতো। বছরে ৫ বার (৫টি বন্দ্) রেশমগুটি বা পলুপালন করা হতো।

পলুপোকার খাদ্য তুঁতপাতা। নিয়মানুযায়ী ১ বিঘা জমিতে তুঁতচারা রোপণের জন্য ২৫ হাজার টাকা অনুদান পাবেন বসনীরা। কিন্তু তিন কাঠা, পাঁচ কাঠা বা সাত/দশ কাঠা জমিকে কাগজে এক বিঘা দেখিয়ে ২৫ হাজার টাকা অনুদান আত্মসাৎ করা হয়। আর ১ বিঘা তুঁত জমি ও ১ খোপ (১ ঘরা=১৬ ডালা) পলু পালনের বিপরীতে ১টি পলুঘর নির্মাণের জন্য একজন বসনী ১ লাখ টাকা ও অন্যান্য উপকরণ পাবার যোগ্য। সব রকমের অনুদান পাওয়া হয়ে গেলে পলুপোকার ডিম (বীজ) রেশম বীজাগার হতে গ্রহণ করার পর বাড়ীতে নিয়ে এসে পলুপালন (রেশমচাষ) না করে বীজগুলো ফেলে দেয় সুবিধাভোগীরা। এমনকি অনুদানের টাকায় পলুঘর নির্মাণ না করে এটাচ্ বাথরুমসহ শয়নকক্ষ ও গোয়ালঘর নির্মাণ করেছে কতক বসনী! যা সরেজমিনে গোহালবাড়ী গ্রামের ফারহানা খাতুনের পলুঘর কোড-২৪৬ তে প্রত্যক্ষ করা গেছে।

প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী রেশম শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে সরকার কোটি কোটি টাকা অনুদান বিতরণ করছেন কিন্তু রেশম বোর্ড ভোলাহাট জোন এডি তরিকুল ইসলাম, বাংলাদেশ রেশম উন্নয়ন বোর্ডের সদস্য (বসনী প্রতিনিধি) মোঃ সমিরুদ্দিন, অস্থায়ী কর্মচারী মনিরুল ইসরাম ও রেশম বসনী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোঃ সেকামউদ্দিন গং সিন্ডিকেট বিভিন্ন কৌশলে সরকারী অনুদান আত্মসাৎ করছেন। ফলে রেশমের উন্নয়ন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এসে ঠেকেছে। ধরমপুর গ্রামে ১৪ জন বসনী ছিল, এখন মাত্র ৪ জন বসনী টিকে আছে। গোহালবাড়ী গ্রামেও ১৪ জন বসনী ছিল, এখন টিকে আছেন ২ জন। তারাও রেশম চাষ বন্ধ করে দিবেন বলে জানা গেছে। অথচ সকলেই অনুদান ভোগ করেছেন। পলুপালন না করে অনেক বসনী তুঁত জমিতে মিষ্টি কুমড়ার চাষ করছেন। স্বয়ং রেশম উন্নয়ন বোর্ডের সদস্য (বসনী প্রতিনিধি) সমিরুদ্দিন তুঁত জমিতে মিষ্টি কুমড়ার চাষ করছে বলে প্রত্যক্ষ করা গেছে।

প্রত্যেক বসনীকে প্রশিক্ষণ দেয়ার কথা থাকলেও সবাইকে প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে না! অনেককে বারংবার প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে অর্ধেক প্রশিক্ষণ ভাতার বিনিময়ে। প্রশিক্ষণ শুরুর আগেই ঐ অর্ধেক টাকা হাতিয়ে নেন কর্তারা। পলুপালনের সাথে জড়িত নন এমন নারী-পুরুষকেও দুর্নীতির আশ্রয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে! অথচ প্রশিক্ষণ না পাবার অভিমানে ধরমপুর গ্রামের আব্দুল আউয়াল পলুপালন বন্ধ করে দিয়েছেন। প্রশিক্ষণ পাননি এমন অভিযোগ অনেক।

