ঢাকা ০৮:০১ অপরাহ্ন, শনিবার, ২১ জুন ২০২৫, ৭ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

লুমিনাস গ্রুপের বিরুদ্ধে প্রতারণার মামলা; ঝুঁকিতে গ্রাহকের শত শত কোটি টাকা

নিজস্ব প্রতিবেদক

‘বিনিয়োগের বিপরীতে বড় লাভ’, ‘ভেষজ পণ্য’, ‘স্বাস্থ্য উন্নয়ন’, ‘কৃষক বাঁচাও’—এমন চটকদার স্লোগান দিয়ে দেশজুড়ে দ্রুত বিস্তার লাভ করছে এমএলএম প্রতিষ্ঠান লুমিনাস গ্রুপ। তবে এসব প্রতিশ্রুতির আড়ালে লুকিয়ে আছে এক ভয়াবহ প্রতারণার চিত্র—যেখানে শত শত কোটি টাকা নিয়ে ধোঁকাবাজির অভিযোগ উঠেছে।

বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, ঢাকার ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে প্রতারণার অভিযোগে মামলা করেছেন ভুক্তভোগী প্রতিষ্ঠান পাতাকুঁড়ি প্রোডাক্টস লিমিটেড-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোঃ মাসুদ রানা। তার দাবি, তার ফ্যাক্টরি থেকে লুমিনাস গ্রুপ বিভিন্ন সময় পণ্য নিলেও পরিশোধ করেনি প্রাপ্য অর্থ। বর্তমানে গ্রুপটির কাছে ৮৪ লাখ টাকা বকেয়া রয়েছে।

অভিযোগে আরও বলা হয়, এই টাকা পরিশোধ না করে বরং লুমিনাস কর্তৃপক্ষ পাতাকুঁড়ি প্রোডাক্টস লিমিটেডকে মিথ্যা মালিকানা অংশীদার করার আশ্বাস দেয়। কিন্তু প্রতিশ্রুতি রক্ষা না করে প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রাকিব হোসেন ও সিও আলাউদ্দিন ছলচাতুরীর মাধ্যমে পুরো অর্থ আত্মসাৎ করার চেষ্টা করছেন।

এছাড়াও, একাধিক ডিলার এবং অংশীদার মালিক মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে জানা গেছে। তারা সবাই লুমিনাস গ্রুপের প্রতারণার ফাঁদে পড়ে বড় অঙ্কের আর্থিক ক্ষতির শিকার হয়েছেন।

রএ প্রসঙ্গে বরিশালের উজিরপুর উপজেলার শিকারপুর (৬নং ওয়ার্ড) এলাকার বাসিন্দা মোঃ বেলায়েত খান (৫৫) জানান,

“আমি প্রতিষ্ঠানটির একজন ডিলার ছিলাম। প্রায় ২ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছি। এক বছরেরও বেশি সময় ধরে গডাউন ভাড়া দিয়েছি। কিন্তু ঠিকভাবে কোনো টাকা পাইনি। লাভ তো দুরের কথা, আমার জীবনটাই একপ্রকার ধ্বংস হয়ে গেছে।”

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, লুমিনাস গ্রুপের কাগজপত্রে মালিকানা বারবার পরিবর্তন হয় এবং পরিচালকদের পরিচয়েও রয়েছে অস্বচ্ছতা। কেউ টাকা ফেরত চাইলে দেওয়া হয় চেক, যা ব্যাংকে জমা দিলে বাউন্স হয়। ফলে প্রতারিত গ্রাহকের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে।

আজকের দেশ.কম এবং দৈনিক পাঞ্জেরী পত্রিকায় প্রকাশিত অনুসন্ধানে প্রকাশ, প্রতিষ্ঠানটি এরইমধ্যে ২০০ কোটির বেশি টাকা সংগ্রহ করেছে এমএলএম সদস্যদের কাছ থেকে। এসব অর্থের একটি বড় অংশ রয়েছে চরম ঝুঁকির মধ্যে।
লুমিনাস গ্রুপ বাজারজাত করছে টুথপেস্ট, বডিলোশন, শ্যাম্পু, ডিটারজেন্ট, সার, ফিস ফিড ও ইউনানী ঔষধসহ বিভিন্ন ভেষজ পণ্য। তবে এসব পণ্যের প্রায় ৯০ শতাংশই সরকারি অনুমোদন ছাড়া বাজারে বিক্রি হচ্ছে, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য চরম ঝুঁকিপূর্ণ।

