
মোঃ আবদুল আউয়াল সরকার:
সংবাদপত্র হল একটি লিখিত প্রকাশনা যার মধ্যে থাকে বর্তমান ঘটনা,তথ্যপূর্ণ নিবন্ধ, সম্পাদকীয়,বিভিন্ন ফিচার এবং বিজ্ঞাপন। পৃথিবীর আধুনিক বিপ্লব ও সংগ্রামের ইতিহাসে সংবাদপত্রের ভূমিকা অনেক।
“সংবাদপত্র হলো সভ্যতার অগ্রদূত”একদিনে গড়ে উঠেনি আমাদের এই সম্ভ্রান্ত আধুনিক সভ্যতা। এই সভ্যতার পেছনে বহু মানুষের বহু দিনের শ্রম যেমন অবদান রেখেছে, সংবাদপত্র তথ্যের পরে তথ্য প্রদান করে তেমনি তিলে তিলে দাঁড় করিয়েছে এই সভ্যতার রূপরেখা। একমাত্র সংবাদপত্রই প্রথম তৈরী করেছে সভ্যতা উন্নয়নের উত্তাল ঢেউ। এই ঢেউকে আবার ছড়িয়ে দিয়েছে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে, যার ফলে পৃথিবীর নানান প্রান্তে লেগেছে আমাদের এই সভ্যতার ছোঁয়া।
ইদানিং অবাধ তথ্য প্রবাহের এই যুগে ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার যে জয় জয়কার তার সূতিকাগারও এই সংবাদপত্র। পৃথিবীর নানান পরতে পরতে যা কিছু ঘটছে তার সবই প্রতিফলিত হয় এই সংবাদপত্রের পাতায়। তাই তো সংবাদপত্রকে বলা হয় সমাজের দর্পন। না,শুধু ঘটনা আর দুর্ঘটনাই বাণী-চিত্র লাভ করে না সংবাদপত্রের পাতায়, সংবাদপত্র মানুষকে স্বপ্নও দেখায়। সে স্বপ্ন সুন্দর পৃথিবীর স্বপ্ন। সে স্বপ্ন সুখময় সমাজের স্বপ্ন। কুসংস্কারের অন্ধকার পাড়ি দিয়ে আলোকিত দিনের স্বপ্ন।
সংবাদপত্রের পাতায় চোখ রেখে প্রতিদিন সকালে একজন পাঠক এক নজরে দেখতে পায় দেশ বিদেশে ঘটে যাওয়া নানান চিত্র। সে চিত্র দেখে কখনো আলো ঝলোমল হয়ে ওঠে পাঠকের চোখ; আবার কখনো চোখ হয়ে ওঠে ছানাবড়া। কখনো কষ্টের ছবি দেখে কেঁদে ওঠে মন। এই কান্না হাসির যে জীবন, সে জীবনে গতি আনে এই সংবাদপত্র। তথ্য প্রদান করে মানুষের সামনে চলার যে পথ-পরিকল্পনা তাও ঠিক করে দেয় এই সংবাদপত্রই। সংবাদপত্রের পাতায় চোখ রেখেই বিশ্ব দেখে মানুষ; দেখে সামনে চলার রেখা মানচিত্র।
বিশ্বব্যাপী অর্থনীতি, সমাজনীতি, রাষ্ট্রনীতি, শিক্ষা-সংস্কৃতি, চিকিৎসা, যোগাযোগ, প্রভৃতি ক্ষেত্রে যে উন্নয়ন ও উৎকর্ষ সাধন এবং সর্বোপরি যে মানবিক উন্নয়ন তার প্রথম বার্তাবাহক কিন্তু এই সংবাদপত্রই।
এই সংবাদপত্রই মানুষের সামনে তুলে ধরে অতীত ইতিহাস, যে ইতিহাস থেকে মানুষ শিক্ষা নেয়, জাতি পায় সামনে চলার প্রেরণা। অতীতের ভুল ভ্রান্তিগুলোকে ফাউন্ডেশন করেই গড়ে উঠে করাও যে সংবাদপত্রের মহৎ গুণাবলীর একটি তা কিন্তু এই উপমহাদেশে প্রকাশিত পত্রিকাগুলোর কার্যক্রম থেকে সহজেই অনুমেয়। সেই সাথে এ কথাও প্রতীয়মান হয় যে, দেশ ও জাতীয় বৃহৎ স্বার্থে কাজ করতে গিয়ে সংবাদপত্রের কন্ঠরোধ হওয়াও অস্বাভাবিক কিছু নয়।
কখনো কখনো ভুল তথ্য উপস্থাপন করেও সংবাদপত্র হয়েছে সমালোচিত। কোন কোন সাংবাদিকের ব্যক্তিস্বার্থ নির্ভর বিতর্কিত সংবাদ পরিবেশনের কারণে সংবাদপত্রের জগতে যোগ হয়েছে নতুন টার্ম “হলুদ সাংবাদিকতা”। উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে কোন ব্যক্তি বা সমাজের চরিত্র হনন করে এবং মিথ্যা ও বানোয়াট তথ্যের উপস্থাপন করে দেশ ও জাতিকে বিভ্রান্ত করে সমালোচনার তোপের মুখে কখনো কখনো ম্রিয়মান হয়েছে সংবাদপত্রের ঔজ্জ্বল্য। আবার কখনো চরিত্রহীন খলনায়কদের পক্ষাবলম্বন করেও সংবাদপত্রকে পড়তে হয়েছে পাঠকের রোষানলে, যা সংবাদপত্রের মঙ্গল বয়ে তো আনেইনি বরং সংবাদপত্র হয়েছে বিতর্কিত। বর্তমানকালে পাঠকবর্গ সহসাই কোন কোন সংবাদপত্রের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ উত্থাপন করে থাকেন যে-সংবাদপত্র নাকি রাজনৈতিক পক্ষপাতমূলক সংবাদ পরিবেশন করে। ফলে বিভিন্ন আদর্শের রাজনীতির ছত্রছায়ায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কোন কোন সংবাদপত্র।
আবার কেউ কেউ এমনও বলেন যে- একটা পত্রিকায় পরিবেশিত সংবাদের উপর, বিশেষ করে রাজনৈতিক খবরের উপর, নাকি আস্থা রাখা যায় না। একটা রাজনৈতিক ঘটনার সত্যতা যাচাই করার জন্য নাকি কমছে কম চারপাঁচটি পত্রিকার সংবাদকে পর্যালোচনা করতে হয়। এক্ষেত্রে শুধু এ কথাই বলতে চাই যে, সংবাদ পত্রেরও একটা রাজনীতি আছে। একটা আদর্শ আছে। সে রাজনীতি হলো- পক্ষপাতহীন সংবাদ পরিবেশন। আদর্শ হলো – সত্যাদর্শ। সংবাদপত্র হলো আধুনিক সভ্যতার আশীর্বাদ। এই আশীর্বাদকে মানুষ এবং দেশ ও জাতির কল্যাণে ব্যবহার করুন। কল্যাণধর্মী এই আশীর্বাদকে মানুষের অকল্যাণে ব্যবহার করবেন, তো সংবাদপত্রের প্রতি মানুষের অনাস্থার সৃষ্টিই শুধু হবে না বরং যারা সংবাদপত্রকে কোন বিশেষ ব্যক্তি বা গোষ্ঠিগত স্বার্থে ব্যবহার করবেন কালের আবর্তনে তারাই নিক্ষেপিত হবেন সময়ের নির্মম আস্তাকুঁড়ে।”
কখনো কখনো অপসংস্কৃতি বা ভিনদেশীয় সংস্কৃতির বহুল প্রচার করে দেশীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির বিপরীতে অবস্থান গ্রহণ করেও সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে সংবাদপত্রকে। ইদানিং একটা উদ্বেগজনক কথাও শোনা যায় যে, কোন কোন বিপথগামী সাংবাদিক নাকি ভয় ভীতি দেখিয়ে মানুষের কাছে চাঁদাও আদায় করেন।
এই যে এতগুলো কথা, তা কেবল সংবাদপত্রের মঙ্গলময় শোভাযাত্রার দিকে তাকিয়ে। সংবাদপত্র সঠিক তথ্য উপাত্ত দিয়ে দেশ ও জাতিকে সামনে এগিয়ে নেবে, মানবিক মূল্যবোধে সভ্যতাকে পৌঁছে দেবে শীর্ষ চূড়ায় – এমনটিই আশা করে সংবাদপত্রের নির্মোহ শুভাকাঙ্খীরা। সংবাদপত্রের গুরুত্বপূর্ণ ও জাগ্রত বিবেকসূলভ ভূমিকায় সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হবে দেশ ও জাতি-এমনই আকাঙ্খা নিঃস্বার্থ পাঠকবর্গের।
পরিশেষে সংবাদপত্রের পথ চলা নির্মোহ হোক, দেশ ও জাতির কল্যাণে সংবাদপত্র রাখুক অনবদ্য ভূমিকা, নিষ্কন্টক হোক পরিচ্ছন্ন সংবাদপত্রের পথচলা- এই হোক সংবাদপত্রের সম্পাদক, প্রকাশক, সাংবাদিক ও পাঠক বর্গের নিত্যদিনের প্রত্যাশা।
লেখক:
চিকিৎসা প্রযুক্তিবিদ, শিক্ষক ও গণমাধ্যমকর্মী।