বসনীদের অভিযোগ, বীজাণুমুক্ত ও উন্নত জাতের পলুপোকার ডিম সরবরাহ করা হচ্ছে না। প্রায়শই পলুপোকা গুলো নষ্ট হয় এবং বসনীরা ক্ষতিগ্রস্ত হন। এর পেছনেও কর্তাদের অসৎ উদ্দেশ্য আছে বলে বসনীদের দাবী। আর চীন ও ভারতে যখন উন্নত জাতের “পলু” (রেশম পোকা বা রেশম মথ) পালন করা হচ্ছে, সেখানে আমাদের দেশে পুরনো জাতের “পলু”র চাষ রয়ে গেছে। বাংলাদেশ রেশম উন্নয়ন বোর্ডের গবেষণাগার থাকলেও কার্যতঃ কোন সুফল পাচ্ছেন না বসনীরা। ফলে রেশমগুটির মান ও ফলন খুবই কম।

ঝাউবোনা গ্রামের রেশমগুটি ক্রেতা ও সূতা উৎপাদনকারী ব্যবসায়ী মোঃ জামাল উদ্দিন জানান, বর্তমান ভোলাহাটে যে ৩৭০ জন বসনী রয়েছেন, তারা রেশম বীজাগার থেকে বীজ নিচ্ছেন ঠিকই কিন্তু সবাই পলুপালন করছেন না; বাড়ি নিয়ে বীজগুলো নষ্ট করে ফেলছেন। কারণ সকলের নিকট থেকে গুটি পাওয়া যাচ্ছে না। রেশম সূতা তৈরির জন্য রিলিং মেসিন বা কাট-ঘাই চালু করতে গেলে একজন ব্যবসায়ীর অন্তত ১০০ মণ গুটির প্রয়োজন। তাহলে কোন রকমে টিকে থাকা যাবে। তিনি আরও জানান, গুটির মূল্যও কম। তিনি দাবী করেন, যদি রেশম উন্নয়ন বোর্ড গুটির মূল্য ৩০ হাজার টাকা মণ ধার্য করে এবং তা ক্রয় করে তাহলে বসনীমহল বেঁচে থাকতে পারবে! রেশম ব্যবসায়ী জামাল উদ্দিন আরো জানান, রেশম সূতা ও রেশমী পণ্যের বাজার না থাকায় দেশীয় রেশম শিল্প মার খাচ্ছে। এ জন্য ভারত, চীন, কোরিয়া, ভিয়েতনাম, তাজাকিস্তান থেকে রেশম সূতা ও রেশমজাত পণ্য-দ্রব্যের আমদানি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। দেশি রেশমজাত পণ্যের বাজার না থাকায় ব্যবসায় লস হওয়ার কারণে ভোলাহাটের সাড়ে ৪ শ’ জন রেশম সূতা ব্যবসায়ীর সূতা তৈরির কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। বর্তমানে ১টি কারখানা চালু রাখার মত গুটি উৎপাদিত হচ্ছে না। উন্নয়নের নামে এমন শুভঙ্করের ফাঁকি চলতে থাকলে রেশমের অবস্থা লাটে উঠে যাবে, এমনটাই আশঙ্কা করছেন বসনীমহল ও রেশম ব্যবসায়ীরা!

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রেশম শিল্পকে বাঁচাতে হলে, প্রথমতঃ দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে। দ্বিতীয়তঃ যারা পলুপালনের চুক্তিতে অনুদান ভোগ করার পর পলুপালন বন্ধ করেছেন তাদের কাছ থেকে টাকা ফেরতের জন্য আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে। তৃতীয়তঃ প্রকৃত রেশমচাষীদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রণোদনা নিশ্চিত করতে হবে। চতুর্থতঃ দুর্নীতির উচ্চ পর্যায়ের নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু তদন্ত করতে হবে। পঞ্চমতঃ রেশমগুটির মূল্য যুগোপযোগী নির্ধারণ করতে হবে। ষষ্ঠতঃ উচ্চ জাতের পলুপোকার ডিম বা বীজ সরবরাহ করতে হবে। সপ্তমতঃ দেশী রেশমজাত পণ্যের বাজার সৃষ্টির লক্ষ্যে দেশে আমদানীকৃত বিদেশী রেশমজাত পণ্যের অবাধ আমদানী নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। তবেই রেশমচাষী, রেশমসূতা উৎপাদনকারী, রেশমীবস্ত্র তৈরিকারক তাঁতী ও ব্যবসায়ীরা অনেকাংশে বেঁচে থাকার মত আশার আলো দেখতে পাবে। এ ব্যাপারে দেশের ক্ষয়িষ্ণু কৃষিজ শিল্পকে বাঁচাতে বাংলাদেশ রেশম উন্নয়ন বোর্ড এবং বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়কে মনোযোগী হওয়া উচিত!

