মহান রব প্রদত্ত সর্বশ্রেষ্ঠ মাস রমাদান। এটি আরবি বারো মাসের মধ্যে নবম মাস। এ মাস আল্লাহ তা’আলা কর্তৃক তাঁর বান্দাদের জন্য এক বিশেষ নিয়ামত। সাওয়াব অর্জনের মাধ্যমে মহান মনীবকে সন্তুষ্ট করার সর্বোৎকৃষ্ট সময়। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন: “লাইলাতুল কদর হাজার মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ”(সূরা ক্বদর: ৩)। আর এটি এ রমাদান মাসেই বিদ্যমান। হাদীসে কুদসীতে আল্লাহ তা’আলা বলেন: হযরত আবু হুরাইরা -রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু- হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল -সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম- ইরশাদ করেন: ‘বনী আদমের প্রতিটি নেক আমল দশ হতে সাতশ গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়, আল্লাহ তা’আলা বলেন তবে সাওম ব্যতীত। কেননা ইহা শুধু আমার জন্য আর আমিই এর প্রতিদান দেবো’(সহিহুল বুখারি:১৮৯৪,১৯০৪, ৫৯২৭৭৪৯২, ৭৫৩৮, সহিহ মুসলিম: ১১৫১, তিরমিযী: ৭৬৪,নাসায়ি: ২২১৫, আহমাদ: ৭৪৪২)। হযরত আবু হুরাইরা -রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু- হতে বর্ণিত, রাসূল -সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম- ইরশাদ করেন: ‘যখন রমাদান মাস উপস্থিত হয় তখন জান্নাতের দ্বারসমূহ খুলে দেওয়া হয়, জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং শয়তানদের বন্ধী করা হয়’ (সহিহুল বুখারি: ১৮৯৯,৩২৭৭ ও সহিহ মুসলিম: ২৫৪৭)। রাসূল -সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম- আরো বলেন: হযরত আবু হুরাইরা -রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু- হতে বর্ণিত, রাসূল -সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম- ইরশাদ করেন: ‘যে ব্যক্তি ঈমান ও সাওয়াবের আশায় রমাদান মাসের সিয়াম পালন করে আল্লাহ তা’আলা তার অতীতের সকল পাপ ক্ষমা করে দেন’(সহিহুল বুখারি: ৩৮, সহিহ মুসলিম: ৭৬০)।
জ. রমাদান মাস ফজিলতপূর্ণ হওয়ার কারণ:
কুরআন ও হাদিসের আলোকে এটি সম্মানিত মাস হওয়ার পেছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে। যেমনÑ
১. এটি কুরআন মাজীদ নাজিলের মাস: পবিত্র রমাদান মাসে আলাহ তা’আলা মানুষের জন্য হেদায়াতের আলোকবর্তিকা স্বরূপ কুরআনুল কারিমে নাজিল করেন। “রমাদান হলো সে মাস, যাতে নাযিল করা হয়েছে আল কুরআন। যা মানুষের জন্য হেদায়াত এবং সত্যপথযাত্রীদের জন্য সুস্পষ্ট নিদর্শন। আর সত্য-মিথ্যার মাঝে পার্থক্যকারী’ (সূরা বাক্বারাহ: ১৮৫)।
২. বরকতময় মাস : মাহে রমাদান বড়ই বরকতময় মাস। এ সম্পর্কে হাদিস এসেছে, হযরত আবু হুরায়রা -রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু- থেকে বর্ণিত, রাসূল -সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম- বলেন: ‘তোমাদের কাছে রমাদান আসছে, এটি বরকতময় মাস’ (সুনানে নাসায়ি)।
৩. রমাদান মাসের ইবাদতের তাৎপর্য অত্যধিক : এ মাসের ইবাদতের গুরুত্ব ও তাৎপর্য সম্পর্কে হাদিস শরিফে আছে, রাসূল -সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম- বলেন: ‘যে ব্যক্তি এ মাসে একটি নফল আমল করল, সে যেন অন্য মাসের একটি ফরজ আমল করল। আর যে এ মাসে একটি ফরজ আমল করল, সে যেন অন্য মাসের সত্তরটি ফরজ আমল করল’ (বায়হাক্বি)।
