ঢাকা ০২:৫৩ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ২৩ ভাদ্র ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

৫৭ বছরেও মূল্যায়িত হন নি মোঃ কোব্বাদ খান

Oplus_131072

মুক্তির লড়াই ডেস্ক:

মোঃ কোব্বাদ খান- একজন প্রতিষ্ঠান, একজন শিক্ষানুরাগী এবং সমাজ সংস্কারক যিনি তৎকালীন বরুড়ার অন্ধকারাচ্ছন্ন সমাজকে আলোকজ্জ্বল করার প্রয়াসে অত্যন্ত অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন। একজন ব্যক্তির আন্তরিক প্রচেষ্টা, সঠিক দিক-নির্দেশনা এবং অনুপম ন্যায় বিচারের মাধ্যমে একটি সমাজ কিভাবে উন্নত হতে পারে, আলোকজ্জল হতে পারে তার সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ মরহুম মোঃ কোব্বাদ খান।

মোঃ কোব্বাদ খান ১৮৯৫ সালে কুমিল্লা জেলার বরুড়া উপজেলার অন্তর্গত ডেউয়াতলীর অত্যন্ত সম্ভ্রান্ত পরিবার খান বাড়িতে জন্ম গ্রহন করেন। সমাজে শিক্ষার আলো ছড়াতে উনার নিজ গ্রাম ডেউয়াতলী তথা সামগ্রিক বরুড়াতে বেশ কিছু শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠায় তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন। উনার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় এবং যোগ্য প্রশাসনিক নৈপূর্ণতায় কাদবা তারনী চরণ লাহা উচ্চ বিদ্যালয় (তলাগ্রাম), ঝলম উচ্চ বিদ্যালয়, ডেউয়াতলী সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, মহিদপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, দেওড়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, অর্জুনতলা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং শশইয়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় (যা পরবর্তিতে হাই স্কুলেও উন্নীত হয় এবং শশইয়া দুদু মিয়া উচ্চ বিদ্যালয় হিসেবে পরিচিত) প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য, উনার নিজ জন্মস্থান ডেউয়াতলী গ্রামটি তৎকালীন সময়ে শিক্ষা প্রসারে ছিল অনেকটা অনগ্রসর।

এলাকায় শিক্ষার বিস্তার এবং জ্ঞানের আলো প্রসারিত করতেই মোঃ কোব্বাদ খান এবং উনার অনুজ মোঃ দারাপ খান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিদাতা হিসেবে ডেউয়াতলী প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন, যা পরবর্তিতে ডেউয়াতলী সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়। শিক্ষকতার পাশাপাশি সমাজসেবা এবং সমাজ সংস্কারেও তিনি রেখেছিলেন অপরিহার্য ভূমিকা। সমাজ থেকে অন্যায়-অবিচারের কালো আধাঁর দূরীকরণে এবং ন্যায় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মহান ন্যায় বিচারক হিসেবেও তিনি অনুপম ভূমিকা পালন করেছিলেন যাঁর জীবদ্দশায় একটি অবিচারও সংগঠিত হয় নি।

মোঃ কোব্বাদ খান তাঁর বর্ণাঢ্য কর্মজীবনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কর্মকান্ডে সম্পৃক্ত ছিলেন এবং এ সকল কর্মকান্ডের মাধ্যমে তিনি সমাজ বিনির্মান এবং যথোপযুক্ত সমাজ সংস্কারের চেষ্টা অব্যাহত রেখেছিলেন। অবিভক্ত বাংলার প্রথম মূখ্যমন্ত্রী শেরে বাংলা এ. কে ফজলুল হক প্রবর্তিত ঋণ শালিসী বোর্ডের চেয়াম্যান হিসেবে তিনি অত্যন্ত সুনামের সাথে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। এ দায়িত্ব পালনের সময় তিনি বরুড়ার বহু কৃষক এবং পরিবারের ভূমি এবং সম্পদ রক্ষা করেছিলেন। এছাড়াও তিনি কুমিল্লা জেলা পরিষদের জীবন সদস্য, প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রশ্নপত্র প্রণয়ন এবং প্রকাশনা কমিটির সভাপতি এবং বরুড়া প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সভাপতি হিসেবে উনার গুরুত্বপূর্ণ ভমিকা পালন করেন।