ভোলাহাটে রেশমের সার্বিক পরিস্থিতি জানার জন্য ৬টি জেলায় কর্মরত সহকারী পরিচালক মোঃ তরিকুল ইসলামের নিকট ধর্না দিয়ে কোন তথ্য পাওয়া যায়নি। গড়িমসি ও তালবাহানা করছেন! তিনি ভোলাহাট জোনাল অফিসে অফিস করেন না। তিনি থাকেন বাংলাদেশ রেশম উন্নয়ন বোর্ড, রাজশাহীর প্রধান কার্যালয়ে। কতক সময়ে তিনি ছুটির দিনে গোপনে ভোলাহাটে আসেন আর কার্যাদী সেরে চুপিসারে কর্মস্থল ত্যাগ করেন। তাঁর মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও সন্তোষজনক জবাব পাওয়া যায়নি!

ট্যাগস
আপলোডকারীর তথ্য

জনপ্রিয় সংবাদ

ভোলাহাট রেশম উন্নয়ন বোর্ডের জোনাল অফিস দুর্নীতির আখড়া

SBN

SBN

সরকারের কোটি কোটি টাকা গচ্চা

ভোলাহাট রেশম উন্নয়ন বোর্ডের জোনাল অফিস দুর্নীতির আখড়া

আপডেট সময় ০৭:৪২:০৮ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৯ নভেম্বর ২০২৫

মোঃ সোহেল আমান ,রাজশাহী ব্যুরো

চাঁপাইনবাবগঞ্জে রেশম উন্নয়ন বোর্ডের ভোলাহাট জোনাল অফিস যেন দুর্নীতির আখড়া! ক্ষয়িষ্ণু রেশম চাষকে পুনরুজ্জীবিত করার লক্ষ্যে সরকার বেশকিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও অনিয়ম, স্বজনপ্রীতি আর দুর্নীতির কবলে উদ্দিষ্ট লক্ষ্য ভেস্তে গেছে। সরকারী অনুদানে রেশম চাষীদের পলুঘর নির্মাণ, তুঁতচারা রোপণ, প্রশিক্ষণ প্রদান ও অন্যান্য উপকরণ বিতরণে অনিয়ম, ফাঁকিবাজী আর ভাগ-বাটোয়ারার কারণে শুধুই অর্থ অপচয় হয়েছে সরকারের, উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি। এছাড়া রেশমগুটি, রেশমসূতা ও রেশমজাত পণ্যের বাজার না থাকায় “রেশমচাষ” কথিত উন্নয়নের চোরাবালীতে নিশ্চিহ্ন হবার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছে এমন অভিযোগ করেছেন প্রকৃত রেশমচাষীরা।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, রেশম চাষের উন্নয়ন ও এর কৃষিজাত শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে সরকার রেশম চাষী “বসনীদের” একেকজনকে এক বিঘা জমিতে তুঁত চারা (তুঁত মূড়া) রোপণের জন্য ২৫ হাজার টাকা, পলু ঘর নির্মাণের জন্য ১ লাখ টাকা এবং ৬০ হাজার টাকা মূল্যের পলু পালনের উপকরণ (ডালা, চন্দ্রকী, ঘরাশুলা) ও ৩২টি নেট অনুদান প্রদান করার জন্য প্রকল্প গ্রহণ করে। এছাড়া প্রত্যেক বসনীকে ২৬ দিনের প্রশিক্ষণ বাবদ ১৩ হাজার টাকা ভাতা প্রদান করা হয়। এর সাথে পলুপোকার ডিম বিনামূল্যে বিতরণ করা হয় তাদের মাঝে। সবকিছুই সরকারী ভাবে দেয়া হয়, শুধু শ্রম দেয় রেশমচাষী বা বসনীরা।