৪. এ মাসে জান্নাতের দরজাসমূহ খুলে দেওয়া হয় : রমাদান মাসের আগমনের সাথে সাথে জান্নাতের দরজাসমূহ খুলে দেওয়া হয় এবং জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ করে দেওয়া হয়। হাদিস শরিফে বর্ণিত রয়েছেÑ ‘যখন রমাদান আসে, তখন রহমতের (জান্নাতের) দরজাসমূহ খুলে দেওয়া হয় এবং জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ করে দেয়া হয়। আর শয়তানকে বন্দী করা হয়’ (সহিহ মুসলিম)।
৫. মাহে রমাদানে ওমরাহ পালনে হজের সওয়াব পাওয়া যায় : রাসূল -সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম- ইরশাদ করেন: হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস -রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুমা- হতে বর্ণিত, নিশ্চয় রাসূল -সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম- ইরশাদ করেন: ‘রমাদান মাসের ওমরাহ হজ্জের সমান অথবা বলেন, আমার সাথে হজ্জ করার সমান’ (সহিহুল বুখারি: ১৭৮৬,১৮৬৩ ও সহিহ মুসলিম: ১২৫৬, নাসায়ি: ২১১০, আবু দাউদ: ১৯৯০, ইবনু মাজাহ: ২৯৯৪, আহমাদ: ২০২৬)।
৬. সহনশীলতার মাস : রমাদান মাস রোযাদারকে ধৈর্য ও সহনশীলতার শিক্ষা দেয়। এ মাসে সব ধরনের পানাহারের সুযোগ ও স্ত্রী কাছে থাকা সত্ত্বেও আল্লাহর ভয়ে রোযাদার পানাহার ও সঙ্গম থেকে বিরত থাকে। মহানবি -সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম- বলেন: ‘রমাদান ধৈর্যের মাস, আর ধৈর্যের প্রতিদান জান্নাত’।
৭. ভ্রাতৃত্ববোধ সৃষ্টির মাস: মাহে রমাদনের রোযার মাধ্যমে ভ্রাতৃত্ববোধ সৃষ্টি হয়। ধনী ব্যক্তি উপবাসের মাধ্যমে গরিবের দুঃখ ও অনাহারের কষ্ট উপলব্ধি করতে পারে। একে অপরের সুখ-দুঃখ উপলব্ধির মধ্য দিয়ে পরস্পরের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ ও সম্প্রীতি সৃষ্টি হয়।
ঝ. রমাদান মাসে করণীয়:
কুরআনুল কারিমে ও হাদীসুর রাসূল -সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম- এর অসংখ্য দলীলের মাধ্যমে অকাট্যভাবে প্রমানিত যে, পবিত্র রমাদান মাসের মর্যাদা ও গুরুত্ব অনেক বেশী, যা এ মাসকে অন্য মাস সমূহের মাঝে স্বতন্ত্র মর্যাদা দান করেছে। তাই এ মাসের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ আমল রয়েছে, যে আমলগুলো প্রত্যেক মুমিনের অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে সম্পাদন করা উচিত। নিম্নে সংক্ষেপে এ জাতীয় কয়েকটি করণীয় তুলে ধরা হলো-
১. সিয়াম পালন করা:
ইসলামের পাঁচটি স্তম্বের অন্যতম হলো রমাদান মাসের সিয়াম পালন করা। তাই রমাদান মাসের প্রধান কাজ হলো সিয়াম পালন করা। কুরআনুল কারীমের ভাষায়: “তোমাদের মধ্যে যারা এ রমাদান মাস পাবে তারা যেন এ মাসের সিয়াম পালন করে” (সূরা বাক্বারাহ: ১৮৫)। এ রোযা প্রত্যেক সুস্থ, মুকীম, প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ এবং হায়েয-নেফাসমুক্ত প্রাপ্তবয়স্ক নারীর ওপর ফরজ। হাদীসে কুদসীতে এসেছে রাসূলুল্লাহ -সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম- ইরশাদ করেন, আল্লাহ তা’আলা বলেন: ‘রোযা আমার জন্য এবং আমি নিজেই এর প্রতিদান দেবো’। তবে শর্তসাপেক্ষে পরবর্তীতে এ রোযা আদায় করার সুযোগ রয়েছে। কুরআনুল কারীমের ভাষায়: “তবে কেউ অসুস্থ বা সফরে থাকলে অন্য সময়ে এ সংখ্যা পূর্ণ করবে”(সূরা বাক্বারাহ: ১৮৫)।
