ঢাকা ০৯:৪৯ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ৩ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম
Logo ১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১: বিজয়ের পরদিন, রাষ্ট্র গঠন ও যুদ্ধবিধ্বস্ত জাতির পুনর্গঠনের প্রথম দিন Logo সুবিদাবঞ্চিত শিশুদের মাঝে শিক্ষা সামগ্রী বিতরণ Logo মহান বিজয় দিবসে জাতীয় স্মৃতিসৌধে ঢাকা প্রেসক্লাবের শ্রদ্ধা নিবেদন Logo কটিয়াদীতে মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে শহীদ স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধাঞ্জলি Logo বিজয় দিবস উপলক্ষ্যে জনসাধারণের জন্য ৭ টি জাহাজ উন্মুক্ত করেছে কোস্ট গার্ড Logo বরুড়ায় বিজয় দিবস উপলক্ষে মহিলা দলের আলোচনা সভা ও র‍্যালি অনুষ্ঠিত Logo সুবিধাবঞ্চিত ও ঝরে পড়া শিশুদের নিয়ে সিড ফাউন্ডেশনের বিজয় দিবস উদযাপন Logo ন্যাশনাল এনভায়রনমেন্ট এন্ড হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে বিজয় দিবস পালিত Logo রাঙ্গামাটিতে মহান বিজয় দিবস উদযাপন Logo মুরাদনগরে যথাযোগ্য মর্যাদায় মহান বিজয় দিবস উদযাপন

১৫ ডিসেম্বর ১৯৭১: বিজয়ের একেবারে দ্বারপ্রান্তে—রণাঙ্গনে চূড়ান্ত আঘাতের দিন

বিজয়ের মাস ডিসেম্বরের ১৫ তারিখটি ছিল বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক অনিবার্য ও চূড়ান্ত মোড় ঘোরানো দিন। মাত্র এক দিন পরই যে স্বাধীনতার সূর্য উঠবে তা এই দিনেই হয়ে গিয়েছিল নিশ্চিত। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ, ত্যাগ ও বীরত্বের পর ১৫ ডিসেম্বর ছিল পাক হানাদার বাহিনীর পরাজয় মেনে নেওয়ার দিন, আর বাঙালি জাতির বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে শেষ প্রস্তুতির ক্ষণ। রণাঙ্গনে তখন আর যুদ্ধের প্রশ্ন ছিল না ছিল আত্মসমর্পণের সময় ও স্থান নির্ধারণের পালা।

ডিসেম্বরের শুরু থেকেই ভারতীয় মিত্রবাহিনী ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মিলিত আক্রমণে পাকিস্তানি বাহিনী সম্পূর্ণভাবে কোণঠাসা হয়ে পড়ে। আকাশ, স্থল ও নদীপথ সব দিক থেকেই ঢাকাকে ঘিরে ফেলা হয়। ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে ঢাকা শহরের পতন কার্যত নিশ্চিত হয়ে যায়। ভারতীয় ও মিত্রবাহিনীর সর্বাধিনায়ক জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা পাকিস্তানি বাহিনীকে আত্মসমর্পণের সুস্পষ্ট আলটিমেটাম প্রদান করেন। ঢাকার আকাশে ভারতীয় বিমানবাহিনীর লাগাতার আক্রমণে ক্যান্টনমেন্ট, রেডিও স্টেশন, জ্বালানি ডিপো ও সামরিক স্থাপনাগুলো ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়, পাকিস্তানি বাহিনীর যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে এবং মনোবল চূড়ান্তভাবে বিপর্যস্ত হয়ে যায়।

স্থলপথেও ছিল চরম চাপ। পূর্ব দিকে মেঘনা নদী অতিক্রম করে এবং পশ্চিম দিকে টাঙ্গাইলে ছত্রীসেনা অবতরণের মাধ্যমে মিত্রবাহিনী দ্রুতগতিতে ঢাকা অভিমুখে অগ্রসর হয়। দেশের বিভিন্ন স্থানে তখনও কিছু বিচ্ছিন্ন প্রতিরোধ থাকলেও অধিকাংশ পাকিস্তানি সেনা পালানোর পথ খুঁজছিল। চট্টগ্রাম, খুলনা, সিলেট ও ময়মনসিংহ অঞ্চলেও পাকবাহিনীর পতন ছিল সময়ের অপেক্ষা মাত্র। তাদের রাজনৈতিক ও সামরিক নেতৃত্ব ততক্ষণে বুঝে গিয়েছিল এই যুদ্ধ আর জেতা সম্ভব নয়।

এই প্রেক্ষাপটে পাকিস্তান সরকার জাতিসংঘে যুদ্ধবিরতির জন্য মরিয়া কূটনৈতিক তৎপরতা চালায়। কিন্তু বিশ্ব জনমত ও যুদ্ধক্ষেত্রের বাস্তবতায় সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয়। একই সঙ্গে ইতিহাসের এক ঘৃণ্য অধ্যায় রচিত হয় ঠিক আগের দিন, ১৪ ডিসেম্বর পরাজয় নিশ্চিত জেনে পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসররা জাতিকে মেধাশূন্য করার উদ্দেশ্যে পরিকল্পিতভাবে দেশের শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে। সেই শোকের ছায়া নিয়েই ১৫ ডিসেম্বর এগিয়ে চলে বিজয়ের প্রস্তুতি।

১৫ ডিসেম্বরের সন্ধ্যায় পাকিস্তানি বাহিনীর প্রধান জেনারেল এ এ কে নিয়াজী ভারতীয় সেনাপ্রধান জেনারেল স্যাম মানেকশ এর কাছে একটি বার্তা পাঠান। ওই বার্তায় তিনি যুদ্ধ বন্ধের ইঙ্গিত দেন এবং সম্মানজনক যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব উত্থাপন করেন। কিন্তু মিত্রবাহিনী সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয় শর্তসাপেক্ষ কোনো সমঝোতা নয়, আন্তর্জাতিক রীতিনীতি অনুসারে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণই একমাত্র পথ। সেই বার্তার মধ্য দিয়েই মূলত আত্মসমর্পণের প্রক্রিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়।

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে তাই ১৫ ডিসেম্বর একদিকে চূড়ান্ত বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছানোর দিন, অন্যদিকে গভীর শোক ও আত্মত্যাগের স্মরণে ভাস্বর। এই দিনে আমরা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি সেই বীর মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ ও মিত্রবাহিনীর সদস্যদের যাঁরা নিজেদের জীবন বাজি রেখে একটি জাতিকে এনে দাঁড় করিয়েছিলেন স্বাধীনতার শেষ সিঁড়িতে।

১৫ ডিসেম্বর আমাদের প্রতিজ্ঞার দিন। ত্রিশ লাখ শহীদের রক্ত ও লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত এই স্বাধীনতাকে রক্ষা করতে হবে জ্ঞান, প্রজ্ঞা, মানবিকতা ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার শক্তিতে। কাল ১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবস। তার আগের এই দিনে আমরা মাথা উঁচু করে ইতিহাসের দিকে তাকাই, প্রস্তুত হই সেই চূড়ান্ত গৌরবের মুহূর্তকে বরণ করে নেওয়ার জন্য।

লেখক : মোহাম্মদ আলী সুমন, সাংবাদিক ও সংগঠক।

ট্যাগস
আপলোডকারীর তথ্য

জনপ্রিয় সংবাদ

১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১: বিজয়ের পরদিন, রাষ্ট্র গঠন ও যুদ্ধবিধ্বস্ত জাতির পুনর্গঠনের প্রথম দিন

SBN

SBN

১৫ ডিসেম্বর ১৯৭১: বিজয়ের একেবারে দ্বারপ্রান্তে—রণাঙ্গনে চূড়ান্ত আঘাতের দিন

আপডেট সময় ০৭:৫৮:৫৩ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১৫ ডিসেম্বর ২০২৫

বিজয়ের মাস ডিসেম্বরের ১৫ তারিখটি ছিল বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক অনিবার্য ও চূড়ান্ত মোড় ঘোরানো দিন। মাত্র এক দিন পরই যে স্বাধীনতার সূর্য উঠবে তা এই দিনেই হয়ে গিয়েছিল নিশ্চিত। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ, ত্যাগ ও বীরত্বের পর ১৫ ডিসেম্বর ছিল পাক হানাদার বাহিনীর পরাজয় মেনে নেওয়ার দিন, আর বাঙালি জাতির বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে শেষ প্রস্তুতির ক্ষণ। রণাঙ্গনে তখন আর যুদ্ধের প্রশ্ন ছিল না ছিল আত্মসমর্পণের সময় ও স্থান নির্ধারণের পালা।

ডিসেম্বরের শুরু থেকেই ভারতীয় মিত্রবাহিনী ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মিলিত আক্রমণে পাকিস্তানি বাহিনী সম্পূর্ণভাবে কোণঠাসা হয়ে পড়ে। আকাশ, স্থল ও নদীপথ সব দিক থেকেই ঢাকাকে ঘিরে ফেলা হয়। ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে ঢাকা শহরের পতন কার্যত নিশ্চিত হয়ে যায়। ভারতীয় ও মিত্রবাহিনীর সর্বাধিনায়ক জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা পাকিস্তানি বাহিনীকে আত্মসমর্পণের সুস্পষ্ট আলটিমেটাম প্রদান করেন। ঢাকার আকাশে ভারতীয় বিমানবাহিনীর লাগাতার আক্রমণে ক্যান্টনমেন্ট, রেডিও স্টেশন, জ্বালানি ডিপো ও সামরিক স্থাপনাগুলো ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়, পাকিস্তানি বাহিনীর যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে এবং মনোবল চূড়ান্তভাবে বিপর্যস্ত হয়ে যায়।

স্থলপথেও ছিল চরম চাপ। পূর্ব দিকে মেঘনা নদী অতিক্রম করে এবং পশ্চিম দিকে টাঙ্গাইলে ছত্রীসেনা অবতরণের মাধ্যমে মিত্রবাহিনী দ্রুতগতিতে ঢাকা অভিমুখে অগ্রসর হয়। দেশের বিভিন্ন স্থানে তখনও কিছু বিচ্ছিন্ন প্রতিরোধ থাকলেও অধিকাংশ পাকিস্তানি সেনা পালানোর পথ খুঁজছিল। চট্টগ্রাম, খুলনা, সিলেট ও ময়মনসিংহ অঞ্চলেও পাকবাহিনীর পতন ছিল সময়ের অপেক্ষা মাত্র। তাদের রাজনৈতিক ও সামরিক নেতৃত্ব ততক্ষণে বুঝে গিয়েছিল এই যুদ্ধ আর জেতা সম্ভব নয়।

এই প্রেক্ষাপটে পাকিস্তান সরকার জাতিসংঘে যুদ্ধবিরতির জন্য মরিয়া কূটনৈতিক তৎপরতা চালায়। কিন্তু বিশ্ব জনমত ও যুদ্ধক্ষেত্রের বাস্তবতায় সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয়। একই সঙ্গে ইতিহাসের এক ঘৃণ্য অধ্যায় রচিত হয় ঠিক আগের দিন, ১৪ ডিসেম্বর পরাজয় নিশ্চিত জেনে পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসররা জাতিকে মেধাশূন্য করার উদ্দেশ্যে পরিকল্পিতভাবে দেশের শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে। সেই শোকের ছায়া নিয়েই ১৫ ডিসেম্বর এগিয়ে চলে বিজয়ের প্রস্তুতি।

১৫ ডিসেম্বরের সন্ধ্যায় পাকিস্তানি বাহিনীর প্রধান জেনারেল এ এ কে নিয়াজী ভারতীয় সেনাপ্রধান জেনারেল স্যাম মানেকশ এর কাছে একটি বার্তা পাঠান। ওই বার্তায় তিনি যুদ্ধ বন্ধের ইঙ্গিত দেন এবং সম্মানজনক যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব উত্থাপন করেন। কিন্তু মিত্রবাহিনী সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয় শর্তসাপেক্ষ কোনো সমঝোতা নয়, আন্তর্জাতিক রীতিনীতি অনুসারে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণই একমাত্র পথ। সেই বার্তার মধ্য দিয়েই মূলত আত্মসমর্পণের প্রক্রিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়।

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে তাই ১৫ ডিসেম্বর একদিকে চূড়ান্ত বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছানোর দিন, অন্যদিকে গভীর শোক ও আত্মত্যাগের স্মরণে ভাস্বর। এই দিনে আমরা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি সেই বীর মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ ও মিত্রবাহিনীর সদস্যদের যাঁরা নিজেদের জীবন বাজি রেখে একটি জাতিকে এনে দাঁড় করিয়েছিলেন স্বাধীনতার শেষ সিঁড়িতে।

১৫ ডিসেম্বর আমাদের প্রতিজ্ঞার দিন। ত্রিশ লাখ শহীদের রক্ত ও লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত এই স্বাধীনতাকে রক্ষা করতে হবে জ্ঞান, প্রজ্ঞা, মানবিকতা ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার শক্তিতে। কাল ১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবস। তার আগের এই দিনে আমরা মাথা উঁচু করে ইতিহাসের দিকে তাকাই, প্রস্তুত হই সেই চূড়ান্ত গৌরবের মুহূর্তকে বরণ করে নেওয়ার জন্য।

লেখক : মোহাম্মদ আলী সুমন, সাংবাদিক ও সংগঠক।