উপজেলার সদর ইউনিয়নের ধরমপুর গ্রামের বসনী তোফাজ্জল হোসেন জানান, যাদের নিজস্ব জমি নেই তারা অপরের ১ বিঘা জমি অন্তত ১০ বছরের জন্য লীজ গ্রহণ করলে তুঁত মূড়া রোপণ বাবদ ২৫ হাজার টাকা ও পলুঘর নির্মাণ বাবদ ১ লাখ টাকা ১ জন বসনী অনুদান পাবেন। এছাড়া প্রায় ৬০ হাজার টাকা মূল্যের ডালা, চন্দ্রকী, ঘরাশুলা ও ৩২টি নেট পাবেন; আর প্রশিক্ষণ বাবদ পাবেন ২৬ দিনে ১৩ হাজার টাকা। কিন্তু ৩শ’ টাকার নন-জুডিশিয়্যাল ষ্ট্যাম্পে তুঁত মূড়া রোপণের জন্য ১ বিঘা জমির ভূয়া ডিড তৈরি করে যোগসাজশী ভাবে জমি তৈরীর জন্য ২৫ হাজার টাকা ও পলুঘর নির্মাণের জন্য ১ লাখ টাকা সরকারী কোষাগার থেকে উঠিয়ে ভাগ-বাটোয়ারা করে নেয়া হয়। আর নির্মাণকৃত ঘর অপরিকল্পিত ভাবে দুর্বল করে তৈরি করা হয়।
এমনকি ধরমপুর গ্রামের আসিরুদ্দিনের ছেলে সাইদকে পুরাতন পলুঘর দেখিয়েই ১ লাখ টাকা বরাদ্দ করে ভাগ-বাটোয়ারা করে নেয়া হয়। ইমামনগর গ্রামের বাসেদ আলী জানান, তাঁকে ঘর নির্মাণ বাবদ ৭০ হাজার টাকা দিয়ে ৩০ হাজার টাকা অফিসের লোকেরা নিয়ে নেন। বর্তমানে তিনি জমি থেকে তুঁতমূড়া মেরে দিয়েছেন। একই গ্রামের সাজেদ আলী পলু পালন করেন না। অথচ ভোলাহাট জোনাল অফিসের অস্থায়ী কর্মচারী মনিরুল ইসলাম এ ব্যক্তিকে (মনিরুলের শ্বশুড়কে) পলুঘর নির্মাণ বাবদ অনুদানসহ প্রয়োজনীয় সুবিধা প্রদান করেছেন। পলু পালন করেন না এমন ব্যক্তিকে অনুদান দেয়ার অভিযোগ অনেক । পলুঘর নির্মাণের টাকা মোবাইল নম্বরে ৪ কিস্তিতে বিতরণ করা হয়। পলুঘর নির্মাণ বাবদ ৭০ হাজার টাকা বসনীকে দিয়ে ৩০ হাজার টাকা এডি, রেশম বোর্ডের সদস্য সমিরুদ্দিন, অস্থায়ী কর্মচারী মনিরুল ইসলাম ও বসনী সমিতির সেক্রেটারী মোঃ সেকামউদ্দিন গং ভাগ-বাটোয়ারা করে নেন। সমস্ত কিছু অনুদান ও প্রশিক্ষণ পাওয়া হয়ে গেলে রেশমচাষ বন্ধ করে দিচ্ছে সুবিধাভোগীরা। চরধরমপুর গ্রামের ইমাম হোসেন মাষ্টারের চার ছেলে সাইফুল্লাহ্, সফিউল্লাহ, আমানুল্লাহ ও ওলিউল্লাহ ৪টি ঘরসহ সকল সুবিধাদি নিয়ে জমি থেকে তুঁতমূড়া উপড়ে ফেলে পলুপালন বন্ধ করে দিয়েছে। বর্তমানে ২৭০ জন বসনী এ অনুদান প্রকল্পের আওতায় সুবিধা ভোগ করছেন। এর আগে ১২ হাজার বসনী (রেশমচাষী) ভোলাহাট উপজেলায় রেশম চাষ করতো। বছরে ৫ বার (৫টি বন্দ্) রেশমগুটি বা পলুপালন করা হতো।

পলুপোকার খাদ্য তুঁতপাতা। নিয়মানুযায়ী ১ বিঘা জমিতে তুঁতচারা রোপণের জন্য ২৫ হাজার টাকা অনুদান পাবেন বসনীরা। কিন্তু তিন কাঠা, পাঁচ কাঠা বা সাত/দশ কাঠা জমিকে কাগজে এক বিঘা দেখিয়ে ২৫ হাজার টাকা অনুদান আত্মসাৎ করা হয়। আর ১ বিঘা তুঁত জমি ও ১ খোপ (১ ঘরা=১৬ ডালা) পলু পালনের বিপরীতে ১টি পলুঘর নির্মাণের জন্য একজন বসনী ১ লাখ টাকা ও অন্যান্য উপকরণ পাবার যোগ্য। সব রকমের অনুদান পাওয়া হয়ে গেলে পলুপোকার ডিম (বীজ) রেশম বীজাগার হতে গ্রহণ করার পর বাড়ীতে নিয়ে এসে পলুপালন (রেশমচাষ) না করে বীজগুলো ফেলে দেয় সুবিধাভোগীরা। এমনকি অনুদানের টাকায় পলুঘর নির্মাণ না করে এটাচ্ বাথরুমসহ শয়নকক্ষ ও গোয়ালঘর নির্মাণ করেছে কতক বসনী! যা সরেজমিনে গোহালবাড়ী গ্রামের ফারহানা খাতুনের পলুঘর কোড-২৪৬ তে প্রত্যক্ষ করা গেছে।