২. তাকওয়া অর্জন করা: সিয়াম সাধনার মূল লক্ষ্যই হলো তাকওয়া অর্জন। যেমন- আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন: “হে মুমিনগণ! তোমাদের ওপর রোযা ফরজ করা হয়েছে, যেমনি ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর, আশা করা যায় তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারবে”(সূরা আল-বাক্বারাহ: ১৮৩)।
৩. নির্দিষ্ট সময়ে জামা’আতের সাথে সালাত আদায় করা: “নিশ্চয় সালাত মুমিনদের ওপর নির্দিষ্ট সময়ে আদায় করা ফরয”(সূরা নিসা : ১০৩)।
৪. সালাতুত তারাবীহ আদায় করা: সালাতুত তারাবীহ আদায় করা এ বরকতময় মাসের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। রাসূল -সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম- বলেন: ‘যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ও সাওয়াবের আশায় রমাদান মাসে সালাতুত তারাবীহ আদায় করে, তার অতীতের সব গুনাহ মাফ করে দেওয়া হয়’(সহিহুল বুখারি ও সহিহ মুসলিম)।
৫. সাহরি খাওয়া: সাহরি খাওয়ার মধ্যে অশেষ কল্যাণ ও বরকত রয়েছে এবং সিয়াম পালনে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। রাসূলুল্লাহ -সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম- বলেন: ‘তোমরা সাহরি খাও; কেননা সাহরির মধ্যে বরকত রয়েছে’(সহিহুল বুখারি ও সহিহ মুসলিম)।
৬. ইফতার করা: সময় হওয়ার সাথে সাথে ইফতার করা বিরাট ফজিলাতপূর্ণ কাজ। কেননা রাসূল -সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম- বলেন: ‘মানুষ তৎক্ষণ কল্যাণের মধ্যে থাকবে যতক্ষণ সময় হওয়ার সাথে সাথে ইফতার করবে’ (সহিহুল বুখারি: ১৯৫৭, সহিহ মুসলিম: ১০৯৮)। রাসূল -সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম- অন্যত্র বলেন: ‘তোমাদের মাঝে যে সিয়াম পালন করে, সে যেন খেজুর দিয়ে ইফতার করে, খেজুর না পেলে পানি দিয়ে ইফতার করবে। কেননা পানি হলো অধিক পবিত্র (সুনান আবু দাউদ)। নবি -সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম- যখন ইফতার করতেন তখন বলতেন: ‘পিপাসা নিবারিত হল, শিরা উপশিরা সিক্ত হল এবং আল্লাহর ইচ্ছায় পুরস্কার নির্ধারিত হল’(সুনানু আবূ-দাউদ)।
৭. ইফতার করানো: অপর রোযাদারকে ইফতার করানো একটি বড় সাওয়াবের কাজ। হাদীসে এসেছে: ‘যে ব্যক্তি কোন রোযাদারকে ইফতার করাবে, সে তাদের সমপরিমাণ সাওয়াব লাভ করবে, তবে রোযাদারের সাওয়াব হতে বিন্দুমাত্র হ্রাস করা হবে না’(জামেউত তিরমিজি: ৮০৭, ইবনু মাজাহ: ১৪৪৬, আহমাদ: ২১১৬৮)।
৮. কুরআনুল কারিম তিলাওয়াত করা: রমাদান মাস কুরআনের মাস। এ মাসের সঙ্গে কুরআনুল কারিমের গভীর স¤পর্ক রয়েছে। কেননা এ মহিমান্বিত মাসেই কুরআন অবতীর্ণ হয়। আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন: “রমাদান মাস, যাতে মানুষের দিশারী এবং সৎপথের স্পষ্ট নিদর্শন ও সত্যাসত্যের পার্থকারীরূপে কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে” (সূরা আল-বাক্বারাহ: ১৮৫)। তাই নবি -সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম- রমাদান মাসে কুরআন তেলাওয়াতের প্রতি অধিক গুরুত্ব দিতেন। এ প্রসঙ্গে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস -রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুমা- বলেন: ‘রাসূল -সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম- ছিলেন সবচেয়ে বেশি দানশীল ও বদান্য, রমাদানে তাঁর দানশীলতা ও বদান্যতা অনেক বেশী বেড়ে যেত। প্রত্যেক রমাদানে জিবরাঈল -আলাইহিস সালাম- তাঁর