ফেনী পৌরশহরের আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবনগুলো ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকিতে আছে। বহুতল ভবনের নকশায় উল্লেখ থাকলেও অধিকাংশ ভবনেই নেই রিজার্ভ পানির ব্যবস্থা। মানা হয়নি ফায়ার সেফটি প্ল্যান।
ফায়ার সার্ভিস বলছে, অগ্নি নির্বাপণের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থার অভাব আছে শহরের প্রায় সবগুলো আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবনে। একই সঙ্গে অপরিকল্পিত নগরায়ণে ঝুঁকির মাত্রা আরও প্রকট হচ্ছে।
এর আগে অগ্নিকাণ্ডের ধরন, ফায়ার সার্ভিস ও স্থানীয় ব্যক্তিদের মতে ঝুঁকির সর্বোচ্চ ধাপে আছে শহরের বড় বাজার ও সুলতান মাহমুদ পৌর হকার্স মার্কেট (রেলগেট বাজার)।
বাজারের ব্যবসায়ী নেতাদের দেওয়া তথ্যমতে, শহরজুড়ে ছোট বড় মিলিয়ে প্রায় ১৪-১৫ হাজার দোকান আছে। তাদের হিসাবে, ওই দুই বাজারে সম্পদের মূল্য আনুমানিক ৬০০ কোটি টাকা। অথচ এর কোনোটিতেই নেই পর্যাপ্ত অগ্নি নির্বাপণের ব্যবস্থা।
ফেনীর ঐতিহ্যবাহী বড় বাজারের আছে সুদীর্ঘ ইতিহাস। পাকা ও আধাপাকা দোকানগুলোতে কাঁচাবাজার থেকে শুরু করে আছে বিভিন্ন পণ্যের আড়ত, গার্মেন্ট সামগ্রী এবং ভোগ্যপণ্য। বাজার এলাকার আশপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বাণিজ্যিক ব্যাংকও।
বড় বাজারের কোনো দোকানেই অগ্নি নির্বাপণের ব্যবস্থা নেই বলে জানিয়েছেন ফেনী পৌরশহর ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক পারভেজুল ইসলাম হাজারী।
তিনি বলেন, ফেনী বড় বাজারেই আছে ৯ হাজার থেকে সাড়ে ৯ হাজার দোকান। যার কোনোটিতেই অগ্নি নির্বাপণের ভালো কোনো ব্যবস্থা নেই। এখানে ব্যবসায়ীদের পুঁজি ও অবকাঠামোসহ প্রায় সাড়ে ৫০০ কোটি টাকার অধিক সম্পদ আছে। এছাড়া বিভিন্ন ব্যাংকের বড় বড় লগ্নিগুলোও বাজারের ব্যবসায়ীদের কাছে। ফলে যেকোনো অগ্নি দুর্ঘটনায় এখানে জানমালের মারাত্মক বিপর্যয় ঘটতে পারে। এমন কিছু হলে পুরো ফেনীর অর্থনীতি ধসে পড়বে।
৯ হাজার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মাত্র ১০টিতে আছে অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্রঃ
অধিকাংশ ভবনেই নেই রিজার্ভ পানির ব্যবস্থা। এ ব্যবসায়ী নেতা আরও বলেন, বাজারে প্রবেশের রাস্তাগুলো চওড়া হলেও কিছু অসাধু ব্যবসায়ী দোকানের সামনে ফুটপাত বসিয়ে ভাড়া নিচ্ছেন। ফলে রাস্তা এত সংকুচিত হয়েছে যে, কোনো রিকশাও ঠিকভাবে প্রবেশ করতে পারে না। আর আগুন লাগলে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি কোনোভাবে সেখানে প্রবেশ করতে পারবে না।
২০১৮ সালে ৪ জুন ফেনী শহরের ট্রাংক রোডে বড় মসজিদের বিপরীতে ছেরাজ হার্ডওয়্যারে সিলিন্ডার বিস্ফোরণে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটে। কিন্তু আশপাশে পানির কোনো ব্যবস্থা না থাকায় আগুন নেভাতে বেগ পেতে হয় ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের।