প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী রেশম শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে সরকার কোটি কোটি টাকা অনুদান বিতরণ করছেন কিন্তু রেশম বোর্ড ভোলাহাট জোন এডি তরিকুল ইসলাম, বাংলাদেশ রেশম উন্নয়ন বোর্ডের সদস্য (বসনী প্রতিনিধি) মোঃ সমিরুদ্দিন, অস্থায়ী কর্মচারী মনিরুল ইসরাম ও রেশম বসনী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোঃ সেকামউদ্দিন গং সিন্ডিকেট বিভিন্ন কৌশলে সরকারী অনুদান আত্মসাৎ করছেন। ফলে রেশমের উন্নয়ন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এসে ঠেকেছে। ধরমপুর গ্রামে ১৪ জন বসনী ছিল, এখন মাত্র ৪ জন বসনী টিকে আছে। গোহালবাড়ী গ্রামেও ১৪ জন বসনী ছিল, এখন টিকে আছেন ২ জন। তারাও রেশম চাষ বন্ধ করে দিবেন বলে জানা গেছে। অথচ সকলেই অনুদান ভোগ করেছেন। পলুপালন না করে অনেক বসনী তুঁত জমিতে মিষ্টি কুমড়ার চাষ করছেন। স্বয়ং রেশম উন্নয়ন বোর্ডের সদস্য (বসনী প্রতিনিধি) সমিরুদ্দিন তুঁত জমিতে মিষ্টি কুমড়ার চাষ করছে বলে প্রত্যক্ষ করা গেছে।

প্রত্যেক বসনীকে প্রশিক্ষণ দেয়ার কথা থাকলেও সবাইকে প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে না! অনেককে বারংবার প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে অর্ধেক প্রশিক্ষণ ভাতার বিনিময়ে। প্রশিক্ষণ শুরুর আগেই ঐ অর্ধেক টাকা হাতিয়ে নেন কর্তারা। পলুপালনের সাথে জড়িত নন এমন নারী-পুরুষকেও দুর্নীতির আশ্রয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে! অথচ প্রশিক্ষণ না পাবার অভিমানে ধরমপুর গ্রামের আব্দুল আউয়াল পলুপালন বন্ধ করে দিয়েছেন। প্রশিক্ষণ পাননি এমন অভিযোগ অনেক।

বসনীদের অভিযোগ, বীজাণুমুক্ত ও উন্নত জাতের পলুপোকার ডিম সরবরাহ করা হচ্ছে না। প্রায়শই পলুপোকা গুলো নষ্ট হয় এবং বসনীরা ক্ষতিগ্রস্ত হন। এর পেছনেও কর্তাদের অসৎ উদ্দেশ্য আছে বলে বসনীদের দাবী। আর চীন ও ভারতে যখন উন্নত জাতের “পলু” (রেশম পোকা বা রেশম মথ) পালন করা হচ্ছে, সেখানে আমাদের দেশে পুরনো জাতের “পলু”র চাষ রয়ে গেছে। বাংলাদেশ রেশম উন্নয়ন বোর্ডের গবেষণাগার থাকলেও কার্যতঃ কোন সুফল পাচ্ছেন না বসনীরা। ফলে রেশমগুটির মান ও ফলন খুবই কম।