সঙ্গে মিলিত হতেন এবং পুরো কুরআন একে অপরকে শোনাতেন’ (সহিহুল বুখারি)। রাসূল -সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম- বলেন: ‘তোমরা কুরআন তিলাওয়াত কর, কেননা ইহা কিয়ামতের দিন তার তিলাওয়াতকারীর জন্য শাফায়াতকারী হবে’ (সহিহ মুসলিম: ৮০৪)। রাসূল -সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম- আরো বলেন: “সিয়াম ও কুরআন কিয়ামতের দিন বান্দার জন্য সুপারিশ করবে, সিয়াম বলবে, হে রব! আমি তাকে দিনের বেলায় পানাহার ও জৈবিক চাহিদা পূরণ হতে বিরত রেখেছি, অতএব আমাকে তার জন্য সুপারিশ করার অনুমতি দিন। আর কুরআন বলবে আমি তাকে রাতের বেলায় নিদ্রা হতে বিরত রেখেছি তাই আমাকে তার জন্য সুপারিশ করার অনুমতি দিন। রাসূল -সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম- বলেন, ‘অত:পর এতদ্বয়ের সুপারিশ গ্রহণ করা হবে’ (আহমাদ: ৬৬২৬, হাকেম: ২০৩৬, বায়হাক্বি: ১৯৯৪)। তিনি অন্যত্র বলেন: ‘যে ব্যক্তি কুরআনের একটি হরফ তিলাওয়াত করে, তাকে কমপক্ষে দশটি নেকি প্রদান করা হয়। আমি বলি না
যে, আলিফ, লাম, মীম একটি হরফ। বরং আলিফ একটি হরফ, লাম একটি হরফ এবং মীম একটি হরফ’(জামেউত তিরমিজি: ২৯১০)।
৯. কুরআন বুঝার জন্য সচেষ্ট হওয়া: নারী-পুরুষ সকল মুসলিমের উচিৎ কুরআনুল কারিমে বুঝার জন্য চেষ্টা করা। আর কুরআন নাযিলের মাসে তা বুঝার জন্য আরো বেশি সচেষ্ট হওয়া দরকার। আল্লাহ তা’আলা বলেন: “এক কল্যাণময় কিতাব, ইহা আমি আপনার ওপর অবতীর্ণ করেছি, যাতে মানুষ এর আয়াতসমূহ অনুধাবন করে এবং বোধশক্তি স¤পন্ন ব্যক্তিগণ গ্রহণ করে উপদেশ”(সূরা সোয়াদ: ২৯)।
১০. আল্লাহ তা’আলার প্রতি কৃতজ্ঞতা পোষণ করা: রমাদান মাস পাওয়া প্রতিটি মুমিনের জন্য এক মহা সৌভাগ্যের বিষয়। কেননা এ মাসের মর্যাদা অনেক বেশী। যাতে বান্দার জন্য মহান মনীবের সন্তুষ্টি অর্জন করা অন্য সময়ের চেয়ে অনেক বেশী সহজতর। কুরআনুল কারিমের ভাষায়: “তোমরা সংখ্যা পূর্ণ করবে এবং তোমাদেরকে সৎপথে পরিচালিত করার কারণে তোমরা আল্লাহর মহিমা ঘোষণা করবে এবং যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পার”(সূরা আল-বাক্বারাহ: ১৮৫)।
১১. কল্যাণকর কাজ বেশি বেশি করা: এ মাসটি মহান রব প্রদত্ত ইবাদতের বিশেষ মওসুম। তাই সাধ্যানুযায়ী এ মাসে বেশী বেশী ভাল কাজ করা উচিত। আল্লাহ তা’আলা বলেন: “তোমরা ধাবমান হও স্বীয় প্রতিপালকের ক্ষমার দিকে এবং সেই জান্নাতের দিকে যার বিস্তৃতি আসমান ও যমীনের ন্যায়, যা মুত্তাকীদের জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছে” (আল-ইমরান: ১৩৩)। রাসূল -সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ভাষায়: ‘এ মাসের প্রত্যেক রাতে একজন ঘোষণাকারী এ বলে আহবান করতে থাকে যে, ‘হে কল্যাণের অনুসন্ধানকারী তুমি আরো অগ্রসর হও! হে অসৎ কাজের পথিক, তোমর অন্যায় পথে চলা বন্ধ কর। এ মাসের প্রতি রাতে আল্লাহ তা’আলা অগণিত লোককে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিয়ে থাকেন’(জামেউত তিরমিজি: ৬৮২)।
১২. বেশি বেশি দান-সদাকাহ করা: এ মাসে বেশি বেশি দান-সাদাকাহ করার জন্য চেষ্টা করা, ইয়াতীম, বিধবা গরীব, মিসকীন ও অসহয়দের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া ও বেশী বেশী দান সদাকাহ করা উচিত। মহান রবের ভাষায়: “অতএব তোমরা সৎকর্মে প্রতিযোগিতা কর”(সূরা আল-বাক্বারাহ: ১৪৮)। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস -রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুমা- থেকে বর্ণিত: রাসূলুল্লাহ -সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম- ছিলেন মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দানশীল আর রমাদান মাসে তাঁর এ দানশীলতা আরো বেড়ে যেত (সহিহ মুসলিম: ৪১৭৬)।
