মহান আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে সমগ্র মানব জাতির জন্য উপহার স্বরূপ বিশ্ব কোরআন দিবসের ঘোষণা দেয়া হয়েছে, এই গুরুত্বপূর্ণ দিবস সম্পর্কে সুরা আল বাকারার ১৮৫ নং আয়াত থেকে জানা যায়।
“রামাযান মাস, যে মাসে বিশ্বমানবের জন্য পথ প্রদর্শন এবং সু-পথের উজ্জ্বল নিদর্শন এবং হক ও বাতিলের প্রভেদকারী কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে। অতএব তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি সেই মাসে (নিজ আবাসে) উপস্থিত থাকে সে যেন সিয়াম পালন করে এবং যে ব্যক্তি পীড়িত অথবা প্রবাসী, তার জন্য অপর কোন দিন হতে গণনা করবে; তোমাদের পক্ষে যা সহজসাধ্য আল্লাহ তা’ই ইচ্ছা করেন ও তোমাদের পক্ষে যা দুঃসাধ্য তা ইচ্ছা করেননা এবং যেন তোমরা নির্ধারিত সংখ্যা পূরণ করে নিতে পার এবং তোমাদেরকে যে সুপথ দেখিয়েছেন তজ্জন্য তোমরা আল্লাহকে মহিমান্বিত কর এবং যেন তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর”।
বিশ্ব কুরআন দিবসের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়ঃ
এক বা একাধিক দিনে বিশেষ স্বরণীয় ঘটনা কিংবা কোন উল্লেখযোগ্য উপলক্ষকে কেন্দ্র করে সামাজিক কর্মসূচি পালনের মাধ্যমে দিবস পালিত হয়। প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে মানব সমাজে দিবস পালনের রীতি প্রচলিত আছে। উল্লেখ্যযোগ্য ধর্মীয় দিবস সমূহ যথা- মুসলিম সম্প্রদায়ের হজ্ব পালন, ঈদুল ফিতর, ঈদুল আযহা, বিশ্বধর্ম দিবস, বৌদ্ধ পূর্ণিমা, দুর্গাপূজা, বড়দিন, ঈদে মিলাদুন্নবী ইত্যাদি।
সাধারণতঃ প্রতিটি দিবসেই ‘প্রতিপাদ্য বিষয়’ নির্ধারণ করা হয়, যা দিবসটির ভূমিকাকে সর্বসমক্ষে আরো গুরুত্ব ও অর্থবহ করে তোলে।
মহান আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে রামাদান মাসের নির্দিষ্ট কয়েকটি দিন দিবস হিসেবে পালনের ঘোষণা এসেছে। এটি সমগ্র মানব জাতির জন্য অবশ্যই অনুসরণীয় বিধান। এই মাসে বেশ কিছু কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নের বাধ্যবাধকতা সমগ্র মানব জাতির উপর বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। রামাদান মাসকে সমগ্র বিশ্বে ‘কোরআন দিবস’ হিসেবে ঘোষণার দাবি বৈজ্ঞানিক মানদন্ডে স্বীকৃত।
রামাদান মাস বিশ্ব মানবের মুক্তির মাস সত্য মিথ্যার পার্থক্য নির্নয়কারী আল-কোরআন এই মাসে অবতীর্ণ হয়েছে। কোরআন দিবসকে কেন্দ্র করে পূর্ণ মাসব্যাপী কতিপয় কর্মসূচি পালন বা উদযাপন করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। অবশ্যই পালনীয় উল্লেখযোগ্য কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে- রোজা রাখা, দান সদকা করা, রিপুর তাড়না থেকে নিজেকে সংযত রাখা বা সংযম প্রদর্শন, সৎকর্মের প্রতিযোগিতা ইত্যাদি।
১. সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পানাহার থেকে বিরত থাকা (শুধুমাত্র রামাদান মাসে পালনীয়)
২. দিনের বেলায় আপন স্ত্রীদের সাথে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন থেকে বিরত থাকা। (কেবলমাত্র রোজা পালনরত অবস্থায়)
৩. গরিব মিসকিন, ইয়াতিম, ভিক্ষুককে খাদ্য দান। (সর্বদাই পালনীয়)
৪. যাকাত আদায় (বৎসরে এককালীন প্রদেয়)
৫. সৎকর্মশীলতা অর্জন (জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে) ইত্যাদি
সুরা বাকারা আয়াতঃ১৭৭ এ সৎকর্মের সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে।
“সৎকর্ম শুধু এই নয় যে, পূর্ব কিংবা পশ্চিম দিকে মুখ করবে, বরং বড় সৎ কাজ হলো এই যে, ঈমান আনবে আল্লাহর উপর কেয়ামত দিবসের উপর, ফেরেশতাদের উপর এবং সমস্ত নবী-রসূলগণের উপর, আর সম্পদ ব্যয় করবে তাঁরই মহব্বতে আত্মীয়-স্বজন, এতিম- মিসকিন, মুসাফির- ভিক্ষুক ও মুক্তিকামী ক্রীতদাসদের জন্য। আর যারা নামাজ প্রতিষ্ঠা করে, যাকাত দান করে এবং যারা কৃত প্রতিজ্ঞা সম্পাদনকারী এবং অভাবে রোগে-শোকে ও যুদ্ধের সময় ধৈর্য ধারণকারী তারাই হল সত্যাশ্রয়ী, আর তারাই পরহেজকার”।
এই আয়াতের আলোকে সৎকর্ম সমূহ-
তাওহীদ: আল্লাহ এক ও অদ্বিতীয়, তিনি সৃষ্টি করেন আবার ধ্বংস করেন, তিনিই সকল ক্ষমতার উৎস, তার সমকক্ষ কেউ নেই, তিনি সকল কিছুর ধারক ও বাহক, তিনি সর্বময় কতৃত্ব ও ক্ষমতার অধিকারী, তিনি চিরঞ্জীব। এছাড়াও কেয়ামত দিবস, ফেরেশতাকুল এবং সমস্ত নবী-রসূলগণের উপর বিশ্বাস স্থাপন করা ঈমানের পরিচায়ক।
সালাত প্রতিষ্ঠা ও অনুসরণীয় পদ্ধতিঃ
এক. সালাত প্রতিষ্ঠা দ্বারা ধর্মীয় অনুশাসন (Governs commandment) বাস্তবায়ন তথা সুসাশন প্রতিষ্ঠা, ন্যায়বিচার, সাম্যতা, মানবাধিকার, অর্থনৈতিক ভারসাম্য আনায়ন, সর্বোপরি হক প্রতিষ্ঠা ও সকল প্রকার বাতিল বিষয় বর্জন ইত্যাদি।
দুই. দিনে ও রাতের নির্দিষ্ট সময়ে আল্লাহ তাআলার স্বরণে দন্ডায়মান, রুকু, সিজদা কিংবা শায়িত অবস্থায় কোরআন পাঠ করা ও ক্ষমা প্রার্থনা করা। এছাড়াও আল্লাহর সৃষ্টি সম্পর্কে গভীর চিন্তা ভাবনা করা এবং কৃতজ্ঞতা স্বরূপ বলতে হবে, হে আল্লাহ আপনি কোন কিছুই অনর্থক সৃষ্টি করেননি। আপনি আমাদের একমাত্র রব।
দান-অনুদান এবং যাকাতঃ
