
একটি ছোট ভিসার বিষয় হঠাৎ করেই বিরাট ঝড় তুলেছে। জটিল সম্পর্কের দুই অংশীদার যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারত—তাদের সম্পর্কে কি হঠাৎ করেই ভাঙন ধরেছে? এই অস্থিরতার কারণ যুক্তরাষ্ট্রে আনুষ্ঠানিকভাবে বাস্তবায়িত একটি নতুন ভিসা নীতি। এইচ-ওয়ানবি (H-1B) ওয়ার্ক ভিসার আবেদন ফি কয়েক হাজার ডলার থেকে বাড়িয়ে প্রায় এক লাখ মার্কিন ডলার করা হয়েছে। এই খবর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই শুধু যুক্তরাষ্ট্র বা ভারতে নয়, বিশ্বজুড়ে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। উভয় দেশের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম একে অপরের প্রতি ক্ষোভ এবং বিদ্বেষমূলক মন্তব্যে ভরে যায়, যার ফলে এক উত্তেজনাপূর্ণ পরিবেশ তৈরি হয়।
বিষয়টি মজার। যৌক্তিকভাবে, মার্কিন ভিসা নীতি বিশ্বব্যাপী কার্যকর এবং বিশেষভাবে শুধু ভারতের জন্য তৈরি নয়। তাহলে কেন একটি মাত্র ভিসার পরিবর্তন ভারত-মার্কিন সম্পর্কের ফাটলকে এত স্পষ্টভাবে প্রকাশ করে দিলো? এতে স্পষ্টতই চোখের সামনে যা দেখা যাচ্ছে, তার চেয়েও বেশি কিছু রয়েছে।
এইচ-ওয়ানবি ভিসা যুক্তরাষ্ট্রে একটি অস্থায়ী কাজের ভিসা, এটি অভিবাসী ভিসা নয়। এই ভিসা তিন বছরের জন্য বৈধ এবং ছয় বছর পর্যন্ত এর মেয়াদ বাড়ানো যেতে পারে। প্রতি বছর এই ভিসার জন্য ৬৫ হাজার আসন বরাদ্দ থাকে এবং যুক্তরাষ্ট্রে স্নাতকোত্তর বা উচ্চতর ডিগ্রিধারী আবেদনকারীদের জন্য অতিরিক্ত ২০ হাজার আসন সংরক্ষিত থাকে। এইচ-ওয়ানবি ভিসা মূলত আমেরিকান সংস্থাগুলোতে ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে মেধাবীদের আকৃষ্ট করার জন্য চালু হয়েছিল।
গত বছরের তথ্য অনুসারে, যুক্তরাষ্ট্রের ৭১% এইচ-ওয়ানবি ভিসা ভারতীয়রাই পেয়েছে। এমনকি অনেকে বলেন যে, ভারতীয়রা এইচ-ওয়ানবি ভিসাকে “ভারতীয় ভিসা”-তে রূপান্তরিত করতে সফল হয়েছে। প্রতি বছর নিবন্ধনের সময় ভারত থেকে লক্ষ লক্ষ আবেদন জমা পড়ে। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের ইমিগ্রেশন অ্যান্ড কাস্টমস এনফোর্সমেন্ট (ইউএসসিআইএস) কাছে “র্যান্ডম লটারি” ব্যবহার করা ছাড়া আর কোনো বিকল্প থাকে না। যেহেতু আবেদনকারীদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ ভারতীয়, তাই স্বাভাবিকভাবেই বেশিরভাগ আসন ভারতীয়দের কাছেই যায়।
বলা যেতে পারে, নতুন মার্কিন ভিসা নীতি ভারতের জন্য একটি বড় ধাক্কা। ভিসা-নির্ভর প্রযুক্তি আউটসোর্সিং ভারতের পরিষেবা বাণিজ্যের মেরুদণ্ড। ভারতের ৬০ শতাংশেরও বেশি আইটি পরিষেবা রপ্তানি হয় যুক্তরাষ্ট্রে। যদি যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী কর্মীদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে, তাহলে ভারতীয় সংস্থাগুলো সাময়িকভাবে তাদের কার্যক্রম দেশে বা পার্শ্ববর্তী কোনো দেশে স্থানান্তর করতে বাধ্য হবে। এর ফলে ভারতীয় অর্থনীতির ওপর যে প্রভাব পড়বে, তা অকল্পনীয়।
কিন্তু যদি আপনি মনে করেন এটি কেবল ভিসা নিয়ে বিরোধ, তাহলে আপনি বিষয়টিকে সরলীকরণ করছেন। রয়টার্সের মন্তব্য অনুযায়ী, মার্কিন ভিসা নীতিতে এই পরিবর্তনটি যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের মধ্যে পরিষেবা বাণিজ্য নিয়ে বৃহত্তর বিরোধের একটি অংশ। বস্তুত, যুক্তরাষ্ট্র ভারতের জন্য একাধিক দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। ঠিক এই বছরই পণ্য বাণিজ্য নিয়েও উভয় পক্ষের মধ্যে তীব্র মতবিরোধ দেখা দিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের মধ্যে বাণিজ্য আলোচনায় খুব একটা অগ্রগতি হয়নি। জুন মাসে ভারত কিছু কৃষি পণ্যের বাজার যুক্তরাষ্ট্রের জন্য উন্মুক্ত করার পরেও, যুক্তরাষ্ট্র তার অবস্থানে অনড় থাকে এবং ভারতের দুগ্ধ ও কৃষি বাজারের উল্লেখযোগ্য উন্মোচনের দাবি করে। তবে, দুগ্ধজাত পণ্যের বিষয়টি ভারতের জন্য একটি বড় উদ্বেগের কারণ, যা প্রায় আট কোটি ক্ষুদ্র কৃষকের জীবন-জীবিকার সঙ্গে জড়িত। এই শিল্পকে রক্ষা করার জন্য ভারত দুগ্ধ সমবায় এবং ফেডারেশনের একটি বিশাল নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠা করেছে, যা দেশব্যাপী প্রায় প্রত্যেক কৃষককে অন্তর্ভুক্ত করে। যদি যুক্তরাষ্ট্র ভারতের দুগ্ধ বাজার উন্মুক্ত করার জন্য চাপ দেয়, তাহলে এটি সরাসরি এই বিশাল স্বার্থসংশ্লিষ্ট গোষ্ঠীর ওপর প্রভাব ফেলবে, এবং ভারত স্বাভাবিকভাবেই এর বিরোধিতা করবে।
আগস্ট মাসে, যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়া থেকে তেল কেনার কারণে ভারতের ওপর শুল্ক আরোপের হুমকি দেয়, যার ফলে সরাসরি একটি নির্ধারিত আলোচনা বাতিল হয়ে যায়। আজও উভয় পক্ষের মধ্যে আলোচনায় কোনো স্পষ্ট অগ্রগতি দেখা যায়নি।
সুতরাং, মেধাবীদের আসা-যাওয়ার জন্য ভিসা থেকে শুরু করে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাণিজ্য এবং আন্তর্জাতিক কৌশল পর্যন্ত—সব মিলিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারতের মধ্যে একটি ব্যাপক ও গভীর বিরোধ দেখা দিয়েছে। আকাশচুম্বী ভিসা ফি হলো এই বিরোধের সর্বশেষ এবং সবচেয়ে নাটকীয় উদাহরণ।
সূত্র:শুয়েই-তৌহিদ-জিনিয়া,চায়না মিডিয়া গ্রুপ।