ঝাউবোনা গ্রামের রেশমগুটি ক্রেতা ও সূতা উৎপাদনকারী ব্যবসায়ী মোঃ জামাল উদ্দিন জানান, বর্তমান ভোলাহাটে যে ৩৭০ জন বসনী রয়েছেন, তারা রেশম বীজাগার থেকে বীজ নিচ্ছেন ঠিকই কিন্তু সবাই পলুপালন করছেন না; বাড়ি নিয়ে বীজগুলো নষ্ট করে ফেলছেন। কারণ সকলের নিকট থেকে গুটি পাওয়া যাচ্ছে না। রেশম সূতা তৈরির জন্য রিলিং মেসিন বা কাট-ঘাই চালু করতে গেলে একজন ব্যবসায়ীর অন্তত ১০০ মণ গুটির প্রয়োজন। তাহলে কোন রকমে টিকে থাকা যাবে। তিনি আরও জানান, গুটির মূল্যও কম। তিনি দাবী করেন, যদি রেশম উন্নয়ন বোর্ড গুটির মূল্য ৩০ হাজার টাকা মণ ধার্য করে এবং তা ক্রয় করে তাহলে বসনীমহল বেঁচে থাকতে পারবে! রেশম ব্যবসায়ী জামাল উদ্দিন আরো জানান, রেশম সূতা ও রেশমী পণ্যের বাজার না থাকায় দেশীয় রেশম শিল্প মার খাচ্ছে। এ জন্য ভারত, চীন, কোরিয়া, ভিয়েতনাম, তাজাকিস্তান থেকে রেশম সূতা ও রেশমজাত পণ্য-দ্রব্যের আমদানি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। দেশি রেশমজাত পণ্যের বাজার না থাকায় ব্যবসায় লস হওয়ার কারণে ভোলাহাটের সাড়ে ৪ শ’ জন রেশম সূতা ব্যবসায়ীর সূতা তৈরির কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। বর্তমানে ১টি কারখানা চালু রাখার মত গুটি উৎপাদিত হচ্ছে না। উন্নয়নের নামে এমন শুভঙ্করের ফাঁকি চলতে থাকলে রেশমের অবস্থা লাটে উঠে যাবে, এমনটাই আশঙ্কা করছেন বসনীমহল ও রেশম ব্যবসায়ীরা!

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রেশম শিল্পকে বাঁচাতে হলে, প্রথমতঃ দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে। দ্বিতীয়তঃ যারা পলুপালনের চুক্তিতে অনুদান ভোগ করার পর পলুপালন বন্ধ করেছেন তাদের কাছ থেকে টাকা ফেরতের জন্য আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে। তৃতীয়তঃ প্রকৃত রেশমচাষীদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রণোদনা নিশ্চিত করতে হবে। চতুর্থতঃ দুর্নীতির উচ্চ পর্যায়ের নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু তদন্ত করতে হবে। পঞ্চমতঃ রেশমগুটির মূল্য যুগোপযোগী নির্ধারণ করতে হবে। ষষ্ঠতঃ উচ্চ জাতের পলুপোকার ডিম বা বীজ সরবরাহ করতে হবে। সপ্তমতঃ দেশী রেশমজাত পণ্যের বাজার সৃষ্টির লক্ষ্যে দেশে আমদানীকৃত বিদেশী রেশমজাত পণ্যের অবাধ আমদানী নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। তবেই রেশমচাষী, রেশমসূতা উৎপাদনকারী, রেশমীবস্ত্র তৈরিকারক তাঁতী ও ব্যবসায়ীরা অনেকাংশে বেঁচে থাকার মত আশার আলো দেখতে পাবে। এ ব্যাপারে দেশের ক্ষয়িষ্ণু কৃষিজ শিল্পকে বাঁচাতে বাংলাদেশ রেশম উন্নয়ন বোর্ড এবং বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়কে মনোযোগী হওয়া উচিত!

ভোলাহাটে রেশমের সার্বিক পরিস্থিতি জানার জন্য ৬টি জেলায় কর্মরত সহকারী পরিচালক মোঃ তরিকুল ইসলামের নিকট ধর্না দিয়ে কোন তথ্য পাওয়া যায়নি। গড়িমসি ও তালবাহানা করছেন! তিনি ভোলাহাট জোনাল অফিসে অফিস করেন না। তিনি থাকেন বাংলাদেশ রেশম উন্নয়ন বোর্ড, রাজশাহীর প্রধান কার্যালয়ে। কতক সময়ে তিনি ছুটির দিনে গোপনে ভোলাহাটে আসেন আর কার্যাদী সেরে চুপিসারে কর্মস্থল ত্যাগ করেন। তাঁর মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও সন্তোষজনক জবাব পাওয়া যায়নি!