উপার্জিত অর্থ- সম্পদ হতে কিয়দংশ প্রতিনিয়ত দান করা বাধ্যতামূলক। এর সাথে যাকাতের কোন সম্পর্ক নাই। সম্পদের পরিমান যাই থাকুক না কেন সেখান থেকে আংশিক দান করতে হবে। এক্ষেত্রে অর্থ সম্পদের স্হিতি বা সময়ের গণণা কিংবা সঞ্চিত সম্পদের নির্ধারিত হার আল কোরআন দ্বারা সমর্থিত নয়। আল কুরআনের বাহিরে অতিরঞ্জিত যেকোনো বিধি বিধানের অন্তর্ভুক্তি বাতিল বলিয়া গণ্য হবে। কি পরিমান দান করতে হবে? এক্ষেত্রে মহান আল্লাহ নির্দেশনা “প্রয়োজনের অতিরিক্ত অংশ”
উপার্জিত সম্পদের উপর অন্যের হক-
এক. অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সকল আত্মীয়-স্বজন পরস্পর পরস্পরকে সমর্থ্য অনুযায়ী নিজ নিজ সম্পদ হতে আংশিক বিতরণ করবে। এক্ষেত্রে ধনী কিংবা গরিব বিবেচ্য বিষয় নয়।
দুই. সামর্থ্য অনুযায়ী উপার্জিত সম্পদ থেকে ব্যায়িত হবে এতিম- মিসকিন, মুসাফির- ভিক্ষুক ও মুক্তিকামী ক্রীতদাসদের জন্য। এখানে মুক্তিকামি ক্রীতদাস দ্বারা জীবন নির্বাহের জন্য অন্যের দারস্হ হওয়া বা পরনির্ভরশীলতাকে বোঝানো হয়েছে।
যাকাতঃ প্রচলিত রাষ্ট্রীয় ব্যাবস্থায় নাগরিকগণ বাৎসরিক আয়ের একটি অংশ বা ইনকাম ট্যাক্স রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দিয়ে থাকেন। এটি রাষ্ট্রীয় আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এবং বিশেষ শ্রেণীর নাগরিকদের ওপর বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ইনকাম ট্যাক্স প্রদান পদ্ধতি ইসলামীক পরিভাষায় যাকাত নামে অভিহিত। যাকাত পরিশোধের হার রাষ্ট্র কতৃক নির্ধারিত হবে, এটি নির্ভর করবে ঐ দেশের অর্থনৈতিক কাঠামোর উপর এবং কালভেদে পরিবর্তন হতে পারে। রাষ্ট্রকে ইনকাম ট্যাক্স প্রদান করার মাধ্যমে যাকাত আদায় হয়ে যাবে, এই অভিমত একান্তই ব্যক্তিগত।
ধৈর্য্য ধারণ: বিপদ আপদ, রোগ শোক, অভাব অনটন মানব জীবনের স্বাভাবিক ঘটনার অংশ, এমতাবস্থায় এর উত্তরণে ধৈর্য ও সহনশীলতার পরিচয় দিতে হবে। সর্বাবস্থায় আল্লাহ তাআলার সাহায্য কামনা করা অত্যাবশ্যক।
কৃত প্রতিজ্ঞাঃ কৃত প্রতিজ্ঞা বা ওয়াদা ভঙ্গকারীকে আল্লাহ প্রচন্দ করেন না। এহেন ঘৃণ্য আচরণ সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। কৃত ওয়াদা রক্ষা করা ফরজ, ওয়াদা ভঙ্গকারীকে আল্লাহর প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে।
মহিমান্বিত এই মাসে সমগ্র বিশ্ব মানবের জন্য সেলিব্রিটি মাস। মানবজাতির পথ প্রদর্শন এবং সু-পথের উজ্জ্বল নিদর্শন নিয়ে মহান রবের পক্ষ থেকে বেশ কিছু গাইড লাইন প্রেরিত হয়েছে।
বস্তু জগতের সৃষ্টি তত্ত্ব, জীবন তথা সমগ্র মাখলুকাত সৃষ্টি, আরস ও সময়ের প্রবাহ সবই বিজ্ঞানের নিয়ম নীতি মেনে পরিচালিত হয়। আল-কোরআন হল দি বুক অফ এভরিথিং অর্থাৎ সকল কিছুর গ্রন্হ।
লেখক:
মোঃ ওবায়েদ উল্লাহ
সহকারী ফিচার সম্পাদক
দৈনিক মুক্তির লড়াই।