আজকের বরুড়া উপজেলা কুমিল্লা জেলা তথা বাংলাদেশের একটি সমৃদ্ধ জনপদ। এ উপজেলা একটি স্বতন্ত্র জনপদ হিসেবে প্রতিষ্ঠার মূলেও রয়েছে একটি অনন্য ইতিহাস। ১৯৪৮ সালের আগে বরুড়া চান্দিনার অন্তর্ভুক্ত একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল। তৎকালীন সময়ে বরুড়ার অধিকাংশ প্রশাসনিক কর্মকান্ড পরিচালিত হতো চান্দিনায়। পরবর্তিতে বরুড়াকে তার নিজস্ব বলয়ে গড়ে তোলা এবং চান্দিনা থেকে আলাদা করে একটা স্বতন্ত্র এবং সমৃদ্ধ জনপদ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য সর্বপ্রথম গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক ভ‚মিকা পালন করেছিলেন মোঃ কোব্বাদ খান এবং তৎকালীন প্রশাসনকে এ কাজে তিনি বিশেষভাবে অপরিহার্য সহযোগিতাও প্রদান করেছিলেন। বলা যায়, উনার সে সময়ের গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক ভূমিকা এবং অবদানের জন্যই পরবর্তিতে ১৯৪৮ সালে বরুড়া আলাদা একটি উপজেলা হিসেবে প্রাতিষ্ঠানিক মর্যাদা লাভ করে। আর উনার সেদিনের অপরিহার্য অবদান এবং ভুমিকার ধারাবাহিক ফলশ্রæতিতে আজ স্বাধীন বাংলাদেশে বরুড়া এবং চান্দিনা আলাদা দুইাট উপজেলা, দুইটি পৌরসভা এবং দুইটি সংসদীয় আসন।

শিক্ষার প্রসারের পাশাপাশি অন্যান্য সামাজিক সেবার কাজ অগ্রসর করার মূলেও তিনি প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা অব্যাহত রেখেছিলেন। বরুড়ায় টিএনটি এবং পোস্ট অফিস প্রতিষ্ঠার মূলে অপরিহার্য ভূমিকা রেখেছিলেন বরুড়ার বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব আবু খন্দকার। আর উনাকে এ ব্যাপারে অপরিহার্য প্রশাসনিক সহযোগিতা, উৎসাহ এবং অনুপ্রেরণা প্রদান করেছিলেন মোঃ কোব্বাদ খান, যেহেতু তৎকালীন স্থানীয় এবং জেলা পর্যায়ের প্রশাসনের সাথে উনার একটা ঘনিষ্ট সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল। কুমিল্লা নগরীতে অবস্থিত কুমিল্লা মডার্ন স্কুলের (প্রাথমিক) পূর্বতন নাম ছিল চিলড্রেন’স সং। যার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন তৎকালীন (ষাটের দশক) বৃহত্তর কুমিল্লার নসির কোর্টের (বর্তমানে চাঁদপুরে অবস্থিত) বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ এবং শিক্ষানুরাগী এম. এ কুদ্দুস। এটাও জানা যায়, এ প্রতিষ্ঠানটি প্রতিষ্ঠার মূলেও এম.এ কুদ্দুসকে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক সহযোগিতা প্রদান করেছিলেন মোঃ কোব্বাদ খান।

১৯৬৭ সালের ২৭শে অক্টোবর, দিনটি ছিল ডেউয়াতলী তথা বৃহত্তর বরুড়া-চান্দিনা এবং কুমিল্লা অঞ্চলের মানুষের কাছে অত্যন্ত শোকাবহ একটি দিন। কারণ এ দিনটিতে মোঃ কোব্বাদ খান ৭২ বছর বয়সে এ পৃথিবী থেকে চির বিদায় নেন। উনার মৃত্যুতে বরুড়া তথা কুমিল্লা অঞ্চলের মানুষ চির দিনের জন্য হারিয়ে ফেলেন তাদের একজন আলোর দিশারী, শিক্ষানুরাগী, সমাজ সংস্কারক, এবং অনুপম ন্যায় বিচারককে।

অতীব পরিতাপের বিষয়, যে ব্যক্তিত্ব বরুড়াকে একটি স্বতন্ত্র প্রশাসনিক কাঠামোয় সমৃদ্ধ জনপদ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে এবং তৎকালীন অন্ধকারাচ্ছন্ন বরুড়া অঞ্চলে শিক্ষা বিস্তারে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ এবং অপরিহার্য ভূমিকা পালন করেছিলেন, সে মোঃ কোব্বাদ খান এর মৃত্যুর ৫৭ বছর পরেও বরুড়ার এ জনপদে উনাকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সেভাবে মূল্যায়িত করা হয়নি। মূল্যায়ন করার কোন পদক্ষেপ গ্রহন কার হয় নি। আজ পর্যন্ত কিংবদন্তি মরহুম মোঃ কোব্বাদ এর প্রতি সম্মান জানিয়ে এ বরুড়ায় কোন একটি রাস্তার নামকরণ হয় নি, উপজেলায় কোন একটি গুরুত্বপূর্ণ ভবন উনার নামে করা হয়নি, এমন কি স্বাধীনতার এত বছর পরেও আজ পর্যন্ত বরুড়া উপজেলার পক্ষ থেকেও উনাকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবেও মূল্যায়ন করা হয় নি।

এ প্রসঙ্গে মরহুম মোঃ কোব্বাদ খানের দৌহিত্র বিশিষ্ট ব্যবসায়ী এবং সমাজ সেবক মোঃ কামরুজ্জামান খান বলেন, আমাদের কিংবদন্তি দাদা মরহুম মোঃ কোব্বাদ খান বরুড়ার এ জনপদের জন্য যে অনন্য অসাধারন ভ‚মিকা রেখে গিয়েছিলেন সে তুলনায় বরুড়ায় তিনি সেভাবে মূল্যায়তি হন নি। একটা উন্নত জনপদ হিসেবে বরুড়া প্রতিষ্ঠায় আমাদের দাদা মরহুম মোঃ কোব্বাদ খানের অনন্য অবদানের কথা বিবেচেনায় উনাকে স্মরণীয় এবং সম্মানিত করে রাখার লক্ষ্যে কিছু পদক্ষপে গ্রহন করার জন্য বরুড়া উপজলো প্রশাসনের প্রতি বিশেষভাবে অনুরোধ করছি।

কিংবদন্তি মরহুম মোঃ কোব্বাদ এর প্রতি মূল্যায়নহীনতা প্রসঙ্গে উনার দৌহিত্র শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান খান বলেন, আমাদের কিংবদন্তি দাদা মরহুম মোঃ কোব্বাদ খান বরুড়াকে একটি আলাদা জনপদ হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য, এ জনপদের শিক্ষা বিস্তার এবং সমাজ সংস্কারের জন্য অপরিহার্য ভূমিকা পালন করেছিলেন। আজ অবধি আমাদের দাদা মরহুম মোঃ কোব্বাদ খানের নামে বরুড়ায় একটি রাস্তার নামকরণ বা গুরুত্বপূর্ণ কোন স্থাপনা বা ভবনের নামকরণও করা হয় নি। উনার মতো মহান ব্যক্তিত্বকে সম্মানিত এবং স্মরণীয় করাটাও একটা সৌন্দর্য এবং আমরা প্রত্যাশা করছি সে লক্ষ্যে বরুড়া উপজেলা প্রশাসন পদক্ষেপ গ্রহন করবেন।

