
মুনতাসীর মামুন
গাইবান্ধা শহরকে মডেল হিসাবে গড়ে তুলতে নগর উন্নয়ন অধিদপ্তর, ব্র্যাক ও গাইবান্ধা পৌরসভার যৌথ উদ্যোগে তৈরি করা হয়েছে এক মহাপরিকল্পনা।
বিশ্ব শহর দিবস উপলক্ষ্যে বুধবার, ১লা নভেম্বর রাজধানীর ব্র্যাক সেন্টারে ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক নগর পরিকল্পনা ও উন্নয়নে অর্থায়ন’শীর্ষক একটি গোলটেবিল আলোচনা সভা ও প্রদর্শনীতে এই মহাপরিকল্পনার মোড়ক উন্মোচন করা হয়। ২০১৪ সাল থেকে প্রতি বছর ৩১শে অক্টোবর এই দিবস পালিত হয়।
জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে শতবর্ষী গাইবান্ধা পৌরসভা বর্তমানে দেশের ঝুঁকিপূর্ণ শহরগুলোর মধ্যে অন্যতম। এই পৌরসভার উন্নয়ন কার্যক্রম এতদিন কোনো প্রকার মহাপরিকল্পনা (মাস্টার প্ল্যান) ছাড়াই বাস্তবায়িত হয়ে এসেছে। ফলে এতে সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের চাহিদার প্রতিফলন সেভাবে লক্ষ্য করা যায়নি। গাইবান্ধা শহর যেন একটি পরিকল্পিত ও স্মার্ট নগরী হিসেবে সারাদেশে রোল মডেল হয়ে দাঁড়াতে পারে, এবং সরকারের রূপকল্প ২০৪১ বাস্তবায়নে অগ্রজ ভূমিকা পালন করতে পারে এই উদ্দেশ্যে এই মহাপরিকল্পনার কাজ হাতে নেয় বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাক, নগর উন্নয়ন অধিদপ্তর, ও গাইবান্ধা পৌরসভা।
উক্ত আয়োজনে প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব কাজী ওয়াছি উদ্দিন, বিশেষ অতিথি হিসেবে ছিলেন নগর উন্নয়ন অধিপ্তরের পরিচালক ড. খুরশীদ জাবিন হোসেন তৌফিক। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক আসিফ সালেহ্।
অনুষ্ঠানে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের মাননীয় সচিব কাজী ওয়াছি উদ্দিন বলেন, সরকার এখান সারা দেশে পরিকল্পিত নগর গড়তে কাজ করছে। গ্রামেই শহরের সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করতে কাজ করছে। সারা দেশে পরিকল্পিত নগর গড়তে যা করা দরকার, আমরা সেটা করছি। আমরা এমন উদ্যোগ নিয়েছি, যাতে গ্রামেও কেউ ঘরবাড়ি বানাতে গেলে পরিকল্পনা করে সেটা করে।
তিনি বলেন, গাইবান্ধার পরিকল্পনা চমৎকার একটি উদাহরণ। ব্র্যাককে উদাহরণ হিসাবে দেখাবো। বাকীদেরকেও আমরা ডাকবো। সবাই মিলে কাজ করলে দেশ এখানে থাকবে না।
নগর উন্নয়ন অধিপ্তরের পরিচালক ড. খুরশীদ জাবিন হোসেন তৌফিক বলেন, এবারের বিশ্ব শহর দিবস উদ্যাপনে স্বার্থকতা হচ্ছে, সরকারিভাবে পরিকল্পনা হয়, সেটা আমরা দেখে আসছি। এবার গাইবান্ধায় দেখলাম, সরকার ও এনজিও’র সমন্বয় হয়, সেটার স্বার্থক রূপায়ন দেখলাম গাইবান্ধা পৌরসভার পরিকল্পনায়।
ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক আসিফ সালেহ্ বলেন, “গাইবান্ধা শহরের জনসংখ্যা ৩ হাজার থেকে বেড়ে প্রায় ২ লাখ হয়ে গেছে। এটি কেবল গাইবান্ধা শহরের নয়, দেশজুড়েই এই চিত্র। আমাদের এখন নগরকেন্দ্রিক উন্নয়ন চিন্তাকে নতুন করে সাজানো প্রয়োজন। কারণ জলবায়ু অভিযোজন আর নানা স্বপ্নপূরণে মানুষ এখন নগরমুখী হচ্ছে। গাইবান্ধা শহরের পরিকল্পনা সেই লক্ষ্য অর্জনে একটি পদক্ষেপ। কিন্তু প্রকৃত সাফল্য তখনই আসবে, যখন এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হবে এবং এই শহরের সাফল্য দেখে অন্যরা আরো পরিকল্পিত দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ কবরে।”