১৩. অশ্লীল কথা ও কাজ পরিহার করা: সিয়াম সাধনার অন্যতম দাবী হলো যাবতীয় মিথ্যা কথা, খারাপ কাজ ও আচরণ পরিহার করে চলা। যেমন- রাসূলুল্লাহ -সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম- ইরশাদ করেন: ‘যে ব্যক্তি রমাদানের রোযা রাখলো; কিন্তু অশ্লীল কথা ও কাজ পরিহার করলো না, তার পানাহার ত্যাগে আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই’ (সহিহুল বুখারি: ৬০৫৭)।
১৪. ইতিকাফ করা: ইতিকাফ অর্থ অবস্থান করা। ইসলামের পরিভাষায়- স্বাভাবিক জীবন থেকে পৃথক হয়ে সিয়াম, সালাত, কুরআন তিলাওয়াত, দুআ, ইসতিগফার, জিকর ও অন্যান্য ইবাদাতের মাধ্যমে আল্লাহ তা’আলার সান্নিধ্য লাভের জন্য রমাদানের শেষ দশকে ইতিকাফের নিয়্যাতে মসজিদে অবস্থান করা। উম্মুল মুমিনিন আয়েশা রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহা হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল -সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম- তাঁর ইন্তিকাল পর্যন্ত রমাদানের শেষ দশকে ইতিকাফ করতেন”(সহিহুল বুখারি: ২০২৬।
১৫. লাইলাতুল কদর তালাশ করা: রমাদান মাসে এমন একটি মহিমান্বিত রজনী রয়েছে যা হাজার মাসের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। আল্লাহ তা’আলার ভাষায়: “কদরের রজনী হাজার মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ”(সূরা কদর: ৩)। এ রাত পাওয়াটা বিরাট সৌভাগ্যের বিষয়। রাসূল -সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম- বলেন: ‘যে ব্যক্তি ঈমান ও সাওয়াবের আশায় লাইলাতুল কদর পালন করবে তার অতীতের সকল গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে (হিহুল বুখারি)। এ জন্য নবি -সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম- ইরশাদ করেন: ‘তোমরা রমাদানের শেষ দশকে লাইলাতুল কদর তালাশ কর’ (সহিহুল বুখারি: ২০২০,সহিহ মুসলিম: ২৬৬৬, ১১৬৯, মুয়াত্তা ইমাম মালেক: ৬৮৬)। আবদুল্লাহ ইবনু উমর (রাঃ) এর সূত্রে নবি -সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম- থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: ‘তোমরা (রমাদানের) শেষ সাতদিনের রাতগুলোতে লাইলাতুল ক্বদর তালাশ কর’ (সহিহ মুসলিম: ২৬৫২, ১১৬৫)। অন্য হাদীসে রাসূল -সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম- লাইলাতুল কদর পাওয়াকে আরো সহজ করে বলেন: “তোমরা রমাদানের শেষ দশকের বিজোড় রাত্রিগুলোতে লাইলাতুল কদর তালাশ কর”(সহিহুল বুখারি: ২০১৭)। লাইলাতুল কদরের দু’আর বিষয়ে উম্মুল মুমিনীন আয়েশা -রাদিয়াল্লাহু আনহা- নবি -সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম- কে জিজ্ঞাসা করলে জবাবে তিনি বলেন: ‘হে আল্লাহ! আপনি ক্ষমাশীল, ক্ষমাকে ভালবাসেন, তাই আমাকে ক্ষমা করুন’(জামেউত তিরিমিজি: ৩৫১৩)।