মরহুম মোঃ কোব্বাদ খানের অন্যতম দৌহিত্র কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন এন্ড প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগের জুনিয়র কনসালটেন্ট (সার্জারী) ডা. মাহবুব ইবনে মোমেন খান জনি দাদার মূল্যায়নে বলেন, আমার কিংবদন্তী দাদাভাই মরহুম মোঃ কোব্বাদ খান ছিলেন শিক্ষানুরাগী এক অজানা ব্যক্তিত্ব যিনি তৎকালীন সরকারের বিভিন্ন কর্মকর্তাদের সাথে যোগাযোগ করে সমগ্র বরুড়া এবং চান্দিনাসহ কুমিল্লার প্রত্যন্ত অঞ্চলে শিক্ষা প্রসারে ব্যাপক কার্যক্রম হাতে নিয়েছিলেন। মেয়েদের শিক্ষা প্রসারের সুবিধার্থে উনি উনার এক ছেলের বউ, আমার মমতাময়ী মা মরহুমা ফুলনাহার বেগমকে ডেউয়াতলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তৎকালীন সরকারের নিয়োগ প্রক্রিয়ায় প্রদান করেন।

সেই ৬০ ও ৭০ দশকেই আমার দাদা নারীদের শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যা এক বিষ্ময়। প্রচার প্রসার বিমুখ ইতিহাসের এক অজানা মানুষ ছিলেন তিনি। জীবনের প্রতিটি মুহুর্তে উনি ছিলেন সততার এক মূর্ত প্রতীক। আর এমন একজন মহান ব্যক্তিত্বের প্রতি বিশেষ শ্রদ্ধা এবং মূল্যায়নস্বরুপ কিছু পদক্ষেপ গ্রহন করার জন্য বরুড়া উপজেলা প্রশাসনের প্রতি আমি বিশেষভাবে অনুরোধ করছি।

ট্যাগস
আপলোডকারীর তথ্য

জনপ্রিয় সংবাদ

৫৭ বছরেও মূল্যায়িত হন নি মোঃ কোব্বাদ খান

আপডেট সময় ০৭:৩৬:৪১ অপরাহ্ন, রবিবার, ৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫

মুক্তির লড়াই ডেস্ক:

মোঃ কোব্বাদ খান- একজন প্রতিষ্ঠান, একজন শিক্ষানুরাগী এবং সমাজ সংস্কারক যিনি তৎকালীন বরুড়ার অন্ধকারাচ্ছন্ন সমাজকে আলোকজ্জ্বল করার প্রয়াসে অত্যন্ত অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন। একজন ব্যক্তির আন্তরিক প্রচেষ্টা, সঠিক দিক-নির্দেশনা এবং অনুপম ন্যায় বিচারের মাধ্যমে একটি সমাজ কিভাবে উন্নত হতে পারে, আলোকজ্জল হতে পারে তার সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ মরহুম মোঃ কোব্বাদ খান।

মোঃ কোব্বাদ খান ১৮৯৫ সালে কুমিল্লা জেলার বরুড়া উপজেলার অন্তর্গত ডেউয়াতলীর অত্যন্ত সম্ভ্রান্ত পরিবার খান বাড়িতে জন্ম গ্রহন করেন। সমাজে শিক্ষার আলো ছড়াতে উনার নিজ গ্রাম ডেউয়াতলী তথা সামগ্রিক বরুড়াতে বেশ কিছু শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠায় তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন। উনার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় এবং যোগ্য প্রশাসনিক নৈপূর্ণতায় কাদবা তারনী চরণ লাহা উচ্চ বিদ্যালয় (তলাগ্রাম), ঝলম উচ্চ বিদ্যালয়, ডেউয়াতলী সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, মহিদপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, দেওড়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, অর্জুনতলা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং শশইয়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় (যা পরবর্তিতে হাই স্কুলেও উন্নীত হয় এবং শশইয়া দুদু মিয়া উচ্চ বিদ্যালয় হিসেবে পরিচিত) প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য, উনার নিজ জন্মস্থান ডেউয়াতলী গ্রামটি তৎকালীন সময়ে শিক্ষা প্রসারে ছিল অনেকটা অনগ্রসর।