তিনি আরো বলেন, “যখন একটি ভালো নগর পরিকল্পনা এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছা একত্রিত হবে, আমরা তখন দেখবো অনেক বড় পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। এক্ষেত্রে রাজশাহী একটি বড় দৃষ্টান্ত। এখন দ্বিতীয় টায়ারে থাকা শহরগুলোর কথা ভাবার সময় এসেছে এবং পরিবেশবান্ধব এমন মডেল শহর গড়া প্রয়োজন, যেটা যেটা প্রতিটি নাগরিকের সুযোগ-সুবিধার দিকে খেয়াল রাখবে। আমরা আশা করি, নগর প্রবৃদ্ধি কেন্দ্র হিসাবে এক্ষেত্রে সরকারের সাথে ধারাবাহিকভাবে কাজ করে যেতে পারবো, যেটা অর্থনৈতিক উন্নয়নে চালিকা শক্তি হয়ে উঠবে।”
অনুষ্ঠানে উদ্বোধনী বক্তব্যে ব্র্যাকের আরবান ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রামের কর্মসূচি প্রধান মোঃ ইমামুল আজম শাহী বলেন, “নগরায়ণের ফলে বিশ্ব পরিস্থিতি দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে এবং তারই সাথে আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত পরিকল্পনাকে আরও অন্তর্ভূক্তিমূলক এবং টেকসই করা।”
অনুষ্ঠানে ‘গাইবান্ধা পৌরসভা মহাপরিকল্পনা’ উপস্থাপন করেন ব্র্যাকের প্রোগ্রাম ম্যানেজার মোঃ সাইফ ইকবাল এবং গাইবান্ধা পৌরসভা মাস্টার প্ল্যান তৈরি প্রকল্পের পরামর্শক মোঃ কাওসার উদ্দিন।
পাশাপাশি ‘মীরসরাই উপজেলা মাস্টার প্ল্যান’উপস্থাপন করেন গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের উপ-পরিচালক (গবেষণা ও সমন্বয়) আহমেদ আখতারুজ্জামান এবং ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্প নগর মাস্টার প্ল্যান’ উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের প্রকল্প পরিচালক (যুগ্মসচিব) আবদুল্লাহ আল মাহমুদ ফারুক।
অন্যান্য বিশেষজ্ঞদের মধ্যে আলোচনায় অংশ নেন গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব নায়লা আহমেদ, পরিকল্পনা কমিশনের উপপ্রধান মীর আহমেদ তারিকুল ওমর, গাইবান্ধা পৌরসভার মেয়র মোঃ মতলুবর রহমান প্রমুখ।
গোলটেবিল আলোচনাটি পরিচালনা করেন ব্র্যাকের আরবান ডেভেলপমেন্ট, ক্লাইমেট চেঞ্জ এবং ডিজাস্টার রিস্ক ম্যানেজমেন্ট প্রোগ্রামের পরিচালক মোঃ লিয়াকত আলী, পিএইচডি।
বাংলাদেশে শহর নিরাপদ, টেকসই, এবং সহনশীল করা একটি সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য। ব্রাকের আরবান ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম ২০১৬ সাল থেকে শহরের নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠীর অধিকার, সুরক্ষা, ও সহনশীলতা উন্নত করার লক্ষ্যে কাজ করে চলেছে, যা দারিদ্র্য ও বঞ্চনা হ্রাস করতে সহায়তা করবে। বাংলাদেশে মহাপরিকল্পনা প্রণয়নের গতানুগতিক ধারার বাইরে গিয়ে সরকারি সংস্থা, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান ও বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা যৌথভাবে মহাপরিকল্পনা প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছে, যা ভবিষ্যতে অন্তর্ভূক্তিমূলক পরিকল্পনা প্রণয়নে রোল মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে বলে আশা করেন বিশেষজ্ঞরা। সঠিক পরিকল্পনা, পর্যাপ্ত বিনিয়োগ, এবং নীতিগত উন্নয়নমূলক সিদ্ধান্ত দ্রুত বর্ধিষ্ণু শহরগুলোতে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রাখতে সহায়তা করবে এবং এর মাধ্যমে আমরা বৈশ্বিকভাবে সামাজিক অগ্রগতির দিকে এগিয়ে যেতে সক্ষম হবো।