
স্টাফ রিপোর্টার
সিনেমা হল ও হোটেল করার শর্তে জমি লিজ দেয়া হয়। ঘটনা ১৯৬৩ সালের। শর্ত মেনে সিনেমা হলও করা হয়।
কিন্তু সরকারের চোখে ধুলো দিয়ে সেই জায়গা নিজের করে নিতে সিনেমা হল ভেঙে বহুতল ভবন করে সরকারি শর্ত ভেঙে নিজের করে নিল এক ব্যক্তি। ঘটনাটি কুমিল্লা নগরীর কেন্দ্রস্থল কান্দিরপাড় এলাকার। আর সরকারি জমি দখলের কাফফারা হিসেবে দোকান ও কোটি কোটি টাকা দেয়া হয় সাবেক এমপি বাহার, তার মেয়ে ও আওয়ামী লীগ নেতাদের।
সরেজমিনে দেখা গেছে, ওই ভবনের নাম রূপায়ন দেলোয়ার টাওয়ার। এটি সম্প্রতি নির্মাণ সম্পন্ন হওয়া নগরের কান্দিরপাড় এলাকার পুলিশ লাইন্স সড়কের ডান পাশের ১০তলা বাণিজ্যিক ভবন। যেই ভবনের লিজের অংশ ছাড়াও সরকারি জমি দখলের অভিযোগ আছে।
যেভাবে দখল হয় সরকারি ভূমি—
জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, কুমিল্লা নগরীর প্রাণকেন্দ্র কান্দিরপাড় এলাকায় অবস্থিত ২৪২নং ছোটরা মৌজার ২৬৯ এস.এ. খতিয়ানভূক্ত ১২৯৮, ১২৯৯, ১২৯৬, ১৩০০ দাগের দশমিক ৬১৬৩ একর সরকারি ভূমিতে সিনেমা হল ও হোটেল নির্মাণের জন্য ১৯৬৩ সালে ‘মেসার্স দেলোয়ার থিয়েটার এন্ড এন্টারপ্রাইজের’ স্বত্বাধিকারী অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা দেলোয়ার হোসেন বন্দোবস্ত পান।
বর্তমানে তা সদ্য নির্মাণ শেষ হওয়া একটি মার্কেট।
তৎকালীন সময়ে শহরবাসীর বিনোদনের বিষয়টি বিবেচনা করে সেখানে শুধুমাত্র সিনেমা হল ও হোটেল করার শর্তে ১৯৬৫ সালে সরকার ওই সম্পত্তি রিকুজিশন করে রেজিস্ট্রিকৃত দলিল সম্পাদন করে দেয়। শর্তানুযায়ী সেখানে ১৯৬৭ সালে ‘দীপিকা’ নামে একটি সিনেমা হল চালু করা হয়। ১৯৯৬ সালে ২য় ভবনের ৩য় তলায় চালু করা হয় ‘দীপালি’ নামের আরো একটি সিনেমা হল। ওই ভবনের ২য় তলায় উত্তরা ব্যাংকের শাখা, নীচ তলায় ছিল হোটেল ডায়না, সিনেমা হলের সামনে ও পাশে ফুজি কালার ল্যাব, ঘড়ি, ষ্টুডিওসহ ২৮টি দোকান ছিল। যার ভাড়াও নিতেন বন্দোবস্ত গ্রহীতা।
কিন্তু ২০১২ সালে শত কোটি টাকার ওই সম্পত্তিতে সরকারের অনুমতি না নিয়েই বহুতল বাণিজ্যিক, আবাসিক ও সিনেমা হল তৈরি করতে ঢাকার একটি হাউজিং কোম্পানীর (ডেভেলপার) সাথে চুক্তিবদ্ধ হয় বন্দোবস্ত গ্রহীতা। ২০১১ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর বন্দোবস্তের ওই স্থানে বহুতল বাণিজ্যিক, আবাসিক ও নতুন সিনেমা হল নির্মাণের জন্য অনুমতি চেয়ে মেসার্স দেলোয়ার থিয়েটার এন্ড এন্টারপ্রাইজের ম্যানেজার অহিদুর রহমান কুমিল্লা জেলা প্রশাসকের নিকট আবেদন করেন।
এ বিষয়ে প্রতিবেদন চেয়ে একই সালের ২৯ জুন কুমিল্লা জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে আদর্শ সদর উপজেলার তৎকালীন সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. আসাদুজ্জামানকে দায়িত্ব দেয়া হয়। ওই প্রতিবেদনে তিনি উল্লেখ করেন ‘যেহেতু উক্ত ভূমি সরকার থেকে শুধুমাত্র সিনেমা হল ও হোটেল নির্মাণের জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল, তাই বন্দোবস্ত শর্ত মোতাবেক সেখানে বাণিজ্যিক কিংবা আবাসিক ভবন তৈরীর কোন সুযোগ নেই।’ পরবর্তীতে বন্দোবস্ত গ্রহীতার পক্ষে মধ্যস্বত্বভোগী ওই হাউজিং কোম্পানী দীপিকা সিনেমা হল ভাঙ্গার কাজ শুরু করে। খবর পেয়ে ২০১৩ সালের ৮ জানুয়ারি তৎকালীন জেলা প্রশাসক মো. রেজাউল আহসানের নির্দেশে ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে পুলিশ ঘটনাস্থলে ভবন ভাঙ্গার কাজ বন্ধ করে দেয়। একইদিন জেলা প্রশাসনের ২৫ নম্বর স্মারকে প্রোপাইটার দেলোয়ার থিয়েটারকে কাজ বন্ধ রাখার আদেশ দিয়ে পত্র দেয়া হয়।