এলাকায় শিক্ষার বিস্তার এবং জ্ঞানের আলো প্রসারিত করতেই মোঃ কোব্বাদ খান এবং উনার অনুজ মোঃ দারাপ খান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিদাতা হিসেবে ডেউয়াতলী প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন, যা পরবর্তিতে ডেউয়াতলী সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়। শিক্ষকতার পাশাপাশি সমাজসেবা এবং সমাজ সংস্কারেও তিনি রেখেছিলেন অপরিহার্য ভূমিকা। সমাজ থেকে অন্যায়-অবিচারের কালো আধাঁর দূরীকরণে এবং ন্যায় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মহান ন্যায় বিচারক হিসেবেও তিনি অনুপম ভূমিকা পালন করেছিলেন যাঁর জীবদ্দশায় একটি অবিচারও সংগঠিত হয় নি।

মোঃ কোব্বাদ খান তাঁর বর্ণাঢ্য কর্মজীবনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কর্মকান্ডে সম্পৃক্ত ছিলেন এবং এ সকল কর্মকান্ডের মাধ্যমে তিনি সমাজ বিনির্মান এবং যথোপযুক্ত সমাজ সংস্কারের চেষ্টা অব্যাহত রেখেছিলেন। অবিভক্ত বাংলার প্রথম মূখ্যমন্ত্রী শেরে বাংলা এ. কে ফজলুল হক প্রবর্তিত ঋণ শালিসী বোর্ডের চেয়াম্যান হিসেবে তিনি অত্যন্ত সুনামের সাথে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। এ দায়িত্ব পালনের সময় তিনি বরুড়ার বহু কৃষক এবং পরিবারের ভূমি এবং সম্পদ রক্ষা করেছিলেন। এছাড়াও তিনি কুমিল্লা জেলা পরিষদের জীবন সদস্য, প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রশ্নপত্র প্রণয়ন এবং প্রকাশনা কমিটির সভাপতি এবং বরুড়া প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সভাপতি হিসেবে উনার গুরুত্বপূর্ণ ভমিকা পালন করেন।

আজকের বরুড়া উপজেলা কুমিল্লা জেলা তথা বাংলাদেশের একটি সমৃদ্ধ জনপদ। এ উপজেলা একটি স্বতন্ত্র জনপদ হিসেবে প্রতিষ্ঠার মূলেও রয়েছে একটি অনন্য ইতিহাস। ১৯৪৮ সালের আগে বরুড়া চান্দিনার অন্তর্ভুক্ত একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল। তৎকালীন সময়ে বরুড়ার অধিকাংশ প্রশাসনিক কর্মকান্ড পরিচালিত হতো চান্দিনায়। পরবর্তিতে বরুড়াকে তার নিজস্ব বলয়ে গড়ে তোলা এবং চান্দিনা থেকে আলাদা করে একটা স্বতন্ত্র এবং সমৃদ্ধ জনপদ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য সর্বপ্রথম গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক ভ‚মিকা পালন করেছিলেন মোঃ কোব্বাদ খান এবং তৎকালীন প্রশাসনকে এ কাজে তিনি বিশেষভাবে অপরিহার্য সহযোগিতাও প্রদান করেছিলেন। বলা যায়, উনার সে সময়ের গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক ভূমিকা এবং অবদানের জন্যই পরবর্তিতে ১৯৪৮ সালে বরুড়া আলাদা একটি উপজেলা হিসেবে প্রাতিষ্ঠানিক মর্যাদা লাভ করে। আর উনার সেদিনের অপরিহার্য অবদান এবং ভুমিকার ধারাবাহিক ফলশ্রæতিতে আজ স্বাধীন বাংলাদেশে বরুড়া এবং চান্দিনা আলাদা দুইাট উপজেলা, দুইটি পৌরসভা এবং দুইটি সংসদীয় আসন।