এ বিষয়ে ফেনী পৌর শহর ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক পারভেজুল ইসলাম হাজারী বলেন, ওই দুর্ঘটনায় ফায়ার সার্ভিসের গাড়ির পানি শেষ হয়ে গেলে রাজাঝির দিঘি থেকে আনতে আনতে দোকান কর্মচারী নুরুল আলম (৩৫) অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যান। প্রয়োজন অনুযায়ী পানি না পাওয়ায় আগুন নেভাতে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল সেদিন। ছোট-বড় যেকোনো ধরনের অগ্নিকাণ্ড পানির কোনো বিকল্প নেই।
তিনি আরও বলেন, এক সময় বড় বাজারের মধ্যে নিউ মার্কেটের জায়গায় একটি পুকুর ছিল। তখন বড় মসজিদের মুসল্লিরা সেখানে ওজু করতেন, পানির ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু সেটি ভরাট করে ফেলায় এখন ভূমি অফিসের পুকুর আর রাজাঝির দিঘি ছাড়া আর কোনো ব্যবস্থা নেই।
অন্যদিকে সুলতান মাহমুদ পৌর হকার্স মার্কেটের অবস্থা একই বলে জানিয়েছেন মার্কেটের ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি ওমর ফারুক।
তিনি বলেন, এ বাজারে প্রায় ৩০০ দোকান আছে। যার অধিকাংশ কাঁচাপাকা ঘর। কাঁচা তরকারি, নিত্যপণ্য ও দৈনিক বাজার ভিত্তিক ব্যবসা পরিচালিত হয় এ বাজারে। সব মিলিয়ে সম্পদের পরিমাণ প্রায় ৫০ কোটি টাকা হবে। অথচ অগ্নি নির্বাপণের মতো কোনো ব্যবস্থাই এ বাজারে নেই।
ওমর ফারুক আরও বলেন, হকার্স মার্কেটের আশপাশে পানির কোনো ব্যবস্থা নেই। এ বিষয়ে পৌরসভাকে ৪-৫ বছর আগে লিখিত আবেদন জানালেও তারা এখন পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।
বড় বাজার নিয়ে ফেনী ফায়ার সার্ভিসের উপ-সহকারী পরিচালক পূর্ণ চন্দ্র মুৎসুদ্দী বলেন, বড় বাজারের আশপাশে কোনো পানির উৎস নেই। বড় বাজারে কমপক্ষে তিনটি পানির রিজার্ভার লাগবে। যাতে আগুন লাগলে তাৎক্ষণিক পানির ব্যবস্থা করা যায়।
তিনি আরও বলেন, ফায়ার সেফটি প্ল্যানের নিয়ম অনুযায়ী যেখানে প্রতিটি দোকানে অগ্নি নির্বাপণ যন্ত্র থাকার কথা, সেখানে বাজারজুড়ে মাত্র ১০টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে এ ব্যবস্থা আছে। কোনো বাণিজ্যিক ভবন যদি একতলাও হয় সেখানে সব রকমের সেফটি প্ল্যান মেনে ভবন তৈরি করতে হবে। অথচ ঠিক উল্টো চিত্র ফেনী বড় বাজারে। এতে করে অগ্নি ঝুঁকির মধ্যে সবার শীর্ষে আছে বাজারটি।
অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থার বিষয়ে ব্যবসায়ী সমিতির পক্ষ থেকে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হবে কি না জানতে চাইলে ব্যবসায়ী নেতা পারভেজুল ইসলাম হাজারী বলেন, যখন পুরাতন ঢাকায় একটি মার্কেটে আগুন লেগে অনেক মানুষের প্রাণ গিয়েছিল তখন ফেনী ফায়ার সার্ভিস ব্যবসায়ীদের নিয়ে অগ্নি নির্বাপণে করণীয় বিষয়ে একটি সেমিনার করেছিল। কিন্তু তা পরে আর বাস্তবায়ন হয়নি। বছরের অন্য সময়ের তুলনায় শীতকালে অগ্নিকাণ্ড বেশি ঘটে। এ সময় আবহাওয়া শুষ্ক থাকায় ছোট্ট একটি স্ফুলিঙ্গও বড় ধরনের বিপদ ডেকে আনতে পারে।