১৬. রমাদানের শেষ দশককে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া: রমাদানের শেষ দশকের বিশেষ ফজিলত রয়েছে। তাই রাসূল -সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম- শেষ দশকের প্রতি অধিক গুরুত্বারোপ করেছেন। উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়শা -রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহা- থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: ‘যখন রমাদানের শেষ দশক উপনীত হতো তখন নবি-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম- ইবাদতের মাত্রা আরো বাড়িয়ে দিতেন, রাত্রি জাগরণ করতেন এবং পরিবারের সদস্যদের জাগিয়ে দিতেন’ (সহিহুল বুখারি: ২০২৪, সহিহ মুসলিম: ২৬৭৭)। অন্য হাদীসে আয়েশা -রাদিয়াল্লাহু আনহা- বলেন: ‘রাসূল -সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম- অন্য সময়ের তুলনায় রমদানের শেষ দশকে ইবাদতে অধিক পরিশ্রম করতে (সহিহ মুসলিম: ২৬৭৮, জামেউত তিরমিজি: ৭৯৬)।
১৭. তাওবা ও ইস্তেগফার করা: নিজের গুনাহ মাফ করিয়ে নেওয়ার জন্য তাওবার কোন বিকল্প নেই। তাওবা করলে আল্লাহ খুশী হন। কুরআনুল কারীমের ভাষায়: “হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহর নিকট তাওবা কর, খালেস তাওবা; আশা করা যায়, তোমাদের রব তোমাদের পাপসমূহ মোচন করে দিবেন এবং তোমাদেরকে এমন জান্নাতসমূহে প্রবেশ করাবেন যার পাদদেশে নহরসমূহ প্রবাহিত”(সূরা আত-তাহরীম: ৮)। এর গুরুত্ব প্রসঙ্গে রাসূল -সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-বলেন: “হে মানব সম্প্রদায়! তোমরা আল্লাহর নিকট তাওবা করো এবং ক্ষমা প্রার্থনা করো। কেননা আমি আল্লাহর নিকট দৈনিক একশতবার তাওবা করি এবং ক্ষমা প্রার্থনা করি”(সহিহ মুসলিম ও মুসনাদ আহমাদ)। প্রিয় নবি -সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম- মাসুম হওয়া সত্ত্বেও তাঁর উম্মাতের প্রশিক্ষণের জন্য করণীয় বুঝিয়ে দিয়েছেন।
১৮. আল্লাহর জিকর করা: মহান রাব্বুল আলামীন চান বান্দা তাঁকে বেশি বেশি ডাকুক, তাঁকে ডাকলে তিনি খুশী হন এবং সাড়া দেন। আল্লাহ তা’আলার ভাষায়: “তোমরা আমাকে স্মরণ কর, আমি তোমাদের স্মরণ করব, আর তোমরা আমার (নেয়ামতের) কৃতজ্ঞতা পোষণ কর এবং অকৃতজ্ঞ হয়োনা”(সূরা আল-বাক্বারাহ: ১৫২)। এ মাসে বেশি বেশি আল্লাহকে স্মরণ করা ও তাসবীহ পাঠ করা উচিত। হযরত আবু হুরাইরা -রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু- রাসূল -সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন: ‘দুটি বাক্য উচ্চারণে সহজ, সওয়াবের দিক দিয়ে খুব ভারী এবং দয়াময়ের নিকট অত্যন্ত প্রিয়, তাহলো সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহি, সুবহানাল্লাহিল আজিম (সহিহুল বুখারি: ৭৫৬৩)।
১৯. দু’আ করা: রোযার মাধ্যমে মুমিন বান্দা আল্ল¬াহর এতই নৈকট্য অর্জন করে যে, যতক্ষণ সে রোযা অবস্থায় অথবা রোযার প্রস্তুতি অবস্থায় থাকে রাত-দিন তার কোনো দু’আ ফেরত দেওয়া হয় না, সকল দু’আ কবুল করা হয়। রাসূলুল্লাহ -সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম- ইরশাদ করেন: ‘প্রত্যেক মুসলিম রমাদানে যে দু’আ করে তা কবুল করা হয়, এ মাস দু’আ কবুলের মাস (মুসনাদুল বায্যার)। তাই আমাদের উচিত বেশি বেশি দু’আ করা। আনাস ইবনে মালেক -রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু- হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল -সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম- ইরশাদ করেন: ‘তিন ধরনের দু’আ আল্লাহর নিকট হতে ফেরত দেওয়া হয়না, তাহলো- পিতা-মাতার দু’আ সন্তানের জন্য, রোযাদারের দু’আ এবং মুসাফিরের দু’আ (বায়হাক্বি: ৬৬১৯)।