শিক্ষার প্রসারের পাশাপাশি অন্যান্য সামাজিক সেবার কাজ অগ্রসর করার মূলেও তিনি প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা অব্যাহত রেখেছিলেন। বরুড়ায় টিএনটি এবং পোস্ট অফিস প্রতিষ্ঠার মূলে অপরিহার্য ভূমিকা রেখেছিলেন বরুড়ার বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব আবু খন্দকার। আর উনাকে এ ব্যাপারে অপরিহার্য প্রশাসনিক সহযোগিতা, উৎসাহ এবং অনুপ্রেরণা প্রদান করেছিলেন মোঃ কোব্বাদ খান, যেহেতু তৎকালীন স্থানীয় এবং জেলা পর্যায়ের প্রশাসনের সাথে উনার একটা ঘনিষ্ট সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল। কুমিল্লা নগরীতে অবস্থিত কুমিল্লা মডার্ন স্কুলের (প্রাথমিক) পূর্বতন নাম ছিল চিলড্রেন’স সং। যার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন তৎকালীন (ষাটের দশক) বৃহত্তর কুমিল্লার নসির কোর্টের (বর্তমানে চাঁদপুরে অবস্থিত) বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ এবং শিক্ষানুরাগী এম. এ কুদ্দুস। এটাও জানা যায়, এ প্রতিষ্ঠানটি প্রতিষ্ঠার মূলেও এম.এ কুদ্দুসকে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক সহযোগিতা প্রদান করেছিলেন মোঃ কোব্বাদ খান।

১৯৬৭ সালের ২৭শে অক্টোবর, দিনটি ছিল ডেউয়াতলী তথা বৃহত্তর বরুড়া-চান্দিনা এবং কুমিল্লা অঞ্চলের মানুষের কাছে অত্যন্ত শোকাবহ একটি দিন। কারণ এ দিনটিতে মোঃ কোব্বাদ খান ৭২ বছর বয়সে এ পৃথিবী থেকে চির বিদায় নেন। উনার মৃত্যুতে বরুড়া তথা কুমিল্লা অঞ্চলের মানুষ চির দিনের জন্য হারিয়ে ফেলেন তাদের একজন আলোর দিশারী, শিক্ষানুরাগী, সমাজ সংস্কারক, এবং অনুপম ন্যায় বিচারককে।

অতীব পরিতাপের বিষয়, যে ব্যক্তিত্ব বরুড়াকে একটি স্বতন্ত্র প্রশাসনিক কাঠামোয় সমৃদ্ধ জনপদ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে এবং তৎকালীন অন্ধকারাচ্ছন্ন বরুড়া অঞ্চলে শিক্ষা বিস্তারে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ এবং অপরিহার্য ভূমিকা পালন করেছিলেন, সে মোঃ কোব্বাদ খান এর মৃত্যুর ৫৭ বছর পরেও বরুড়ার এ জনপদে উনাকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সেভাবে মূল্যায়িত করা হয়নি। মূল্যায়ন করার কোন পদক্ষেপ গ্রহন কার হয় নি। আজ পর্যন্ত কিংবদন্তি মরহুম মোঃ কোব্বাদ এর প্রতি সম্মান জানিয়ে এ বরুড়ায় কোন একটি রাস্তার নামকরণ হয় নি, উপজেলায় কোন একটি গুরুত্বপূর্ণ ভবন উনার নামে করা হয়নি, এমন কি স্বাধীনতার এত বছর পরেও আজ পর্যন্ত বরুড়া উপজেলার পক্ষ থেকেও উনাকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবেও মূল্যায়ন করা হয় নি।

এ প্রসঙ্গে মরহুম মোঃ কোব্বাদ খানের দৌহিত্র বিশিষ্ট ব্যবসায়ী এবং সমাজ সেবক মোঃ কামরুজ্জামান খান বলেন, আমাদের কিংবদন্তি দাদা মরহুম মোঃ কোব্বাদ খান বরুড়ার এ জনপদের জন্য যে অনন্য অসাধারন ভ‚মিকা রেখে গিয়েছিলেন সে তুলনায় বরুড়ায় তিনি সেভাবে মূল্যায়তি হন নি। একটা উন্নত জনপদ হিসেবে বরুড়া প্রতিষ্ঠায় আমাদের দাদা মরহুম মোঃ কোব্বাদ খানের অনন্য অবদানের কথা বিবেচেনায় উনাকে স্মরণীয় এবং সম্মানিত করে রাখার লক্ষ্যে কিছু পদক্ষপে গ্রহন করার জন্য বরুড়া উপজলো প্রশাসনের প্রতি বিশেষভাবে অনুরোধ করছি।

কিংবদন্তি মরহুম মোঃ কোব্বাদ এর প্রতি মূল্যায়নহীনতা প্রসঙ্গে উনার দৌহিত্র শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান খান বলেন, আমাদের কিংবদন্তি দাদা মরহুম মোঃ কোব্বাদ খান বরুড়াকে একটি আলাদা জনপদ হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য, এ জনপদের শিক্ষা বিস্তার এবং সমাজ সংস্কারের জন্য অপরিহার্য ভূমিকা পালন করেছিলেন। আজ অবধি আমাদের দাদা মরহুম মোঃ কোব্বাদ খানের নামে বরুড়ায় একটি রাস্তার নামকরণ বা গুরুত্বপূর্ণ কোন স্থাপনা বা ভবনের নামকরণও করা হয় নি। উনার মতো মহান ব্যক্তিত্বকে সম্মানিত এবং স্মরণীয় করাটাও একটা সৌন্দর্য এবং আমরা প্রত্যাশা করছি সে লক্ষ্যে বরুড়া উপজেলা প্রশাসন পদক্ষেপ গ্রহন করবেন।

মরহুম মোঃ কোব্বাদ খানের অন্যতম দৌহিত্র কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন এন্ড প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগের জুনিয়র কনসালটেন্ট (সার্জারী) ডা. মাহবুব ইবনে মোমেন খান জনি দাদার মূল্যায়নে বলেন, আমার কিংবদন্তী দাদাভাই মরহুম মোঃ কোব্বাদ খান ছিলেন শিক্ষানুরাগী এক অজানা ব্যক্তিত্ব যিনি তৎকালীন সরকারের বিভিন্ন কর্মকর্তাদের সাথে যোগাযোগ করে সমগ্র বরুড়া এবং চান্দিনাসহ কুমিল্লার প্রত্যন্ত অঞ্চলে শিক্ষা প্রসারে ব্যাপক কার্যক্রম হাতে নিয়েছিলেন। মেয়েদের শিক্ষা প্রসারের সুবিধার্থে উনি উনার এক ছেলের বউ, আমার মমতাময়ী মা মরহুমা ফুলনাহার বেগমকে ডেউয়াতলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তৎকালীন সরকারের নিয়োগ প্রক্রিয়ায় প্রদান করেন।

সেই ৬০ ও ৭০ দশকেই আমার দাদা নারীদের শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যা এক বিষ্ময়। প্রচার প্রসার বিমুখ ইতিহাসের এক অজানা মানুষ ছিলেন তিনি। জীবনের প্রতিটি মুহুর্তে উনি ছিলেন সততার এক মূর্ত প্রতীক। আর এমন একজন মহান ব্যক্তিত্বের প্রতি বিশেষ শ্রদ্ধা এবং মূল্যায়নস্বরুপ কিছু পদক্ষেপ গ্রহন করার জন্য বরুড়া উপজেলা প্রশাসনের প্রতি আমি বিশেষভাবে অনুরোধ করছি।