মাসজিদে ইতিকাফ আভিধানিক অর্থে পৃথক স্হানে অবস্থান করা বা দৃঢ়ভাবে আটকে থাকা অথবা আবদ্ধ করে রাখা। এমতাবস্থায় শারীরিক মিলনের উদ্দেশ্য নারীদের নিকট গমনাগমন আল্লাহ নিষেধ করেছেন। প্রচলিত অর্থে ইতিকাফ সামাজিক ইবাদতের অংশ হিসেবে পরিগণিত করা হয়। আল্লাহর নৈকট্য অর্জন এবং বিশেষ করে লাইলাতুল কদরের রাত অন্বেষণের উদ্দেশ্যে পরিবার পরিজন থেকে পৃথক অবস্থায় কয়েকটি দিন মসজিদে ইতিকাফ বা অবস্থান ধর্মীয় রীতিনীতির অংশ এবং হাদীস গ্রন্থ দ্বারা স্বীকৃত। বিভিন্ন মাজহাবে এই ধরনের ইবাদতকে ওয়াজিব, সুন্নাহ বা সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
ইতিকাফ পালন পদ্ধতিঃ
সাধারণত সমাজের পক্ষ থেকে গুটি কয়েক মুসল্লি রমজানের শেষ দশদিন পরিবার পরিজন থেকে পৃথক হয়ে মসজিদে ইতিকাফে বসেন এবং কায়মনচিত্তে আল্লাহর স্মরণ, তাসবিহ তাহলীল ও নামাজ রোজায় মনোনিবেশ করেন। এই বিশেষ ইবাদতের সওয়াবের অংশীদার সমাজের অন্যসব মুসল্লিগণ ভোগ করে থাকেন। যদিও কোন ব্যাক্তির অর্জিত সওয়াবের ভাগাভাগি আল-কোরআন দ্বারা স্বীকৃত নয়। ইবাদতের এই পদ্ধতি বিভিন্ন হাদিস গ্রন্থ থেকে জানা যায়। মাজহাব ভিত্তিক প্রণীত বিভিন্ন রীতি নীতি অনুযায়ী মুসুল্লিগণ ইতিকাফ পালন করে থাকেন।
ইতিকাফ সম্পর্কে কুরআনের দুটি আয়াতে উল্লেখ রয়েছে, যদিও আয়াত দুটির প্রেক্ষাপট ভিন্ন।
সুরা বাকারার ১২৫ নং আয়াতে বলা হয়েছে-
“এবং যখন আমি কা‘বা গৃহকে মানব জাতির জন্য সুরক্ষিত স্থান ও পুণ্যধাম করেছিলাম, এবং মাকামে ইবরাহীমকে সালাতের জায়গা নির্ধারণ করেছিলাম; এবং আমি ইবরাহীম ও ইসমাঈলের নিকট অঙ্গীকার নিয়েছিলাম যে, তোমরা আমার গৃহকে তাওয়াফকারী ও ই’তিকাফকারী (staying) এবং রুকু ও সাজদাহকারীদের জন্য পবিত্র রেখ”।
এখানে কাবা নির্মাণ কারী হযরত ইব্রাহীম (আঃ) ও তার পুত্র ইসমাইল আল্লাহর নিকট অঙ্গীকার করেছিলেন যে, কাবা গৃহ মানবজাতির জন্য সুরক্ষিত ও ইবাদতের জন্য পবিত্র রাখা হবে। এই গৃহ কেবলমাত্র এক আল্লাহর বিধান জারি থাকবে এবং এটি হবে বিশ্ববাসীর জন্য ইসলামের কেন্দ্রস্হল। সেখানে বহু দূরদূরান্ত থেকে লোকজন সেই পবিত্র ঘরকে তাওয়াফ করতে আসবে, আল্লাহর স্মরণে কিছু সময় অবস্থান করবে, রুকু কারী বা আনুগত্যকারীদের সাথে আনুগত্যশীল থাকবে এবং সর্বোপরি এক আল্লাহর প্রতি সাজদাবনত হওয়া এই আয়াতের মুল বক্তব্য। এখানে ইতিকাফ দ্বারা কাবাঘরে অবস্থান করা বা দৃঢ়ভাবে আল্লাহর ঘরের সাথে নিজের মন ও আত্মার সম্পর্ক স্থাপন করাকে বুঝানো হয়েছে।
সুরা বাকারার ১৮৭ নং আয়াতে ইতিকাফ সম্পর্কে বলা হয়েছে-
“রামাযানের রাতে আপন স্ত্রীদের সাথে মেলামেশা করা তোমাদের জন্য বৈধ করা হয়েছে, তারা তোমাদের জন্য এবং তোমরা তাদের জন্য আবরণ, তোমরা যে নিজেদের ক্ষতি করছিলে আল্লাহ তা জ্ঞাত আছেন, এ জন্য তিনি তোমাদের প্রতি প্রত্যাবৃত্ত হলেন এবং তোমাদের লাঘব করে দিলেন; অতএব এক্ষণে তোমরা তাদের সাথে মিলিত হও এবং আল্লাহ তোমাদের জন্য যা লিপিবদ্ধ করেছেন তা অনুসন্ধান কর এবং প্রত্যুষে কালো সূতা হতে সাদা সূতা প্রকাশিত না হওয়া পর্যন্ত তোমরা আহার ও পান কর, অতঃপর রাত সমাগম পর্যন্ত তোমরা সিয়াম পূর্ণ কর; তোমরা মাসজিদে ই‘তিকাফ করার সময় মিলিত হবেনা; এটিই আল্লাহর সীমা। অতএব তোমরা উহার নিকটেও যাবেনা; এভাবে আল্লাহ মানবমন্ডলীর জন্য তাঁর নিদর্শনসমূহ বিবৃত করেন, যেন তারা সংযত হয়”
মাসজিদে ইতিকাফ সম্পর্কে কুরআনের বক্তব্যঃ
আল্লাহ এই সম্পর্কে আমাদের কি বলেছেন আসুন জেনে নেই। ইতিমধ্যে ইতিকাফ সম্পর্কে প্রচলিত ব্যাখ্যা তুলে ধরা হয়েছে কিন্তু একটি বিষয় লক্ষণীয় মসজিদে অবস্থানকালীন সময়ে স্বামী স্ত্রীর শারীরিক মিলন কিভাবে সম্ভব হতে পারে বা সম্পর্ক স্থাপনের সুযোগ কোথায়? কেন আল্লাহর পক্ষ থেকে এই প্রসঙ্গ উত্থাপন করা হয়েছে? আয়াতের পূর্বাপর বক্তব্য অনুযায়ী এখানে মসজিদে ইতিকাফ মানে ইবাদাতের উদ্দেশ্য মসজিদে অবস্থান গ্রহণ করাকে বুঝানো হয়নি, এর মুল প্রেক্ষাপট হচ্ছে প্রাকৃতিক নিয়মানুযায়ী একজন ঋতুবর্তী নারী ঋতু চলাকালীন সময়ে নির্দিষ্ট কয়েকটি দিন স্বামী থেকে শারীরিক দুরত্ব বজায় রাখেন। এমতাবস্থায় যৌন মিলন নিষিদ্ধ। এই নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে কেহ কেহ শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করেন। সেজন্য আল্লাহ প্রত্যাবৃত্ত হলেন এবং ঘোষণা দিয়েছেন যে, “তোমরা মাসজিদে ই‘তিকাফ করার সময় মিলিত হবেনা; এটিই আল্লাহর সীমা”। এখানে “মসজিদে ইতিকাফ” মানে ঋতু চলাকালীন সময়ে শারীরিক সম্পর্ক থেকে বিরত থাকা বা দুরত্ব বজায় রেখে পরস্পর অবস্থান করা। ইহাই স্বামী স্ত্রীর ইতিকাফ, এখানে মসজিদ গৃহ অর্থে প্রয়োগ হয়েছে। এইরূপ গর্হিত কাজ থেকে সংযত থাকার জন্য প্রয়োজন সংযম। আর সিয়াম সংযম শিক্ষা দেয়। উল্লেখযোগ্য যে, ইতিকাফ দ্বারা প্রচলিত ইবাদতকে বুঝানো হলে এর প্রেক্ষাপট, পালনীয় বিধান বা অনুসরণীয় পদ্ধতি আল-কোরআনে বর্ণিত হত। অতএব স্ত্রীর মাসিক বা পিরিয়ড চলাকালীন সময়ে উভয়ই শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনে বিরত থাকবে এবং পরস্পর দুরত্ব বজায় রেখে অবস্থান করবেন, এটি আল্লাহর বেঁধে দেয়া সীমারেখা।
(বিঃদ্রঃ শুধুমাত্র আল কোরআন এর আলোকে ব্যাখ্যা প্রদান করা হয়েছে। বিভিন্ন হাদিস গ্রন্থ দ্বারা প্রতিষ্ঠিত বিধিবিধান উপেক্ষা করা হয়েছে। হাদিস গ্রন্থের অনুসরণ যে কোন ব্যাক্তির ইচ্ছা অনিচ্ছার উপর নির্ভরশীল)
লেখক:
মো: ওবায়েদ উল্লাহ।
সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
সহকারী ফিচার সম্পাদক
দৈনিক মুক্তির লড়াই।