২০. ইফতারের আগ মুহূর্তে দু’আ করা: ইফতারের সময় দু’আ কবুল হয়। আব্দুল্লাহ ইবনে মুলাইকা বলেন, আমি আব্দুল্লাহ ইবনে আমর -রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু- থেকে শুনেছি তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ -সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম- কে বলতে শুনেছি, ইফতারের সময় রোযাদারের দু’আ কবুল করা হয়।
২১. খাদ্যদ্রব্য মজুদ না করা: খাদ্যদ্রব্য মজুদ করলে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তদের চরম ভোগান্তির স্বীকার হতে হয়। তাই খাদ্য মজুদ করা হতে বিরত থাকা জরুরি।
২২. সিন্ডিকেটের মাধ্যমে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি না করা: বিভিন্ন সময়ে কিছু ব্যবসায়ীদের অন্যায় সিন্ডিকেটের মাধ্যমে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি করার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়, বিশেষত: রমাদানুল মোবারক ও বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের পূর্বে তা পরিলক্ষিত হয়। অথচ রোযাদারগণ আল্লাহ তা’আলার মেহমান, তাই তাঁদের কষ্ট হয় এমন যেকোন কাজ হতে আমাদের সকলের বিরত থাকা উচিৎ। বরং সাধ্যানুযায়ী এ মাসে ও প্রাকৃতিক দুর্যোগকালীন দ্রব্যমূল্য কমানো/সহনীয় রাখা দরকার।
২৩. সদাকাতুল ফিতর আদায় করা: সিয়াম পালনের ক্ষেত্রে সংগঠিত ক্রটি-বিচ্যুতি মোচনের লক্ষ্যে ইসলামে সাদকাতুল ফিতর প্রবর্তন করা হয়। ইবনে আব্বাস -রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুমা- হতে বর্ণিত তিনি বলেন: ‘রাসূল -সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম- রোযাদারের ক্রটি-বিচ্যুতি হতে পবিত্র করার জন্য ও গরীব-মিসকীনদের খাবার ব্যবস্থার লক্ষ্যে সদাকাতুল ফিতর ওয়াজিব করেন’(সুনানু আবু দাউদ: ১৬০৯)। আবদুল্লাহ ইবনু উমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, নবি – সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম- লোকদের-কে ঈদের সালাতের উদ্দেশ্যে বের হবার পূর্বেই সদাকাতুল ফিতর আদায় করার নির্দেশ দেন (সহিহুল বুখারি: ১৫০৯)।
২৪. ঈদের সময় আত্মীয়-স্বজন প্রতিবেশীর খোঁজ-খবর নেওয়া: সব সময়েই সাধ্যানুযায়ী আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশীর খোঁজ-খবর নেওয়া দরকার। তবে ঈদের সময় তা আরো গুরুত্বের সাথে আমলে নেওয়া, তাদের পাশে থাকা উচিত।
২৫. রমাদানে অর্জিত ইবাদতের প্রশিক্ষণকে পরবর্তী ১১ মাসে কাজে লাগানো: রমাদান মাস ইবাদত ও নিয়মানুবর্তীতার বিশেষ প্রশিক্ষণের মাস। আমাদের সকলের উচিত এ মাসে অর্জিত ইবাদতের মহা মূল্যবান প্রশিক্ষণকে পরবর্তী ১১ মাসে সঠিকভাবে কাজে লাগানোর মাধ্যমে মহান রবের সন্তুষ্টি লাভে সচেষ্ট থাকা। তাই আমাদের সকলের উচিত, স্বীয় কৃত অপরাধের জন্য কায়োমনোবাক্যে মহান মনীবের নিকট তাওবা করা, তাঁর দিকে ফিরে যাওয়া এবং তাঁর আদেশ-নিষেধ যথাযথভাবে পালনের মাধ্যমে সর্বদা তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনে সচেষ্ট থাকা।
লেখক:
হোসাইন মোহাম্মদ ইলিয়াস
কামিল, বিএ (অনার্স), কিং সৌদ ইউনিভার্সিটি, রিয়াদ, সৌদি আরব,
বিএ (অনার্স), এমএ, এমফিল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
উপাধ্যক্ষ, নিবরাস মাদরাসা।