এ ব্যাপারে লুমিনাস গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রাকিব হোসেন ও সিও আলাউদ্দিনের সাথে মুঠোফোনে ও হোয়াটসএপে যোগাযোগ করে তাদের বক্তব্য চাওয়া হলে, তারা কথা বলতে রাজী হননি।

বিশেষজ্ঞদের মতে, যেসব প্রতিষ্ঠান অস্বচ্ছ আর্থিক লেনদেন ও MLM (মাল্টি-লেভেল মার্কেটিং) প্রতারণাকে ভিত্তি করে ব্যবসা পরিচালনা করে, তাদের পরিণতি ডেসটিনি, যুবক কিংবা স্পাইক নেটওয়ার্কের মতো হয়ে থাকে। লুমিনাস গ্রুপও সেই একই পথে হাঁটছে।

আজ যাদের ঝাঁ-চকচকে অফিস ও শোরুম আছে, কাল হয়তো কিছুই থাকবে না। ভুক্তভোগীরা হারাবেন তাদের কষ্টার্জিত অর্থ, আর প্রতারকরা হয়ে যাবেন গায়েব।

সচেতন নাগরিকদের প্রতি অনুরোধ—এখনই সাবধান হোন। এমন কোনো প্রতিষ্ঠানে টাকা বিনিয়োগ করবেন না, যাদের নেই সঠিক লাইসেন্স, নেই জবাবদিহিতা এবং যাদের যেকোনো সময় চুপিচুপি পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে।

এমএলএম প্রতারণা বন্ধে সরকারি সংস্থাগুলোকেও অবিলম্বে পদক্ষেপ নিতে হবে, নয়তো বাংলাদেশ আরও একটি এমএলএম ট্র্যাজেডি’র ভয়াবহ পরিণতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

ট্যাগস
আপলোডকারীর তথ্য

জনপ্রিয় সংবাদ

লুমিনাস গ্রুপের বিরুদ্ধে প্রতারণার মামলা; ঝুঁকিতে গ্রাহকের শত শত কোটি টাকা

আপডেট সময় ১১:৩৫:০৭ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ৩১ মে ২০২৫

নিজস্ব প্রতিবেদক

‘বিনিয়োগের বিপরীতে বড় লাভ’, ‘ভেষজ পণ্য’, ‘স্বাস্থ্য উন্নয়ন’, ‘কৃষক বাঁচাও’—এমন চটকদার স্লোগান দিয়ে দেশজুড়ে দ্রুত বিস্তার লাভ করছে এমএলএম প্রতিষ্ঠান লুমিনাস গ্রুপ। তবে এসব প্রতিশ্রুতির আড়ালে লুকিয়ে আছে এক ভয়াবহ প্রতারণার চিত্র—যেখানে শত শত কোটি টাকা নিয়ে ধোঁকাবাজির অভিযোগ উঠেছে।

বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, ঢাকার ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে প্রতারণার অভিযোগে মামলা করেছেন ভুক্তভোগী প্রতিষ্ঠান পাতাকুঁড়ি প্রোডাক্টস লিমিটেড-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোঃ মাসুদ রানা। তার দাবি, তার ফ্যাক্টরি থেকে লুমিনাস গ্রুপ বিভিন্ন সময় পণ্য নিলেও পরিশোধ করেনি প্রাপ্য অর্থ। বর্তমানে গ্রুপটির কাছে ৮৪ লাখ টাকা বকেয়া রয়েছে।

অভিযোগে আরও বলা হয়, এই টাকা পরিশোধ না করে বরং লুমিনাস কর্তৃপক্ষ পাতাকুঁড়ি প্রোডাক্টস লিমিটেডকে মিথ্যা মালিকানা অংশীদার করার আশ্বাস দেয়। কিন্তু প্রতিশ্রুতি রক্ষা না করে প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রাকিব হোসেন ও সিও আলাউদ্দিন ছলচাতুরীর মাধ্যমে পুরো অর্থ আত্মসাৎ করার চেষ্টা করছেন।

এছাড়াও, একাধিক ডিলার এবং অংশীদার মালিক মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে জানা গেছে। তারা সবাই লুমিনাস গ্রুপের প্রতারণার ফাঁদে পড়ে বড় অঙ্কের আর্থিক ক্ষতির শিকার হয়েছেন।

রএ প্রসঙ্গে বরিশালের উজিরপুর উপজেলার শিকারপুর (৬নং ওয়ার্ড) এলাকার বাসিন্দা মোঃ বেলায়েত খান (৫৫) জানান,

“আমি প্রতিষ্ঠানটির একজন ডিলার ছিলাম। প্রায় ২ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছি। এক বছরেরও বেশি সময় ধরে গডাউন ভাড়া দিয়েছি। কিন্তু ঠিকভাবে কোনো টাকা পাইনি। লাভ তো দুরের কথা, আমার জীবনটাই একপ্রকার ধ্বংস হয়ে গেছে।”

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, লুমিনাস গ্রুপের কাগজপত্রে মালিকানা বারবার পরিবর্তন হয় এবং পরিচালকদের পরিচয়েও রয়েছে অস্বচ্ছতা। কেউ টাকা ফেরত চাইলে দেওয়া হয় চেক, যা ব্যাংকে জমা দিলে বাউন্স হয়। ফলে প্রতারিত গ্রাহকের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে।

আজকের দেশ.কম এবং দৈনিক পাঞ্জেরী পত্রিকায় প্রকাশিত অনুসন্ধানে প্রকাশ, প্রতিষ্ঠানটি এরইমধ্যে ২০০ কোটির বেশি টাকা সংগ্রহ করেছে এমএলএম সদস্যদের কাছ থেকে। এসব অর্থের একটি বড় অংশ রয়েছে চরম ঝুঁকির মধ্যে।
লুমিনাস গ্রুপ বাজারজাত করছে টুথপেস্ট, বডিলোশন, শ্যাম্পু, ডিটারজেন্ট, সার, ফিস ফিড ও ইউনানী ঔষধসহ বিভিন্ন ভেষজ পণ্য। তবে এসব পণ্যের প্রায় ৯০ শতাংশই সরকারি অনুমোদন ছাড়া বাজারে বিক্রি হচ্ছে, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য চরম ঝুঁকিপূর্ণ।

এ ব্যাপারে লুমিনাস গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রাকিব হোসেন ও সিও আলাউদ্দিনের সাথে মুঠোফোনে ও হোয়াটসএপে যোগাযোগ করে তাদের বক্তব্য চাওয়া হলে, তারা কথা বলতে রাজী হননি।

বিশেষজ্ঞদের মতে, যেসব প্রতিষ্ঠান অস্বচ্ছ আর্থিক লেনদেন ও MLM (মাল্টি-লেভেল মার্কেটিং) প্রতারণাকে ভিত্তি করে ব্যবসা পরিচালনা করে, তাদের পরিণতি ডেসটিনি, যুবক কিংবা স্পাইক নেটওয়ার্কের মতো হয়ে থাকে। লুমিনাস গ্রুপও সেই একই পথে হাঁটছে।

আজ যাদের ঝাঁ-চকচকে অফিস ও শোরুম আছে, কাল হয়তো কিছুই থাকবে না। ভুক্তভোগীরা হারাবেন তাদের কষ্টার্জিত অর্থ, আর প্রতারকরা হয়ে যাবেন গায়েব।

সচেতন নাগরিকদের প্রতি অনুরোধ—এখনই সাবধান হোন। এমন কোনো প্রতিষ্ঠানে টাকা বিনিয়োগ করবেন না, যাদের নেই সঠিক লাইসেন্স, নেই জবাবদিহিতা এবং যাদের যেকোনো সময় চুপিচুপি পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে।

এমএলএম প্রতারণা বন্ধে সরকারি সংস্থাগুলোকেও অবিলম্বে পদক্ষেপ নিতে হবে, নয়তো বাংলাদেশ আরও একটি এমএলএম ট্র্যাজেডি’র ভয়াবহ পরিণতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।