পরে ওই আদেশের বিরুদ্ধে ভূমি মন্ত্রণালয়ের সচিবকে বিবাদী করে এর বিরুদ্ধে একটি রিট করে রূপায়ন হাউজিং এস্টেট। ভূমি মন্ত্রণালয়ের ২০১৩ সালের ১৫ জুলাই এর এল.এ. মামলা হস্তান্তর করে করে দলিলে উল্লিখিত শর্তের বাইরে আবাসনসহ অন্য কোন প্রকার অবকাঠামো নির্মাণ করা যাবে না মর্মে নির্দেশ প্রদান করা হয়। সবশেষ ২০২১ সালের ১৪ জুন কুমিল্লা জেলা প্রশাসক বাদি হয়ে একটি মামলা দায়ের করেন। কুমিল্লার যুগ্ম জেলা জজ ১ নম্বর আমলি আদলতের ৯৬/২১ নম্বর মামলায় দেলোয়ারের স্ত্রী-সন্তানসহ ৫ ওয়ারিশকে বিবাদী করা হয়। মামলার আর্জিতে বলা হয়, শর্ত ভঙ্গ করে দেলোয়ার থিয়েটার এন্টারপ্রাইজ নিজ শর্ত ভঙ্গ করে সরকারি জায়গা দখল করে ডেভেলপার কোম্পানির সাথে সমযোতার চেষ্টা চালাচ্ছে।
ভূমি অফিস ও জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের অন্তর্ত ৫জন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, সরকারি জায়গা লিজ নিয়ে দখল বিক্রি বা হস্তান্তর এমনকি বহুতল ভবন নির্মাণ করার বিধান নেই। তিনি শুধু ভবনই করেননি। একাধারে হাউজিং কোম্পানির সাথে চুক্তি করেছেন, বাণিজ্যিক ভবন করেছেন এবং সবশেষ তিনি চুক্তির মূল শর্ত সিনেমাহলই করেননি। শুধু একটি নাম দিয়ে কোনমতে নথি দেখাতে সিনেমা হলের রূপ দিয়েছেন। এছাড়াও অবৈধভাবে লিজের জমিতে করা দোকান দেশের বিভিন্ন নামি-দামি পোশাক, জুতার ব্র্যান্ড ও ব্যক্তির কাছে বিক্রিয় করে দেন। যা লিজের শর্ত লঙ্ঘন।
যা বলছেন স্থানীয়রা—
কুমিল্লার অন্তত ১০জন আইনজীবী বিষয়টি নিয়ে নাম প্রকাশ না করা শর্তে বলেন, এখানে মোট জায়গার পরিমাণ (বি.এস রেকর্ড) শূন্য দশমিক ৬১৬৩ একর মেসার্স দেলোয়ার হোসেন থিয়েটারের নামে বি এস রেকর্ডভুক্ত করা হয়। কিন্তু তারা জালিয়াতির মাধ্যমে দশমিক ১১৫৬ একর অতিরিক্ত ভূমি বিএস খতিয়ানে অন্তর্ভুক্ত করেছে। যা লিজে পাওয়া সম্পত্তির অংশ নয়।
সূত্রে জানা গেছে, এই অতিরিক্ত সরকারি জমি বিক্রির পথ খুঁজছেন দেলোয়ারের ওয়ারিশ দেলোয়ার জাহিদ। ইতোমধ্যেই তিনি একটি পক্ষের কাছ থেকে প্রায় এক কোটি টাকা বায়না নিয়েছেন ওই জমি বিক্রির শর্তে। যদিও তা সরকারি জমি।
বাহারের প্রভাবে তটস্থ থাকতো সবাই—
সরকারি জমি দখলের জন্য রূপায়ন হাউজিং ও সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা দেলোয়ার নানান কৌশল অবলম্বন করেছেন। কোটি কোটি টাকা লেনদেন করে হাত করেছেন কুমিল্লা-৬ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার, তার কন্যা সাবেক মেয়র তাহসিন বাহার সূচনা ও কুমিল্লা মহানগর স্বেচ্ছাসেবকলীগের সভাপতি জহিরুল ইসলাম রিন্টুসহ একডজন নেতাকর্মীদের।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, কুমিল্লায় নগরীর কান্দিরপাড়ে সরকারি জায়গায় রূপায়ন দেলোয়ার টাওয়ার অবৈধভাবে নির্মাণ করতে সহায়তা করেন ততকালীন ক্ষমতাসীন দলের কুমিল্লা সদরের এমপি আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার। আর বিনিময়ে এমপি বাহার ও তার দলের লোকজন বিনামুল্যে দোকানের মালিক হন মার্কেটটিতে। এমপি বাহারও নেন বিপুল পরিমাণ আর্থিক সুবিধা। আর বিনামূল্যে দোকান বরাদ্দ পায় তআর কন্যা তাহসিন বাহার সূচনা, এমপি বাহারের গানম্যান কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের সহদপ্তর সম্পাদক দুলাল মাহমুদ, কুমিল্লা মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি জহিরুল ইসলাম রিন্টু, আওয়ামী লীগ নেতা মাহাবুব রাজিব। রূপায়ন দেলোয়ার টাওয়ারের ৫ম তলার ৫২৬, ৫২৭, ৫২৮, ৫২৯, ৫৩০ নম্বর দোকান বরাদ্দ পায় তারা। এসকল দোকানের বাজারমূল্য ৩০ কোটি টাকা।
