
১৯৭১ সালের ৮ ডিসেম্বর ছিল স্বাধীনতাকামী বাঙালির জন্য এক অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ দিন। চূড়ান্ত বিজয় ১৬ ডিসেম্বরের মাত্র আট দিন আগে, এই দিনে কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ দেশের বেশ কয়েকটি কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ এলাকা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দখলমুক্ত হয়। দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম, লক্ষ প্রাণের আত্মত্যাগ এবং সুদূরপ্রসারী রাজনৈতিক-কূটনৈতিক প্রস্তুতির ফসল ছিল এই মুক্তি।
রক্তে রাঙানো মুক্তি ও কৌশলগত বিজয়
মুক্তিবাহিনী এবং মিত্রবাহিনীর সুসংগঠিত, যৌথ আক্রমণ এবং গেরিলা কৌশল সফল হওয়ায় হানাদাররা পিছু হটতে বাধ্য হয়। একাত্তরের এই দিনে মুক্তির আনন্দ ছিল বাঁধভাঙা, তবে সেই আনন্দ ছিল অসংখ্য শহীদের আত্মত্যাগের স্মরণে বিষাদে মোড়া।
কুমিল্লা (মুক্তির রুট): কৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই জেলাটি ছিল ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইওয়ের প্রবেশপথ। লেফটেন্যান্ট কর্নেল শাফায়াত জামিলের নেতৃত্বাধীন বাহিনীর তীব্র আক্রমণের মুখে কুমিল্লা সেনানিবাস থেকে পাকিস্তানিরা পালাতে শুরু করে। এর ফলে পূর্বাঞ্চলীয় রণাঙ্গনে ঢাকা পৌঁছানোর পথ আরও মসৃণ হয় এবং বাংলাদেশের ভূখণ্ডে একটি শক্তিশালী সরবরাহ রুট তৈরি হয়।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া (সামরিক ঘাঁটি দখল): পাকিস্তানি বাহিনীর শক্তিশালী সামরিক ঘাঁটি ব্রাহ্মণবাড়িয়া মুক্ত হওয়ায় মুক্তিসেনারা আরও দ্রুত ঢাকা অভিমুখে অগ্রসর হওয়ার সুযোগ পান। ৫ ডিসেম্বরের পর থেকেই হানাদাররা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিভিন্ন স্থান থেকে পশ্চাদপসরণ শুরু করে এবং ৮ ডিসেম্বরের ভোরে সম্পূর্ণভাবে শহর ছেড়ে চলে যায়।
ফেনী ও অভয়নগর: সীমান্তবর্তী জেলা ফেনী মুক্ত হওয়ায় ভারত থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের রসদ সরবরাহ ও যোগাযোগ ব্যবস্থা অনেক সহজ হয়ে যায়। অভয়নগর (যশোর) মুক্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে খুলনা অঞ্চলে যুদ্ধের গতি বাড়ে।
প্রবাসী সরকারের নেতৃত্ব, রণপরিকল্পনা ও নির্দেশনা
মুক্তযুদ্ধের এই অগ্রগতির পেছনে ছিল মুজিবনগরভিত্তিক গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার (প্রবাসী সরকার)-এর দূরদর্শী নেতৃত্ব এবং সুনির্দিষ্ট রণপরিকল্পনা।
সামরিক সমন্বয় ও যৌথ কমান্ড গঠন: ৩ ডিসেম্বর ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধে যোগ দেওয়ার পর, প্রবাসী সরকারের উদ্যোগে গঠিত বাংলাদেশ-ভারত যৌথ কমান্ডের অধীনে সুসংগঠিতভাবে যুদ্ধ পরিচালনা শুরু হয়। সরকার কর্তৃক নির্দেশিত এই যৌথ কমান্ড ৮ ডিসেম্বরের এই দ্রুত মুক্তাঞ্চল ঘোষণার জন্য দায়ী।
সেক্টরভিত্তিক অভিযান: সরকার প্রধানের (প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ) নির্দেশে গঠিত ১১টি সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা স্থানীয় জনগণের সহায়তায় গেরিলা যুদ্ধকে পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধে রূপ দিতে সক্ষম হন। এই সেক্টরগুলোর সমন্বিত চাপেই হানাদাররা বিভিন্ন এলাকা থেকে পিছু হটতে শুরু করে।
অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক কাঠামো রক্ষা: প্রবাসী সরকার যুদ্ধকালীন সময়ে মুক্ত এলাকাগুলোতে দ্রুত প্রশাসনিক কাঠামো এবং ত্রাণ কার্যক্রম চালু করার প্রস্তুতি নিয়েছিল, যা ৮ ডিসেম্বরের মুক্তাঞ্চলগুলোতে প্রয়োগ করা হয়।
আন্তর্জাতিক সমর্থন: বিশ্ব পরিসরে চাপ সৃষ্টি
মুক্তিবাহিনীর সফলতার পাশাপাশি প্রবাসী সরকারের কূটনৈতিক প্রচেষ্টা এবং কয়েকটি বন্ধু রাষ্ট্রের অকুণ্ঠ সমর্থন এই বিজয়কে ত্বরান্বিত করে।
ভারতের স্বীকৃতি ও সহযোগিতা: ভারত সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধ শুরু করার পর বাংলাদেশের প্রতি তাদের সমর্থন আরও জোরালো হয়। ভারত আন্তর্জাতিক চাপ মোকাবিলা করে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ, অস্ত্র সরবরাহ এবং সামরিক কৌশলগত সহায়তা প্রদান করে।
সোভিয়েত ইউনিয়নের কৌশলগত সমর্থন: জাতিসংঘে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভেটো ক্ষমতা এবং বাংলাদেশের পক্ষে জোরালো সমর্থন আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। ৮ ডিসেম্বরের কাছাকাছি সময়ে তারা জাতিসংঘের যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব বারবার ভেটো দিয়ে বাতিল করে দেয়, যা মিত্রবাহিনীকে দ্রুত বিজয় অর্জনের সুযোগ করে দেয়।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম: বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সংবাদমাধ্যম ও বুদ্ধিজীবীরা বাংলাদেশে চলমান গণহত্যার বিরুদ্ধে সোচ্চার হন এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে জনমত তৈরি করেন।
মুক্তির প্রাক্কালে হানাদার বাহিনীর বর্বরতা ও ‘ফ্ল্যাশপয়েন্ট’ অপারেশন
পরাজয় নিশ্চিত জেনে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা চরম হতাশা থেকে বর্বরতা আরও বাড়িয়ে দেয়। ডিসেম্বরের এই দিনগুলোতে তারা দ্রুত দুটি ঘৃণ্য পরিকল্পনা কার্যকর করে:
ট্যাকটিক্যাল রিট্রিট ও ‘পুড়ে যাওয়া মাটি’ কৌশল: মুক্ত হতে যাওয়া এলাকাগুলোতে হানাদাররা পিছু হটার আগে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা, ব্রিজ, কালভার্ট ও খাদ্য গুদাম ধ্বংস করে দেয়। এটি ছিল সামরিক ভাষায় ‘Scorched Earth Policy’ বা ‘পুড়ে যাওয়া মাটি’ নীতি—যাতে মুক্তিবাহিনীর হাতে কোনো সম্পদ অক্ষত না থাকে।
বুদ্ধিজীবী হত্যার নীলনকশা: বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে তারা জাতিকে মেধাশূন্য করার ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র শুরু করে। ৮ ডিসেম্বরের এই সফলতার পর জেনারেল রাও ফরমান আলীর নির্দেশনায় আল-বদর ও আল-শামস বাহিনী বুদ্ধিজীবী হত্যার তালিকা চূড়ান্ত করার কাজ শুরু করে।
নির্যাতন ও গণহত্যা: মুক্ত হতে যাওয়া জনপদগুলোতে শেষ আঘাত হিসেবে ব্যাপক গণহত্যা, নারী নির্যাতন ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে।
৮ ডিসেম্বর তাই কেবল বিজয়ের উল্লাস নয়, এটি স্বাধীনতা অর্জনের জন্য রাজনৈতিক দূরদর্শিতা, সামরিক দক্ষতা, আন্তর্জাতিক বন্ধুত্ব, এবং বর্বরতার বিরুদ্ধে লক্ষ আত্মত্যাগের এক সামগ্রিক প্রতিচ্ছবি। এই দিনটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে স্বাধীনতা কোনো সহজলভ্য বস্তু ছিল না; এটি অর্জিত হয়েছে বহু রক্ত, অশ্রু আর ত্যাগের বিনিময়ে।
লেখক : মোহাম্মদ আলী সুমন, সাংবাদিক ও সংগঠক।
মুক্তির লড়াই ডেস্ক : 

























