
শাহিন আলম আশিক
আজ ১২ই ডিসেম্বর, আন্তর্জাতিক সার্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা দিবস (Universal Health Coverage Day)। স্বাস্থ্যকে কেবল রোগমুক্তি হিসেবে না দেখে, একে মুক্তির এক মৌলিক লড়াই হিসেবে গণ্য করা অপরিহার্য। কারণ, বৈষম্যহীন ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণের অন্যতম শর্ত হলো সার্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা।
একটি সুস্থ জাতিই একটি শক্তিশালী দেশ গঠন করতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশে, এই লড়াইয়ে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে স্বাস্থ্যসেবার তীব্র বৈষম্য ও ঘাটতি। এই ঝুঁকি কেবল শারীরিক নয়, এটি অর্থনৈতিক এবং সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্যও হুমকিস্বরূপ।
বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে বর্তমান পরিস্থিতি ও চ্যালেঞ্জসমূহ বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাত গত কয়েক দশকে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করলেও, এখনো বেশ কিছু গভীর সমস্যা বিদ্যমান:
১. গ্রামীণ স্বাস্থ্য খাতের দুর্বলতা: দেশের মোট জনসংখ্যার বড় একটি অংশ গ্রামে বাস করলেও, গ্রামীণ স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা চরমভাবে দুর্বল। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এবং কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতে জনবল, বিশেষত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের অভাব, প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সরঞ্জামের অভাব, এবং অপর্যাপ্ত বাজেট গ্রামীণ মানুষকে মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত করছে। ফলস্বরূপ, সামান্য অসুস্থতার জন্যও মানুষকে ছুটতে হচ্ছে শহরকেন্দ্রিক ব্যয়বহুল বেসরকারি হাসপাতালের দিকে।
২. স্বাস্থ্য খাতে অপর্যাপ্ত সরকারি বরাদ্দ: স্বাস্থ্য খাতে সরকারি মোট দেশজ উৎপাদনের (GDP) অংশ হিসেবে বরাদ্দ অত্যন্ত কম, যা এই খাতের প্রয়োজনীয় চাহিদা মেটাতে পারছে না। এই স্বল্প বরাদ্দ আধুনিক সরঞ্জাম কেনা বা প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগের ক্ষেত্রে বড় বাধা সৃষ্টি করে।
৩. সেবার বৈষম্য: ধনী-গরিব, শহর-গ্রাম নির্বিশেষে স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তিতে রয়েছে আকাশ-পাতাল পার্থক্য। নিম্ন আয়ের মানুষকে প্রায়শই ব্যয়বহুল চিকিৎসা খরচ বহন করতে হয়, যা তাদের ‘স্বাস্থ্যজনিত দারিদ্র্যের’ দিকে ঠেলে দেয়।
গণঅভ্যুত্থানে নতুন বাংলাদেশে মানুষের প্রত্যাশা দেশের আপামর জনসাধারণ, বিশেষত গ্রাম ও প্রান্তিক অঞ্চলের মানুষ, একটি পরিবর্তন এবং উন্নত স্বাস্থ্যসেবার জন্য উন্মুখ। গণঅভ্যুত্থান ও গণতান্ত্রিক প্রত্যাশার কেন্দ্রে অন্যতম দাবি হলো একটি জনমুখী স্বাস্থ্য ব্যবস্থা:
১. সর্বজনীন ও সাশ্রয়ী স্বাস্থ্যসেবা: মানুষের প্রথম প্রত্যাশা হলো – স্বাস্থ্যসেবা হবে সকলের জন্য সহজলভ্য ও সাশ্রয়ী। সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে থাকা ব্যয়বহুল চিকিৎসা ব্যবস্থার পরিবর্তে, সরকারকেই এর প্রধান দায়িত্ব নিতে হবে।
২. গ্রামীণ স্বাস্থ্যসেবার শক্তিশালীকরণ: গ্রামীণ ক্লিনিকগুলোতে ২৪ ঘণ্টা ডাক্তার ও নার্সের উপস্থিতি, জরুরি চিকিৎসা সরঞ্জামের ব্যবস্থা এবং ওষুধ প্রাপ্তি নিশ্চিত করা জরুরি। স্বাস্থ্যসেবা যেন ‘তৃণমূল পর্যায়ে মানুষের দোরগোড়ায়’ পৌঁছায়, সেই নিশ্চয়তা চায় সাধারণ মানুষ।
৩. স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা: স্বাস্থ্য খাতের বাজেট ব্যবহার ও সেবার মান নিয়ে স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা। সরকারি হাসপাতালগুলোতে রোগী হয়রানি বন্ধ করে একটি সেবামূলক পরিবেশ সৃষ্টি করা মানুষের অন্যতম চাওয়া।
✅ মুক্তির লড়াইয়ের প্রত্যয়
সার্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিতকরণে সরকারি এবং বেসরকারি পর্যায়ে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ জরুরি। এর মধ্যে স্বাস্থ্য খাতে পর্যাপ্ত অর্থায়ন, উন্নত স্বাস্থ্য সেবার প্রসার, এবং তৃণমূল পর্যায়ে স্বাস্থ্য সেবা প্রাপ্তি সহজীকরণ অন্যতম।
বৈষম্যহীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা বাস্তবায়ন করা মানে মানুষের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার পাশাপাশি একটি ন্যায়ভিত্তিক ও সমতাভিত্তিক সমাজ গড়ার পথে হাঁটা। এই মুক্তির লড়াইয়ে আমাদের প্রত্যেককে অংশগ্রহণ করতে হবে, তবেই অর্জিত হবে প্রকৃত মুক্তি।
মুক্তির লড়াই ডেস্ক : 
