আর দোকান বরাদ্দ দেয়ার কারণে আওয়ামী লীগ নেতারা রূপায়ণ দেলোয়ার টাওয়ারের অতন্দ্র প্রহরী হিসেবে দায়িত্ব নেয়। যেকারণে স্থানীয়রা রূপায়ন দেলোয়ার টাওয়ারের লুটপাট আর অনিয়ম নিয়ে কথা বলার সাহস করতো না। অপরদিকে প্রশাসনকে সামলে নেয়ার দায়িত্ব নেন তৎকালীন এমপি বাহাউদ্দিন বাহার। যেকারণে প্রশাসনের কোন কর্মকর্তা যদি ভুলেই এই রূপায়ন টাওয়ার নিয়ে মুখ খুলতেন তাকে পদায়ন, বদলিসহ নানান ঝামেলায় ফেলতেন এমপি বাহার।
কয়েকজন সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করা শর্তে বলেন, প্রকাশ্য দিবালোকে এমন অনিয়ম বাংলাদেশেই সম্ভব। আমরা প্রশাসনের পক্ষে বার বার বাধা দিতে চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু ক্ষমতার কাছে আমরাও অসহায় ছিলাম। একবার এক নারী কর্মকর্তা এ ভবন নিয়ে ব্যবস্থা নিতে আসেন। এমপি বাহার ও তার নেতাকর্মীরা ওই কর্মকর্তাকে হেনস্থা করে ছাড়েন। পরে তাকে বদলি করে দেয়া হয়। এমন বহু ঘটনা আছে যা প্রশাসনের লোকরাই শুধু জানতেন।
সাব রেজিস্টার অফিস যেভাবে অনুমোদন দিল—
অবৈধ রূপায়ন দেলোয়ার টাওয়ারের দোকান সাব রেজিস্ট্রি করে দেয়ার নেপথ্যে সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা করেছে সাব রেজিস্টার অফিস। কয়েকটি সূত্র বলছে, সাব রেজিস্টার অফিসের কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় ওই ভবনের দোকান বিক্রির দলিলপত্র তৈরি করে রূপায়ন হাউজিং।
অনেকে অভিযোগ করেন, সাব রেজিষ্টার অফিস এসব দলিলাধি না দিতে চাইলেও সাবেক এমপি বাহার তার লোকজন দিয়ে হুমকি ধামকি দিয়ে দলিল দিতে বাধ্য করতেন।
কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশনের সাবেক নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ নুরুল্লাহ বলেন, আমি ওই ভবনের অনিয়ম নিয়ে কথা বলেছিলাম। তখন সাবেক এমপি বাহার সাহেব আমাকে সার্কিট হাউসে নিয়ে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে। এবং ওই ভবনের প্ল্যান অনুমোদনের জন্য নির্দেশ দেন। কিন্তু আমি ওই ভবনের প্ল্যান অনুমোদন দেইনি এবং তাতে কোন সাক্ষরও করিনি। পরে তিনি প্রভাব খাটিয়ে এই প্ল্যান অনুমোদন করিয়ে নেন। যদিও নির্বাহী প্রকৌশলী হিসেবে আমার সাক্ষর থাকার কথা ছিল। কিন্তু আমি তাতে কোন সাক্ষর করিনি। আমার সাক্ষর ছাড়াই তা প্রভাব খাটিয়ে করিয়ে নেয়া হয়।
এ বিষয়ে রূপায়ন দেলোয়ার টাওয়ারের বর্তমান মালিক দেলোয়ার জাহিদকে তার ব্যবহৃত নাম্বারে কল দিলে তিনি কল রিসিভ করেন। পরে সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে তইনি কথা বলতে অস্বীকৃতি জানান।
এবিষয়ে কুমিল্লা জেলা প্রশাসক মো. আমিরুল কায়ছার বলেন, আমি বিষয়টি সম্পর্কে জেনেছি। সরকারি জায়গা দখলের অধিকার কারো নেই। বিষয়টি নিয়ে গুরুত্ব সহকারে দেখবো। যদি কেউ সরকারি জমি দখলের প্রমাণ পাওয়া যায় বা লিজের শর্ত ভঙ্গ করার প্রমাণ পাওয়া যায় তাহলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে।