
শাহিনুর রহমান পিন্টু, ঝিনাইদহ
বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে স্বর্ণ পাচার নতুন নয়, তবে সাম্প্রতিক সময়ে এর মাত্রা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। শনিবার ঝিনাইদহের মহেশপুর সীমান্তে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) আবারও সাড়ে তিন কোটি টাকার স্বর্ণ জব্দ করেছে। ঘটনাটি নিছক একটি অপরাধ দমন অভিযান নয়; বরং এটি সীমান্ত নিরাপত্তার সামগ্রিক চিত্র ও আমাদের রাষ্ট্রীয় কাঠামোর জন্য একটি সতর্কবার্তা।
ঘটনাপ্রবাহ
বিজিবি সূত্র জানায়, কাকিলাদাড়ি বাজার এলাকায় গোপন সংবাদের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে কালীগঞ্জ উপজেলার খোদ্দরায় গ্রামের কার্তিক চন্দ্র বিশ্বাসের ছেলে সৌরভ বিশ্বাস (২৫) কে আটক করে তার নিকট থেকে ৪টি স্বর্ণের বার (ওজন ২ কেজি ৩৩১.৭৯ গ্রাম, মূল্য প্রায় ৩ কোটি ৭০ লাখ টাকা) জব্দ করা হয়। পরে তার সহযোগী কোটচাঁদপুর উপজেলার কাগমারি গ্রামের অনন্ত বিশ্বাসের ছেলে শ্রী রনজিৎ বিশ্বাস (২৫) কেও আটক করে। এ অভিযানে মোটরসাইকেল, মোবাইল ফোনসহ আরও কিছু সামগ্রী জব্দ হয়।
সীমান্তে বাড়ছে স্বর্ণ পাচার
বিজিবির তথ্য অনুযায়ী, দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্তে শুধু চলতি বছরেই ৩৮টি অভিযানে প্রায় ৫০ কেজি স্বর্ণ জব্দ হয়েছে। সারাদেশে গত এক বছরে বিজিবির হাতে আটক স্বর্ণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১২২ কেজির বেশি।
প্রশ্ন হলো—এই বিশাল পরিমাণ স্বর্ণ কোথা থেকে আসে, কোথায় যায়, আর কে বা কারা এর নেপথ্যে রয়েছে? সাধারণত বাংলাদেশ হয়ে ভারতীয় বাজারে পাচার হয় এসব স্বর্ণ। কারণ ভারতে স্বর্ণের চাহিদা বেশি এবং দামও তুলনামূলক উঁচু। ফলে পাচারকারীরা সীমান্তবর্তী গ্রাম, গণপরিবহন এমনকি যাত্রীবাহী বাস ব্যবহার করে পাচারের নতুন নতুন কৌশল বের করছে।
জাতীয় অর্থনীতি ও নিরাপত্তার ওপর প্রভাব
স্বর্ণ পাচার শুধু আইনশৃঙ্খলার বিষয় নয়, বরং জাতীয় অর্থনীতির জন্যও বড় হুমকি। এর মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রার অবৈধ প্রবাহ, মানি লন্ডারিং এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ চক্র সক্রিয় হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাছাড়া স্বর্ণ পাচারকারীরা প্রায়শই মাদক, অস্ত্র ও অন্যান্য নিষিদ্ধ দ্রব্যের সঙ্গেও জড়িত থাকে। এই স্বর্ণ পাচারের ঘটনায় একজন প্রভাবশালী এমপি খুন হওয়া সহ সীমান্তে অঞ্চলে প্রায়ই খুনের ঘটনা ঘটে।
সরকারের করণীয় বিশ্লেষকদের মতে, সীমান্তে শুধু বিজিবির তৎপরতা যথেষ্ট নয়।
১. আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর নজরদারি (ড্রোন, স্ক্যানার, সেন্সর) বাড়াতে হবে।
২. স্থানীয় তথ্যদাতা নেটওয়ার্ক শক্তিশালী করতে হবে, যাতে পাচারকারীরা লোকাল মানুষের সহায়তা না পায়।
৩. পাচার চক্রের অর্থনৈতিক উৎস খুঁজে বের করে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে।
৪. সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো আন্তর্জাতিক সমন্বয়—কারণ স্বর্ণ পাচার একটি আন্তঃদেশীয় অপরাধ।
উপসংহার
ঝিনাইদহের মহেশপুরের সাম্প্রতিক ঘটনাটি কেবল একটি সফল অভিযান নয়; বরং রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা, অর্থনীতি ও সীমান্ত শাসনের সামনে বড় একটি চ্যালেঞ্জের প্রতিফলন। বিজিবির সতর্কতা প্রশংসনীয়, তবে রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও প্রশাসনিক সমন্বয় ছাড়া এই প্রবণতা রোধ করা সম্ভব নয়।
বাংলাদেশের সীমান্ত যেন কেবল বাণিজ্য ও সৌহার্দ্যের পথ হয়—অপরাধ ও পাচারের নয়—এটি নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি। (চোখ রাখুন।